আর্যদের আদি বাসস্থান সম্পর্কিত বিতর্ক
ভারতীয় উপমহাদেশে যারা বৈদিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়ে ছিলেন তারাই সাধারণভাবে আর্য নামে পরিচিত । প্রকৃতপক্ষে আর্য শব্দটি কোন মানব গোষ্ঠী বা জাতির সমার্থক নয় তা একটি ভাষাগোষ্ঠীর পরিচায়ক।। সংস্কৃত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম এবং বৈদিক ভাষা সংস্কৃত সবাই বৈদিক সভ্যতার স্রষ্টারা আর্য নামে পরিচিত।
আর্যরা ভারতীয় না বৈদেশিক অথবা আর্যদের আদি বাসস্থান কোথায় এ বিষয়ে বিতর্ক আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। ভাষাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণে দ্বারা সাম্প্রতিক গবেষণায় এ তথ্য এখন সুপ্রমাণিত যে আর্যরা বৈদেশিক। আর্যরা অশ্ব,রথ,অরযুক্ত চাকা , সোমরসের ব্যাবহার অন্তেষ্টি ক্রিয়তি ব্যবহৃত মৃৎপাত প্রভৃতি যে ব্যবহার করত তার সন্ধান পাওয়া যায় ঋকবেদে, জেন্দাবেস্তা ইলিয়াড ও ওডিসি প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে। একইভাবে এই সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
বৈদিক আর্য দের জীবনযাত্রা সঙ্গে অশ্বের ব্যবহার ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অশ্ব বলের এর প্রতীক এবং সাধারণত শক্তির রূপক হিসেবে প্রতিভাত। বৈদিক যুগে বিভিন্ন স্রোতে প্রজা ও পশুর মত অশ্বের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। হোমারের রচনায় থেকে এ বিষয়ে নিঃসংশয় যে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক এর নিকটবর্তী মধ্য এশিয়ার দাক্ষিণাত্যে ও ইরান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে পর্যন্ত অশ্ব একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
কোন কোন ঐতিহাসিক খ্রিস্টপূর্ব 6000 অব্দ নাগাদ দক্ষিণ উড়াল ও কৃষ্ণ সাগর অশ্বের বর্ণনা পাওয়া যাওয়াই ওই অঞ্চলকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে চিহ্নিত করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মরিজা গিম্বুতাস, গর্ডন চাইল্ড প্রমুখ ঐতিহাসিক। গিম্বুতাস পশ্চিমে নিপার ও পড়বে ভলগা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে আর্যদের বাসভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে ভলগার শুল্ক বিষ্পাদপ তৃণভূমি অঞ্চলের মেষপালক রায় প্রথম অশ্ব পালন শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব 6000 থেকে 3000 অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে উক্ত অঞ্চলগুলিতে অশ্বের পুরাতাত্ত্বিক সন্ধান পাওয়া গেছে। গিম্বুতাসের অভিমত সমর্থন করেছেন ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড
অশ্ববাহিত রথের ব্যবহার ইন্দো-ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। পরবর্তী বৈদিক গ্রন্থা দিতেও বাজাপেয় । যজ্ঞ উপলক্ষ্যে রথ প্রতিযোগিতা বিধান দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ রাশিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে খ্রিস্টপূর্ব 3000 অব্দের থেকে শুরু করে রথের অস্তিত্বের যথেষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া যায়। আনুমানিক 1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ পূর্ব ইউরোপে অর যুক্ত রথযাত্রা দেখা যায়। কৃষ্ণ সাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী লব্যাসেনে প্রাপ্ত টিলা গলিতে খ্রিস্টপূর্ব 1500 থেকে 28 টি অর বিশিষ্ট দুটি চক্রযুক্ত রথ পাওয়া গেছে।
মনে করা হয় অর যুক্ত চক্রের ব্যবহার ইন্দো-ইউরোপীয়দের বৈশিষ্ট্য নয়। ইন্দো-আর্য অথবা ইন্দো-ইউরোপীয় দের পূর্ব শাখার আগমনের পূর্বে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 1600 তে পশ্চিম এশিয়ায় অর যুক্ত চক্রের আবির্ভাব হয়েছিল। রিচার্ড মিডো যুক্তি দেখিয়েছেন যে খ্রিস্টপূর্ব 2000 পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের উপস্থিতির সাখ্য রুপে অস্থিগত কোন নিদর্শন নেই ।
গর্ডন চাইল্ড সোভিয়েত রাশিয়ার দক্ষিণাংশে তৃণভূমি কে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তার মতে উল্লিখিত অঞ্চলের বিভিন্ন মাটির ঢিবি যুক্ত কবর খুঁড়ে একশ্রেণীর মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে যারা ছিল লম্বা ও সুগঠিত চোয়াল, সরু নাসিকা ও লম্বা মাথা ওয়ালা অথাৎ নাডিকা গোষ্ঠীভুক্ত। এর সঙ্গে পাওয়া গেছে অশ্বের অস্থি ও আর্যদের ব্যবহৃত অন্যান্য কিছু উপাদান। তবে অনেক পণ্ডিত এ বিশ্বাসে স্থির যে অশ্বের সঙ্গে কেবলমাত্র আর যাদের সম্পর্ক ছিল না তা নয় কারণ প্রাচীনকালের অনেক যাযাবর জাতিই অশ্বের ব্যবহার করত।
