মধ্যযুগের বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে হুসেন শাহী বংশের অবদান আলোচনা করো।
অর্থনৈতিক অবস্থা:
হুসেন শাহী রাজত্বের বাংলায় যে স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বিকশিত হবার সুযোগ পায়।পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিবরণ পাওয়া যায় বিদেশি পর্যটক লেখক এবং সমকালীন মঙ্গল কাব্যে বিধৃত বিবরণ থেকে । রাজস্বই ছিল সুলতানদের আয়ের প্রধান উৎস এবং তা গড় উৎপাদন এর ভিত্তিতে 1/5 অংশ হিসেবে আদায় কৃত হত। অভ্যন্তরীণ সমৃদ্ধি ও বহিঃ বাণিজ্যের ফলে হোসেন শাহী যুগ এবং দেশের সম্পদ বৃদ্ধি ও আর্থিক উন্নতি সাধিত হয়।
জনকল্যাণ মূলক কাজের জন্য বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। আরব পর্যটক ইবনে বতুতা সমকালীন অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলার নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দায় কর্ম থাকার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । ওয়াং তাওযান নামক জৈনক চিনা এ সম্পর্কে জানিয়েছেন যে পরিশ্রম পূর্বভারতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কম থাকায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগত বিদেশী বণিকদের 10 জন এর মধ্যে ন জন ই দেশে ফিরতে চান না। মা হুয়ান জানিয়েছেন যে বাংলায় বহু মূল্যবান সুতি বস্ত্রের সঙ্গে 6 রকমের মহাঘ বস্ত্র তৈরি হতো ।রেশম চাষ ওম রেশম শিল্পের সূচনা পরবর্তী দুশো বছরের বাংলা সমিতির কারণ ছিল বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
নিকোলো কন্টি সহ অন্যান্য পর্যটকরা শস্য-শ্যামলা বাংলার খাদ্য শস্য প্রাচুর্য লক্ষ্য করেছেন। বাংলার চাল নদীপথে পাটনা হয়ে আগ্রা এমনকি দক্ষিনে করমন্ডল এবং কেরলে রপ্তানি হতো। গম রপ্তানি হতো বিহার থেকে । সমুদ্রপথে চিনি (সাদা) বাংলা থেকে সমগ্র ভারতবর্ষে পাঠানো হতো। এছাড়া মসলিন রেশমি সুতি বস্ত্রের জন্য বাংলা সুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এভাবেই বাংলা পরবর্তীকালে সারা দেশের common store house এ পরিণত হয়েছিল।
চতুর্দশ শতাব্দী থেকে বাংলার টাকশাল শহরের উত্থান পরিলক্ষিত হয়। এসময় নগরায়ন শুধুমাত্র গৌড় পান্ডুয়া সাতগাঁও সোনারগাঁও এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে সোনারগাঁও চট্টগ্রাম চাঁদগাও ও হুগলির যথেষ্ট সুনাম ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সপ্তগ্রাম এর বাণিজ্যিক উত্থান ও স্থানীয় মুদ্রা পাওয়া যায়। বাণিজ্য কে পোস্ট করেছিলো উন্নত কৃষি ব্যবস্থা এবং বহু অনাবাদি জমিতে কৃষি যোগ্য করে তোলা হয়েছিল। তবে মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা তথ্য পাওয়া যায়।
বহুলোক কারিগর ও শিল্পী হিসেবে বিদেশ ও সুখ্যাত হয়ে ওঠে বৈদেশিক বাণিজ্যের কারণে। বৈদেশিক ও সামুদ্রিক বাণিজ্য এর ফলে প্রচুর সোনার আমদানি হয়েছিল এবং হোসেন শাহী যুগের স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া যায়। যদিও রৌপ মুদ্রার চলছিল বেশি মুদ্রা হিসেবে কড়িড় ব্যবহৃত হতো। বহি বাণিজ্যে চিনি, চাল, গম ,ও অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সুপারি তেল,আধা ও অন্যান্য ফল রপ্তানি হতো। ইটালি ও ভ্রমণকারী বাবোসা ও ফাতেমার লেখা থেকে জানা যায় যে দুটি সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ ছিল, একটি দক্ষিণ-পূর্বে ব্রহ্মদেশ আরকান থাইল্যান্ড মালাক্কা ইন্দোনেশিয়া চম্পা হয়ে চীন পর্যন্ত চিহ্ন এবং অপরটি উড়িষ্যা করমন্ডল উপকূল শ্রীলংকা মালাবার উপকূল দিয়ে পারস্য উপসাগর আরব সাগর আরব ও আবিসিনিয়া পর্যন্ত প্রসারিত ছিল ।
মুকুন্দরাম পেশাগত কারিগরদের বিশাল তালিকা দিয়েছেন , যার মধ্যে স্বর্ণকার নৌকার কাগজি উৎপাদন ইত্যাদি রয়েছে। বলা নিস্পয়োজন যে পান্ডুয়া ও গৌড়ের সৌধ নির্মাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তার কারণ এর একটা বড় অংশ আসত বাণিজ্য থেকে ।
মূল্যায়ন :
তবে এই সমৃদ্ধি সত্বেও 1509 খ্রিস্টাব্দে হুসেন শাহী রাজত্বের রাজ্য দুর্ভিক্ষের উল্লেখ আছে চৈতন্য ভাগবতে। সন্দেহ নেই প্রাকৃতিক কারণে এই দুর্বিপাক হয়েছিল কিন্তু হুসেন শাহী যুদ্ধবিগ্রহের ব্যয় ভার প্রজাদের বহন করতে হতো। এবং তার ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা তথা দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে গিয়েছিল।