ইতিহাসের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক ।
অর্থনীতির ইংরেজি হলো Economics এই ইকোনোমিকস শব্দটি গ্রিক শব্দ Oikonomia থেকে উৎপত্তিলাভ করেছে। যার অর্থ গৃহস্থালী ব্যবস্থাপনা।
অর্থনীতি হল সমাজবিজ্ঞানের সেই বিষয় যা উৎপাদন ব্যবস্থা ও তার বন্টন, পণের যোগান ও চাহিদা, ভোগ, উপার্জন, আয়-বায়া ইতাদি নিয়ে আলোচনা করে যা ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র পরিসরে কি বৃহত্তর সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পরিসরে তুমি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ ইত্যাদি সব বিষয়ই অর্থনীতির আলোচনার বিষষবস্তু।
সহজেই বোঝা যায় যে উপরো এই বিষয়গুলি ইতিহাসেও আলোচিত হয়, যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ পরিমাণেই আলোচিত হয়। অন্যভাবে বললে যে ইতিহাস আমরা পড়ি তার অনেকটাই অতীত মানুষের অর্থনৈতিক ইতিহাস।
ইতিহাসচর্চায় অর্থনীতির প্রভাব বৃদ্ধি পায় কনফারনেট, কোমটে, বাকলে, মার্কস ও বিউরির মতো পন্ডিতদের আবির্ভাবের পরে। বিশেষত কার্ল মার্কসের অশ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্ব বা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার পর থেকে ইতিহাসচর্চার কার্যত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শাখা হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক ইতিহাস।
হেগের মত মার্কস মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে মাকসের মতে হেগেন প্রদত্ত মন বা মদন নয়, মানব সমাজের মুক্তির পথে সব থেকে বড় অন্তরায় হল তার আর্থ সামাজিক অবস্থা। মার্কসের মতে ইতিহাস হল মানবসমাজের লক্ষ্য পূরণে কাহিনী।
A Critique of Political Economy তে মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) বা ইতিহাসের বস্তুবাদী বাখাকে (materialist conception of history) উপস্থাপিত করলেন ।এবং বললেন মানবাজের বিবর্তনে মানুষ কয়েকটি বিশেষ পর্যায়াকে অতিক্রম করেছে প্রত্যেকটি পর্যায়কে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে সেই সময়ের উৎপাদন ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক শ্রেণীবিভাজন প্রথমে আদিম সামানাদী সমাজে উপজাতী ভিত্তিক ব্যবস্থায় শ্রেণীবৈষমা প্রধান্য পায়নি।
প্রাচীন উৎপাদনব্যবস্থায় সমাজে প্রভু ও দাস বা ভূতা, তারপর সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থায় সামন্তপ্রভু ও সার্চ য ভূমিদাস এবং শেষে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মালিক ও শ্রমিক/ কৃষিশ্রমিকের মধ্যে শ্রেণীর্থের দ্বন্দ্ব বা সংঘাত বিরক্ত করেছে।
The Communist Manifesto এ মার্কস ভবিষ্যতদ্রষ্টা রূপে বলেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিনে শ্রমিক কৃষক নিয়ে গঠিত সর্বহারা বা প্রোলেতারিয়েতদের দ্বারা সংগঠিত সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যার পর পোলেতারিয়েতদের একনায়কতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র এবং কালক্রমে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে যা সকল মানুষের হিতার্থে পরিচালিত হবে। মার্কসের ইতিহাসদর্শন প্রকাশিত হবার পর থেকেই ইতিহাসচর্চায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় ইতিহাসে জনসাধারণ ও গরিব মানুষ অনেক বেশি উন্মোচিত হতে থাকে।
এই ব্যাখ্যার পর থেকেই অনেকঐতিহাসিকই ইতিহাস রচনায় অর্থনীতি এবং শ্রেণীশোদনকেই প্রাধানা দিতে শুরু করেন এবং ইতিহাস অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আলোকে বিশ্লেষিত হতে থাকে। ক্রিস্টোফার হিল, পল সুইজি, রডনি হিলটন, ই.পি থম্পসন, এরিক হবসবম, কস্সোনস্কি প্রমুখ বিদেশি ঐতিহাসিক, এবং রোমিলা খাপাব, দামোদর ধর্মীনন্দ কোগাছী, রামশরণ শৰ্মা, ইরফান হাবিব, বিপান চন্দ্র, রজনিগাম দত্ত, সুমিত সরকার প্রমুখ ভারতীয় ঐতিহাসিক মার্কসীয় তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইতিহাসচর্চা করতে থাকেন যেখানে অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক শোষণ ইত্যাদি বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করা হয়।
তবে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের বাইরেও অর্থনৈতিক ইতিহাসচর্চাও বজায় থাকে। উদাহরণ স্বরূপ কবীর চক্রবর্তী, ব্রজলুলার চট্টোপাধ্যায়, চম্পকলমী, অশীন দাসগুপ্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকের নাম করা যায় যাদের গবেষণাধর্মী কাজ ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসচর্চাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। অর্থনৈতিক ইতিহাসের চর্চায় রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ বা Cliometrics এর আবির্ভাব ঘটছে যার ফলে Quantified History বা সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে ইতিহাসচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
জ্ঞানচর্চার যে শাখা রাষ্ট্রনীতি, সরকারের গঠন ও রূপ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করে থাকে তাকে।
সর্বোপরি বলা যায় ইতিহাসের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িত।