দক্ষিণ রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং ইউক্রেন অঞ্চলে এক বিশেষ ধরনের পাত্র পাওয়া গেছে যা আর্যদের তৈরি বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। নেহরীং এদের মধ্যে অন্যতম। তার মতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মৃৎপাত্রগুলি ইন্দো-ইউরোপীয়দের তৈরি। তাই তিনি এই উপাদান এর ভিত্তিতে দক্ষিণ রাশিয়া এবং তার পশ্চিমে অঞ্চলকে আর্যদের আদি বাসভূমি বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এই অভিমত কখোনই সম্পন্ন গ্রহণযোগ্য নয় এগুলি সমালোচিত ও বিতর্কিত।
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা পেয়েছেন । এই পর্যায়ে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে উত্তর বালুচিস্তানে নদীর পাড়ে পেরিয়ানাল গুন্ডায় ,বোলান গিরিপথ এর কাছে পিরাক, গোময উপত্যাকার গান্ধার সমাধিক্ষেত্র।
পিরাক,গোয়াল,সোয়াত, এবং এমনকি চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি কাল পরিধি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখিত জলবায়ু বিষয়ক তথ্য গুলির সঙ্গে সমকালীন ও সাদৃশ্যপূর্ণ। বৈদিক আর্যরা পাঞ্জাব হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের অগ্রসর হয়েছিল। তাই এই অঞ্চলে প্রায় সাত শর বেশি চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা পরবর্তী বৈদিক সংস্কৃতিকে সূচিত করে। মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যাকায় আর্যদের সম্প্রসারণ এর প্রমাণ বহন করছে কৃষ্ণবর্ণ পিচ্ছিল মৃৎপাত্র এবং উত্তরের কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ মৃৎপাএ , উৎপাদন ব্যবস্থার লোহার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার। তবে ততদিনে দ্রাবিড় ভাষা ও অন্যান্য প্রাগার্য সংস্কৃতির সঙ্গে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা ও সংস্কৃতির অনেক সংমিশ্রণ ঘটেছে।
ইন্দো-আর্যগন ভারতের বাইরে থেকে এসেছিল এই তথ্য যেমন হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে গ্রহণীয় নয় তেমনই গ্রহণীয় নয় পাশ্চাত্যের সেইসব পণ্ডিতদের কাছে যারা আঞ্চলিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পারমপরায় বিশ্বাসী।
আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে যাঁরা ভারতের দাবির পক্ষে তাঁরা ঋগ্বেদে উল্লিখিত ভৌগোলিক তথ্যের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এ বিষয়ে একটি নতুন যুক্তি উত্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ঋগ্বেদের ভৌগোলিক বিবরণ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, যাঁরা এই গ্রন্থের স্তবগান বা স্তোত্র রচনা করেছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন পাঞ্জাব ও এর সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। তাই এঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ঋগ্বেদ রচয়িতারা অথবা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা অন্য কোনো দেশের বাসিন্দা ছিলেন না। এপ্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ শচীন্দ্রকুমার মাইতি। তিনি লিখেছেন যে, আগে ধারণা ছিল আর্য সভ্যতার উদ্ভব ইওরোপে। সেখান থেকে এশিয়া মাইনর বা মেসোপোটেমিয়া হয়ে শেষপর্যন্ত মহেঞ্জোদারোর নগর সভ্যতাকে ধ্বংস করে বহিরাক্রমণকারী আর্যরা ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল। তিনি আরো বলেছেন যে, সেইসময় পুরাতাত্ত্বিক খননকার্য কমই হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে পুরাতাত্ত্বিক খননকার্য এবং এ ব্যাপারে গবেষণার যতই অগ্রগতি ঘটছে আর্যদের ভারতীয়ত্ব সম্পর্কে অভিমত ততই প্রবল ও অকাট্য হয়ে উঠেছে।
সুতরাং, আর্য সমস্যা সংক্রান্ত শেষ কথা নির্দিষ্ট করে এখনও বলা যাবে না। যতদিন না উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় ততদিন এই সমস্যার প্রকৃত নিরসন ঘটা সম্ভব নয়। তবে ওপরের আলোচনা থেকে যা অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে তা হল আর্যরা বরাবর এদেশের মানুষ ছিল না। এদেশে তারা ছিল বহিরাগত। ‘জাতি’ অর্থে আর্যরা প্রারম্ভিক পর্বে পরিচিত ছিল না। ভাষা থেকে এর উদ্ভব হয়েছে। ইন্দো ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হল ভারতীয় আর্যরা। এই ইন্দো-ইওরোপীয়দের উৎপত্তিস্থল অদ্যাবধি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক করে বলা যাবে না। তবে অনুমান হয় যে কিরঘিজ স্তেপি অথবা ইউরেশিয়ার কোনো অঞ্চলে তাদের আদি বাসস্থান ছিল।
মূল্যায়ন
আর্যদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল সে বিষয়ে ভাষাতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ কে ভিত্তি করে এ তথ্য আলোচনা বেশিরভাগই অনুমান ভিত্তিক। তাই আলোচ্য বিষয়টি বিতর্কিতই থেকে গেছে।