সুফিবাদ । সুফিবাদের প্রভাব।
খ্রিস্টীয় দশম শতকে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রাধান্যের পরিবর্তে তুর্কিদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়। এই সময়ে ই চিন্তা ও আধুনিক ধ্যান ধারণার মধ্যে নতুন অনুপ্রেরণার আবির্ভাব ঘটে যার ফলে সুফি মতবাদ এর সূত্রপাত এবং অতীন্দ্রিয় বাদের উদ্ভব হয়। চিন্তার জগতে এর ফলে যুক্তিভিত্তিক দর্শন (মুতাজিলা) এর অবসান ঘটেছিল এবং কোরান ও হাদিসের আস্তাভাজন অতীন্দ্রিয়বাদ রক্ষণশীল ঐসলামিক মতবাদের এবং সুফি মতবাদ এর উত্থান ঘটেছিল।
ঐসলামিক অতীন্দ্রিয়বাদী রাই পরবর্তীকালে সুফি বলে অভিহিত হয়। অনেকের মতে সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে সম্পদের প্রাচুর্য এবং তাঁরই পরিণতিতে নৈতিক অবক্ষয় কি যেসব আধ্যাত্মবাদী সুনজরে দেখেন নি তারা সুফি অতীন্দ্রিয়বাদ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ডাক্তার ইউসুফ হোসেনের মতে সুফিবাদের জন্ম ইসলামের মধ্য থেকেই হয়েছিল। কিন্তু ডক্টর এ এল শ্রীবাস্তবের মতে হিন্দুস্থানী সুফি মতবাদ হিন্দু ধ্যান-ধারণা বিশ্বাস এবং আচার ও প্রথার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আত্মার এবং পরমাত্মার সম্পর্কের সঙ্গে ঈশ্বর প্রেম অহিংসা এবং শান্তিপূর্ণ জীবন যাত্রা যে ধারা তা হিন্দুদের থেকেই তারা গ্রহণ করেছিল।
কোন ধর্ম গুরু ধর্ম প্রবর্তকের অথবা ধর্মীয় শাস্তের উপর তারা নির্ভর করেনি। রক্ষণশীল ইসলাম নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানে এদের কোনো আস্থা ছিল না। মোহাম্মদ এবং কুরানের শিক্ষা গ্রহণ করলেও ক্রমে খ্রিস্টীয় জরথুস্ত্রীয় বৌধ এবং হিন্দু বেদান্ত ও যোগশাস্ত্র শিক্ষায় নিজেদের লালিত করেন। কঠিন কৃচ্ছতা সাধন এবং তপশ্চযার মারফতে সিদ্ধি লাভ করতে চেয়েছিলেন। উলেমা নিষিদ্ধ নৃত্যগীতের মাধ্যমে তারা ভাব বিভোর হয়ে থাকতেন। এরা সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে দারিদ্র্যের প্রতীক হিসেবে ধারণ করতেন সুফি(মোটা পশমের পোশাক) তা থেকেই তারা সুখী হিসেবে পরিচিত হন।
একাদশ ও দ্বাদশ শতকে লাহোর ও মুলতানে ভারতবর্ষের বাইরে থেকে বহু সুফি এসেছিলেন। এরমধ্যে সুখেতো ছিলেন মারামারি মখদুম সৈয়দ আলী অল হুজরী, লাহোর ই ছিল তার সাধন ক্ষেত্র। 1161 সালে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী পৃথ্বীরাজের রাজত্বকালে তিনি আজমিরে বসবাস করে এবং সেখানে তারা দেহাবসান হয় 1235/36 শালী। তিনি ই ভারতবর্ষের চিশতী সিলসিলার প্রবর্তক। খিস্তির দুই প্রধান শিষ্যের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী এবং অপরজন ছিলেন শেখ হামিদ উদ্দিন। শেখ ফরিদ উদ্দিন এর প্রধান শিষ্য ছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া। মুক্তমনা এই সুফী সাধকের শিষ্য ছিলেন বিখ্যাত কবি আমির খসরু এবং ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনী।
