গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত—এই দুই খ্যাতনামা শাসকের সামরিক প্রতিভার গুণে গুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তৃততর রূপ ধারণ করেছিল। পূর্ব ভারত ও সংলগ্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র অংশকে কেন্দ্র করে এই সাম্রাজ্য শেষপর্যন্ত বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরাংশের এক বৃহত্তর এলাকায় বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু সুদীর্ঘকাল ধরে গুপ্ত সাম্রাজ্য তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি। অন্যান্য সাম্রাজ্যের ন্যায় ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ থেকে এই সাম্রাজ্যকেও বিদায় নিতে হয়েছিল।৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক গৌরবোজ্জ্বল অস্তিত্বের পর সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ক্রমিক অবক্ষয়ের দিকে যেতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে এর পতন ঘটে
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে প্রধানত দুটি দিক ছিল একটি হল অভ্যন্তরীণ দিক এবং অপরটি বৈদেশিক শত্রুর চাপ।
এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পিছনে সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, প্রথম কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের এক মহান ভূমিকা ছিল। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল স্কন্দগুপ্তের পর। এই সময় বাস্তব পরিস্থিতি সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার পক্ষে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল ঠিকই, কিন্তু শাসকদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার মতো মানসিক দৃঢ়তা ছিল না, শক্তিও ছিল না।
বস্তুতপক্ষে স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একেবারে শেষ অবধি এমন কোনো শাসক সিংহাসনে বসেননি, যিনি সাম্রাজ্যকে অটুট রাখার জন্য সত্যিকারের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। শেষদিকের শাসকদের মধ্যে যদিও বুধগুপ্ত কিছুটা উদ্যোগী ছিলেন তথাপি সাম্রাজ্যের বিস্তৃত অংশকে তিনি একসূত্রে গ্রথিত করতে পারেননি।
শুধু পরবর্তী শাসকদের দুর্বলতা নয়, স্কন্দগুপ্তের সময় থেকে গুপ্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার জন্য দাবিদারদের মধ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল।স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর পুরুগুপ্ত ও দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের মধ্যে সম্ভবত গৃহযুদ্ধ বেধেছিল। এছাড়া, বুধগুপ্তের পর বৈন্যগুপ্ত ও ভানুগুপ্তের মধ্যে এ ধরনের কোনো যুদ্ধ বেধেছিল কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বাহুবলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের যে পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন তাকে সুষ্ঠু রূপ দেবার জন্য সুশাসন ব্যবস্থা বলবৎ রেখেছিলেন। ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত গুপ্তদের কেন্দ্রীয় শাসন বলবৎ ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে।
গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় বংশানুক্রমিকভাবে কর্মচারী ও মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টিও সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। বলাবাহুল্য, এর ফলে অযোগ্য লোকেদের মর্যাদাশীল পদে অধিষ্ঠিত হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। কর্মচারীদের অদক্ষতাজনিত কারণে সাম্রাজ্যের পতন যে দ্রুতগামী হয়ে উঠেছিল সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ কম। বংশানুক্রমিক কর্মচারী ও মন্ত্রী নিয়োগের আরো অনেক দৃষ্টান্ত পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।
তাঁর মতে প্রথমদিকের গুপ্ত সম্রাটেরা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তাঁরা যাগযজ্ঞে পশুবলি দিতেও দ্বিধা করতেন না। কিন্তু পরবর্তীকালের গুপ্ত শাসকেরা বিশেষত বুধগুপ্ত ও বালাদিত্য বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।এর ফলে সাম্রাজ্যের পতন কিছুটা দ্রুতগামী হয় বলেও তিনি মনে করেন। এই মতের যৌক্তিকতা নিয়ে অবশ্য সংশয় থাকা স্বাভাবিক।
এইভাবে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যে এক সার্বিক অবক্ষয় চলছিল। এসব কিছুর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিল বিদেশীয় হুনরা। তারা শুধু গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল তাই নয়, এখানে তাদের শাসনও প্রতিষ্ঠা করেছিল। বস্তুত এই হুন আক্রমণ ও শাসন সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ডকে একেবারে ভেঙে দিয়েছিল—এর পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।