Or
মগধের উত্থানের আর্থ-সামাজিক কারণ ব্যাখ্যা করো ।
খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকের মধ্যেই আর্যাবর্তের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু পাঞ্জাব থেকে সরে এসে গাঙ্গেয় উপত্যকায় পৌঁছায় । ঘনবসতি, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্য, যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা থাকায় এই অঞ্চলেই গড়ে ওঠে ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম সাম্রাজ্য। অঙ্গুত্তর নিকয়, দীপবংশ, মহাবংশ প্রভৃতি বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র, জৈন ভগবতী সূত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, গ্রিক লেখকদের বিবরণ এবং শিলালিপির সাক্ষ্য পাওয়া যায় এ সম্পর্কে । গৌতমবুদ্ধের আবির্ভাবের কিছু আগে থেকেই এই অঞ্চলে ষোড়শ মহাজন পদগুলির বিস্তার ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গিয়েছিল। ষোড়শ মহাজনপদগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চারটি ছিল মগধ, কোশল, বহুস এবং অবন্তী । বলাবাহুল্য বিশেষ কতকগুলি সুবিধা ও সৌভাগ্য মাধকে প্রাধান্য বিস্তারে সাহায্য করেছিল।
মগধের এই সাফল্যের পিছনে ব্যক্তি তথা রাজতন্ত্রের ভূমিকা নেহাত কম ছিল না। প্রাচীনযুগে স্বৈরা চারী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান, শাসকের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, শাসকের ব্যক্তিগত গুণাবলীর উপর নির্ভর করত রাজ্যের উত্থান, শ্রীবৃদ্ধি অথবা অবক্ষয়ের কারণে পরিণত হত। মগধের সৌভাগ্য যে বিম্বিসার, অজাতশত্রু, মহাপদ্ম নন্দ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং অশোকের মত শাসক পেয়েছিল আর নেপথ্য নায়কের ভূমিকা নিয়েছিলেন কূটনীতিজ্ঞ বসসাকর এবং কৌটিল্য।
দ্বিতীয়ত,সুশাসক ছাড়াও মগধের ভৌগোলিক এবং অর্থিসামাজিক বৈশিষ্ট্য তার সাফল্যের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল । ঘন বসতিপূর্ণ এই রাজা ছিল প্রাকৃতিক দিক থেকে সুরক্ষিত রাজধানী রাজগৃহ, পঞ্চপৰ্বত বেষ্টিত । নদীমাতৃক এই অঞ্চল পলি মাটির প্রসারে ছিল উনরা। হিরণ্যবাহ সোন নদী মগধের সম্পদ বৃদ্ধির একটা প্রধান কারন হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে রাজধানী পাটলিপুত্র শুধু সুরক্ষিতই ছিল না গঙ্গা ও তার দুই শাখা নদী – সোন ও গভক উত্তর ভারতের সঙ্গে ও সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ সহজ করে দিয়েছিল। । এই অরণ্য থেকে পাওয়া হস্তীগুলি মগধের পক্ষে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছিল। মগধের শক্তির প্রধান উৎস ছিল লোহা ও তামার খনিগুলি আর এই ধাতু দুটিতে ধলভূম ও সিংভূম জেলা দুটি ছিল অতি সমৃদ্ধ । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, রাজকৌম খনির উপর নির্ভর করে এবং সেনাবাহিনী রাজকোষের উপর । খনি হচ্ছে যুদ্ধের দ্রব্যের বর্ভাশয়।
তৃতীয়ত, মগষকে অপরিমিত ঐশ্বর্য্যের অধিকারী দিয়েছিল তার অন্তর ও বহিবানিজ্য । মগধের উত্তরে ছিল গঙ্গা, পূর্বে চতপা এবং পশ্চিমে সোন । ঐ যুগে বানিজ্যপণ্য আমদানী-রপ্তানির জন্য এই নদী পথগুলির ব্যবহার ছিল অতিসুবিধাজনক । তাছাড়া উড়িষা থেকে উত্তর ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত স্থলবানিজ্য পথটিও মনুষের মধ্যদিয়ে প্রসারিত হওয়ায় অর্ন্তদেশীয় বানিজ্যে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মগধের শ্রেষ্ঠীরা (বণিকরা) বানিজ্যের সম্প্রসারণ, বানিজ্যপথের নিরাপত্তা, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং বিস্তৃত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সমর্থক হয়ে উঠেছিল । বলাবাহুল্য যে, মগধ শাসকের সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতির পিছনে এদের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল।
ইতিমধ্যেই জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের অভিযাতে এই এলাকার সমাজ ব্যবস্থারও রুপান্তর ঘটে জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা কমে যাওয়ায় সমাজ জীবন সহজ সরল হয়ে ওঠে। তেমনই গোষ্ঠী বা উপজাতি অনুশাসনমুক্ত হয়ে এক স্বাধীন কৃষিজীবি সম্প্রদায়েরও উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তাদের কৃষি উৎপাদনে স্বাধীনতা ও আগ্রহ ছিল অনেক বেশী। উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনের এই অনুকূল পরিবেশ রক্ষার জন্য কৃষকরাও শক্তিশালী রাজতন্ত্রের সমর্থক হয়ে ওঠে।
মগধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিতে যে আর্থ সামাজিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল তার জন্যই দরকার ছিল শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা। পরাক্রান্ত রাজতন্ত্রের মাধ্যমেই আঞ্চলিক ও বিভিন্ন উপজাতিগুলির মধ্যে বিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাকে দূর করা গিয়েছিল । শাসক নির্বাচনে গোষ্ঠীপতিদের ভূমিকা শেষ হয়ে যায় । ব্যবসা বানিজ্যে সফল শ্রেষ্ঠী সম্প্রদায় হয়ে ওঠে মগধের সাম্রাজ্যিক নীতির উগ্রসমর্থক ।
বণিক শ্রেণীর সক্রিয় সহায়তা পাওয়ায় মগধ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুদ হয়ে ওঠে । স্বাভাবিক কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য মগধ শাসকেরও সজাগ দৃষ্টি ছিল। পরিবহন ব্যবসথার বিকাশ বনজ-কৃষিজ-খনিজ সম্পদবৃদ্ধি শাসকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত। অস্ত্র এবং পোতনির্মান শিল্প ছিল সম্পূর্ণভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত । এই অর্থনৈতিক কর্মােদ্যোগ পরিচালনার জন্য মগধে ছিল ত্রিশটির বেশী দপ্তর অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগ, শিল্প সংঘ (গিল্ড) এবং ব্যবসা বানিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় ।
মগধের এই উদার ও বলিষ্ট পরিবেশে একদিকে যেমন গৌতমবুদ্ধের আবির্ভাব ও পরিণতিতে সাহায্য করেছিল তেমনই শাসকদের সামরিক তৎপরতাও দেখা গিয়েছিল। ব্রাহ্মন্য ধর্মের সামাজিক বিধি নিষেধের বন্ধনহীনতা, জৈন ও বৌদ্ধধর্মের সর্বজনীন আবেদন মগধের অধিবাসীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রসারিত করেছিল । মগধ পরিণত হয় একটি বড় সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে।
মগধের শাসকরা সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর আনুকুল্য পেয়ে রাজচক্রবর্তী হওয়ার উচ্চাশা প্রসন করত । বলাবাহুল্য বিম্বিসার ও তার উত্তরসুরীরা এই সুযোগের পূর্ণ সৎব্যবহার করেছিলেন । এবং তাদের সাফল্যের জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল এদেশের প্রথম ঐক্যবদ্ধ এক সুবিশাল সাম্রাজ্য ।