ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে / ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ
ভূমিকা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর বিশ্ব ইতিহাসে পরিবর্তন এসেছিল। ইউরোপে গণতন্ত্রের মড়ক শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে ইতালি, জার্মানি, স্পেন ইত্যাদি দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবেশ তৈরি হয়। ইতালিতে মুসোলিনী, জার্মানিতে হিটলার এবং স্পেনে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কের নেতৃত্বে একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান
মাৎসিনী, কাভুর ও গ্যারিবল্ডী সহ অসংখ্য ইতালির জাতীয়তাবাদীদের নিরলস চেষ্টার ভৌগোলিক সংজ্ঞাপ্রাপ্ত ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে ইতালি জার্মানির পক্ষে ছিল। কিন্তু ১৯১৫ সালে ইতালি জার্মানির পক্ষ ত্যাগ করে মিত্রপক্ষে যোগ দেয় অর্থাৎ ইতালি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী দেশ। ইউরোপে তার সীমানা বৃদ্ধি পাবে এবং ইউরোপের বাইরে তার উপনিবেশ গড়ে উঠবে এই আশা নিয়ে ইতালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষে চলে এসেছিল।
১৯১৫ সালের লন্ডন চুক্তিতে মিত্রপক্ষ ইতালিকে যেসব স্থান দেব বলেছিল তার জন্য ইতালীয়রা মিত্রপক্ষের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত ভার্সাই সন্ধিতে ইতালিকে বঞ্চিত করা হয়। এই চুক্তিতে ইতালির অনেক দাবিকে মানা হয়নি। বিশেষ করে আদ্রিয়াটিক উপকূলের ফিউম (Fiume) বন্দর ইতালিকে দেওয়া হয়নি। আলবেনিয়ার উপর ইতালির অধিকার স্বীকৃত হয়নি। উপনিবেশ সংক্রান্ত কোন দাবিকে মানা হয়নি। স্বাভাবিক কারণে অন্যান্য মিত্রশক্তির মত ইতালি লাভবান না হলেও সাধারণ ইতালীয়দের মনে এই বিদ্বেষ জমা হয় যে মিত্রপক্ষ তাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে বঞ্চনা করেছে। ইতালি বিজয়ী রাষ্ট্র হয়েও ভার্সাই চুক্তি বিরোধী হয়ে পড়েছিল। ইতালির এই দাবিগুলো ও বঞ্চনা ছিল ফ্যাসিবাদের উত্থানের আরেক কারণ।
ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের অন্যতম কারণ ছিল অর্থনীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ইতালির অর্থনীতির উপরে তীব্র আঘাত হানে। অন্যান্য ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মত ইতালির আর্থিক কাঠামো তেমন মজবুত ছিল না। সেজন্য যুদ্ধের ধাক্কা ইতালির অর্থনীতি সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়েছিল। খাদ্যসংকট, বেকারত্ব ইতালির অর্থনীতিকে নাজেহাল করে দেয়। মুদ্রাস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করে। শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল। ফলে ইতালির জনজীবনে যে নৈরাশ্য নেমে এসেছিল তার সুযোগ নেয় দক্ষিণপন্থী দলগুলি।
ইতালির অর্থনৈতিক সংকটকে মোকাবিলার সামর্থ্য তখনকার সরকারের ছিল না। সাধারণ ইতালীয়রা ঘরে বাইরে ইতালির দুরবস্থার জন্য সরকারকে দায়ী করেছিল। উনিশ শতকে ইতালি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর সেখানে ব্রিটিশদের অনুকরণে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এই গণতন্ত্রের ভিত্তি ইতালিতে কোনদিনই শক্তিশালী ছিল না। ১৯১৯-২২ সালের মধ্যে পরপর কয়েকটি মন্ত্রিসভার পতন ঘটেছিল। গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা কমে গিয়েছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ইতালিতে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীও এক শক্তিশালী সরকারের জন্য স্বপ্ন দেখে। সৈনিকরাও এক দৃঢ় সরকার গঠনে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেছিল। জাতীয় জীবনের এই সংকটময় কালে মুসোলিনী নামক নেতার উদ্ভব হয়। তিনি ও তার ফ্যাসিস্ট দল ইতালির জনগণকে নতুন পথের সন্ধান দেন এবং তিনি ইতালির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেন।
![]() |
বেনিতো মুসোলিনি ( Benito Mussolini ) |