আবুল ফজলের মতে হিন্দুস্থানী 14 টি সুফি সিলসিলা ছিল। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চিশতিয়া, সূরাবদিয়া , নাখবন্দিয়া , কাদিরিয়া, ফিরদৌসী প্রভৃতি। শেখ বহাউদ্দিন ডাকরিয়ার শিষ্যরা নিজেদের শুরাবদি বলে পরিচয় দেন।চতুর্দশ শতকের সুফীদের প্রভাব কিছুটা স্থিমিত হয়ে আসে । এজন্য দায়ী ছিল তাদের ধর্মীয়তত্ত্ব শতকে মত পার্থক্য এবং মহম্মদ বিন তুঘলক এবং ফিরোজ তুঘলকের বিরোধিতা । পরের শতকে নতুন দুই সুফী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে । শেখ আব্দুল্লা সাত্তরি প্রতিষ্ঠা করেন সাত্তারিয়া এবং সৈয়দ ঘাউসওয়ালা পীড়ের অনুগামীরা পরিচিত হন কাদিরিয়া নামে । বলাবাহুল্য যে, আকবরের আমল শুরু সৈয়দ হওয়ার আগে ভারতে সুফীবাদের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল ।
হিন্দুযোগী ও সন্তদের সঙ্গে নিবীড় পরিচয়ের ফলে সুফীদের সর্বেশ্বরবাদ সম্পর্কিত ধারনা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে । বহু ভারতীয় সুফী সংস্কৃত এবং হিন্দী ধর্মীয় সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন আর তারই ফলে মালিক মহম্মদ জয়সির মতো সুফী হিন্দীতে তার গ্রন্থাবলী রচনা করেন । হিন্দী ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় রচিত বৈষ্ণব সন্তদের ভজনগুলি সুফীদের কাছে পারসিক কবিতার চেয়ে অনেকবেশী আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল । একারণেই হয়তো বিখ্যাত সুফী আব্দুল ওয়াহিদ বিলগ্রামী তার হাকয়িক-ই-হিন্দ নামক পুস্তিকায় কৃষ্ণ, মুরলী, গোপী, রাধা, যমুনা ইত্যাদি শব্দ সুফী মরমিয়া ভাষার সাহায্যে ব্যাখা করার চেষ্টা করেছিলেন ।
সুফী সম্প্রদায় ছিল দ্বিধাবিভক্ত একদল ছিল বা-সরা অর্থাৎ যারা ইসলামীয় আইন কানুন বা শরিয়ৎ মেনে চলতেন এবং অপরদল ছিলেন বে-সরা যারা শরিয়তের দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন না । এই দ্বিতীয়দলভুক্ত ছিলেন দরবেশরা । এরা কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন নি । তবুও তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়েরই শ্রদ্ধেয় পাত্র ছিলেন ।
সুফীরা নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষে ইসলামধর্মের অন্তসারকে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন । একই সঙ্গে তারা নিজেদের ধ্যানধারনাগুলি ভক্তিবাদের সঙ্গে সমন্বয়িত করে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের আধাত্মসাধনাকে একটা ঐক্যসূত্রে বাঁধতে পেরেছিলেন । সুফীদের আড়ম্বরহীন সন্ন্যাসীসুলভ জীবনযাত্রা, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সমাদর করে কাছে টেনে নেওয়া এবং তাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে সামাজিক মর্যাদা ভূষিত করে দেওয়ার ফলে এদেশে ইসলাম ভক্তের সংখ্যাবৃদ্ধি করেছিল বলে অনেকে মনে করেন কিন্তু প্রকৃত তথ্য এই যে, গোড়া মুসলিমরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সুফীভাবাদর্শের প্রতি আকর্ষিত হয়নি ।
নিজামউদ্দিন আউলিয়াও এবিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন যে, কোনো অবস্থাতেই হিন্দুরা ধর্মত্যাগ করতে রাজী নয় । সুফীরাও ধর্মান্তরিত করার দিকে নজর দেননি । ধর্মাচরণকে উদার ও সহিষ্ণু করে তোলাই ছিল সুফীদের আদর্শ। সুফীরা সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি । ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশে এটাই ছিল তাদের মহত্তম অবদান ।