সাতবাহন আমলের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো ।
অর্থনৈতিক অবস্থা :
সাধারন মানুষের আয়ের মূল উৎস ছিল কৃষি। লেখমালায় গো-দান ও ভূমি দানের উল্লেখ থেকে কৃষির গুরুত্ব বোঝা যায় । মিলিন্দ পঞহো গ্রন্থে অপরান্ত বা কোঙ্কন উপকূলের কুমুদ ডান্ডিকা ধানের উল্লেখ আছে গাথা সপ্তশতীতে ধান, গম, ছোলা, শন, কার্পাস ও আঁখের উল্লেখ পাওয়া যায় । প্লিনির বিবরণী ও পেরিপ্লাস থেকে জানা যায় যে, মালাবার অঞ্চলে গোলমরিচ উৎপন্ন হত এবং দারুচিনি, এলাচ প্রভৃতি মশলাও যে উৎপাদিত হত তা জানা যায়। করমন্ডল উপকূলে নারকেল চাষের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তামিলনাড়ুর পেরিকামেডুতে আবিষ্কৃত হয়েছে।
কৃষি ব্যবস্থায় দুটি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের ব্যবস্থাও করা হয়। এগুলি সেচকাজে ব্যবহৃত হত । এর একটি হল উদক যন্ত্র এবং অপরটি হল অরহট্টঘেটিকা, গাথা সপ্তশতীতে এর উল্লেখ আছে । যন্ত্রটি দেখতে চক্রের মতো যার গায়ে অনেকগুলি ঘটি বসানো আছে। এটি বসানো হত কোনো বৃহৎ জলাশয়ের মধ্যে । ঘুরন্ত চক্রের মাধ্যমে ঘটিগুলি জলপূর্ণ হয়ে নিম্নমুখী হলে সেই জল সেচের কাজে ব্যবহৃত হত । বলাবাহুল্য যে, পেয়েছিল। উদক যন্ত্র ও অরহট্টঘটিকা যন্ত্র ব্যবহারের ফলে কৃষির উৎপাদন নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি
সাতবাহন রাজ্যে জমির ব্যাক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অবশ্য কয়েকটি গ্রাম যে একমালি (যৌথ) সম্পত্তি ছিল তারও প্রমাণ আছে । সাতবাহন লেখতে গ্রহীতাকে রাজস্বদানের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হত । অনুমান করা হয় সেসময় ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো কারনে জমি কেনা বেচা হত । সম্ভবত উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠাংশ রাজস্ব বাবদ রাজভান্ডারে জমা পড়ত। লবণ উৎপাদনে রাষ্ট্র সম্ভবত সরাসরি অংশগ্রহন করত না, ব্যাক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহ দিত । তবে রাষ্ট্র উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট অংশ কর বা শুল্করূপে গ্রহন করত। তত্ত্বগতভাবে রাজ্যের যাবতীয় খনি ও খনিজ দ্রব্য ছিল রাজকীয় তথা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি।
সমকালীন লেখমালায় এযুগের বিভিন্ন বৃত্তি ও কারিগরী শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌলিক বা তন্তুবায়রা সংখ্যায় বেশী ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের মধ্যভাগে অবস্থিত টের বস্ত্রশিল্পের দুটি প্রধান কেন্দ্র । আরিকামেডুর প্রত্নক্ষেত্র থেকে বস্ত্র রঙিন (টগর) ও পৈঠান (প্রতিষ্ঠান) ছিল করার অনুরূপ আঠা আবিষ্কৃত হয়েছে । সেযুগে অনেকেই ধাতু, পাথর ও মৃৎশিল্পকে জীবিকারূপে গ্রহন করেছিল । পৈঠান, মাস্কি, কোল্ডপুর, ভট্টিপ্রলু অমরাবতী থেকে পোড়ামাটির মূর্তি, গেছে পাথর, সোনা, তামা, হাতির দাঁত ও শাখের তৈরী গহণা, স্ফটিকের জিনিস, ছাঁচ ও মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। সাতবাহন লেখমালায় স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও মনে হয় যে, শিল্পী, কারিগর ও ব্যবসায়ীদের নিজস্ব সংগঠন বা গিল্ড ছিল ।
পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী, টলেমির ভূগোল এবং সাতবাহন রাজ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত রোমক ও দেশীয় মুদ্রা সেযুগের ব্যবসাবানিজ্যের অগ্রগতির পরিচয় বহন করে । পশ্চিমাঞ্চলের বন্দর ও বানিজ্য কেন্দ্র হিসাবে সুখ্যাত ছিল সোপরা, কল্যাণ, টের,জুন্নার,নাসিক ও বৈজয়ন্তী। অমরাবতী লেখ থেকে কেবুরুর, বিজয়পুর, কুদুর বানিজ্য কেন্দ্রের উল্লেখ আছে । টলেমির বিবরনে মাসালিয়া (মসুলিপত্তম) বানিজ্য। এবং ঘন্টকসালের মত পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি সমৃদ্ধ বন্দরের উল্লেখ আছে। সাতবাহন রাজধানী প্রতিষ্ঠা থেকে একটি সড়কপথ টগর, নাসিক, উজ্জয়িনী ও সাঁচী হয়ে শ্রাবন্তী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং অপর একটি পথ পশ্চিম উপকূলের বিখ্যাত বন্দর ভৃগুকচ্ছ থেকে মালব, গাঙ্গেয় উপত্যকা, তক্ষশীলা ও পুষ্কলাবতী হয়ে কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
সাতবাহন, রাজারা সিসা, তামা, রূপা ও মিশ্র ধাতুতে মুদ্রা উৎকীর্ণ করলেও কোনো স্বর্ণমুদ্রার পরিচয় পাওয়া যায়নি । অন্তঃবানিজ্যে শুধুমাত্র মুদ্রাই নয় পন্যবিনিময়ের মাধ্যমেও হত। সাতবাহন রাজ্যের সঙ্গে রোমের ঘনিষ্ঠ বানিজ্যিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল । হিপ্পালাসের মৌসুমীবায়ু প্রবাহপথ আবিষ্কারের ফলে প্রাচ্যের সঙ্গে রোমের বানিজ্যের নতুন সূচনা হয়।
দক্ষিণ ভারত থেকে চাল গমের মতো গোলমরিচ, দারুচিনি, চন্দন, সেগুন ও মেহগিনি কাঠ, কার্পাস ও রেশমীবস্ত্র, মসলীন, দামী পাথর, সুগন্ধী মশলা, হাতির দাঁত প্রভৃতি রপ্তানি করা হত । আর আমদানীর তালিকায় ছিল সুরা তামা, টিন, সিসা, প্রবাল, পুষ্পরাগ মণি, স্বচ্ছ কাঁচ মোম ছাল, সুরমা প্রভৃতি । তবে শকদের সঙ্গে সাতবাহন রাজাদের সংঘর্ষ ভারত-রোম বানিজ্যের ক্ষেত্রে শুভ হয়নি । পশ্চিমদিকে যেমন রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে, পূর্বদিকে তেমনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যগুলির সঙ্গে এসময় দক্ষিণ ভারতের ঘনিষ্ঠ বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল । এবং এই বানিজ্যিক সম্পর্ক দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে সাহায্য করেছিল ।