১৮৮৩ সালে জন্ম হয়েছিল মুসোলিনীর। তার পিতা ছিলেন সামান্য একজন কর্মকার এবং মা ছিলেন শিক্ষিকা। মুসোলিনী নিজেও প্রথম জীবনে শিক্ষক পদ গ্রহণ করেন। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মুসোলিনী উচ্চ শিক্ষার জন্য সুইজারল্যান্ডের লুসানে ও জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি সুগভীর আস্থার জন্য তিনি সুইজারল্যান্ড থেকে বহিষ্কৃত হন। দেশে ফিরে তিনি আভাক্তি বা প্রগতি পত্রিকার সম্পাদনা আরম্ভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে তিনি জনগণের যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষে দেশকে ঘনায়মান অরাজকতার হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তিনি ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে মিলান শহরে একটি রাজনৈতিক দলের পত্তন (উত্থান) করেন। এই রাজনৈতিক দল ‘ফ্যাসিস্ট দল’ নামে পরিচিত ছিল। মুসোলিনী ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দল গঠন করেন। এই দলের প্রতীক ছিল ফ্যাসিস্ বা দড়ি বাঁধা কাষ্ঠদণ্ড। প্রাচীন রোমের রাজশক্তির প্রতীক ছিল এই ফ্যাসিস্ট। প্রাচীন ইতালির ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার কথা তিনি বলেছিলেন। কর্মচ্যুত সৈনিক ও বেকারদের নিয়ে তিনি সামরিক বাহিনী গঠন করেন। কালো পোষাক পরত বলে তারা Black shirts নামে পরিচিত ছিল। এই দল মনে করত রাষ্ট্র হল সকল শক্তির আধার, রাষ্ট্রের বাইরে কিছু নেই এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কিছু নেই। এই দলকে নিজেদের স্বার্থে দেশের পুঁজিপতি ও জমিদাররা সমর্থন করেছিল। ক্রমশ এই দল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মুসোলিনীকে ফ্যাসিবাদের জনক বলা হয়।
মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দল সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাদের সভা সমিতি ভেঙে দেয়। প্রকাশ্যে সমাজতন্ত্রীদের ভীতি প্রদর্শন এবং এমনকী তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়। দেশে সে সময়ে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। দুর্বল ইতালীয় সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। বরং এই সরকার ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের প্রসারে সাহায্য করেছিল। ১৯২১ সালের মধ্যে ফ্যাসিস্টরা দেশের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দলে পরিণত হয়েছিল। নির্বাচনে এই দল অংশ নেয়। ১৯২১ সালের নির্বাচনে এই দল ৩৫টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
১৯২২ সালের ২৮শে অক্টোবর মুসোলিনী তার ফ্যাসিস্ট বাহিনী নিয়ে রোম অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মুসোলিনীর দাবি মত ইতালির মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করলে রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েল বাধ্য হয়ে মুসোলিনীকে মন্ত্রীসভা গঠনে ডাকেন। ৩০শে অক্টোবর মুসোলিনী মন্ত্রীসভা গঠন করেন। চেম্বার অফ ডেপুটিজ ভোটের দ্বারা মুসোলিনীর হাতে এক বছরের জন্য দেশের সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। তিনি সমস্ত বিরোধী শক্তির কণ্ঠকে রোধ করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করেন। এমন ভাবে নির্বাচন বিধিকে সংস্কার করা হয় যাতে পুনরায় ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় আসতে পারে। মুসোলিনী ক্রমশ প্রধানমন্ত্রী থেকে ডিক্টেটারে পরিণত হন।
মূল্যায়ন
ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি বা চরিত্র বিশ্লেষণে পণ্ডিতেরা একমত নন। মার্কসবাদী পণ্ডিতদের মতামত হল ফ্যাসিবাদ ছিল পুঁজিবাদের সংস্করণ। কারণ পুঁজিপতিরা ও জমিদাররা নিজেদের স্বার্থকে পূরণ করার তাগিদে তারা ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেন। সেজন্য মুসোলিনী তাদের সাহায্যে ক্ষমতায় আসেন। অন্যদিকে আস্তনি গ্রামসির মতো লেখকরা অন্যভাবে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে ফ্যাসিবাদকে পুঁজিবাদের ষড়যন্ত্রের ফল বলা যাবে না। ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ অবশ্যই গণসমর্থন ছিল। ফ্যাসিবাদকে প্রয়োজনীয় ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা বলতেও অনেকে দ্বিধা করেন না। অনেকে আবার ফ্যাসিবাদকে বৈপ্লবিক ব্যবস্থা বা Revolutionary Phenomena বলতেও কুণ্ঠিত হননি। তাদের মতে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান সঙ্গে সঙ্গে ইতালি তার হতাশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল।