ক্লুনি মঠের সংস্কার আন্দোলনের কারণ । চার্চ ব্যবস্থার ওপর এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব।
খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে যে শুদ্ধ ও সংযত জীবনের আদর্শ বেনেডিক্টীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল নবম শতাব্দীর শেষ হবার আগেই তা বহু অঞ্চলে ম্লান হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বর্বর আক্রমণের অধ্যায় শেষ হয়ে যাওয়া পশ্চিম ইউরোপের সমাজে স্থিতিশীলতা দেখা গিয়েছিল। মহৎ কোন পেয়ো না বা অনুসরণযোগ্য কোন আদর্শের জন্য গৃহী যাজক নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই একটা আগ্রহ জন্মে ছিল। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষভাবে মর্ঠবাসী সন্ন্যাসী দের মধ্যে শুদ্ধিকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
সমাজের সর্বস্তরে পরিব্যপ্ত নৈরাজ্য ও শ্রমিকদের জীবন কেউ স্পর্শ করেছিল। শুদ্ধাচার ও নিয়ম-শৃঙ্খলা অস্পষ্ট হতে থাকে। সেকুলার চার্জের মত মঠগুলিতেও সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সামন্ত প্রভুরা মডু গুলিকে তাদের অন্যান্য বিষয় সম্পত্তি বলে ভাবতে থাকে। এই অধঃপতনের বিরুদ্ধে জগতের সর্বত্র প্রতিবাদ শুরু হয়। মাঠ গুলিকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই সংস্কার আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্ম সংস্কারকদের সহায়তা করেছিলেন প্রভাবশালী বহু মানুষ।
পশ্চিম ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে বিধ্বস্ত, নিঃশেষিত মত গুলির মধ্যে প্রেরনা ও নতুন মঠ প্রতিষ্ঠার যেঔ শুভ প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছিল তার উৎস ছিল তিনটি না নামুর কাছে ব্রইন, মেজ সন্নিকটে গজ এবং সর্ব অগ্রগণ্য বাগান্ডির ক্লুনের মঠ । দশম শতকের আশ্রমিকরা opus Dei র ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই প্রার্থনা ধ্যান সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন এর ক্লুনির আশ্রমিকদের প্রচেষ্টা ছিল অক্লান্ত। ক্লুনি আবির সৃষ্টি করেছিল 910 খ্রিস্টাব্দে অ্যাকুতার ধর্মপ্রাণ ডিউক ওলিয়ামের বদান্যতায়। বেনেডিক্ট এর আদর্শে বিশ্বাসী পরম শ্রদ্ধেয় সেন্ট বানো ছিলেন এই মঠের প্রথম অ্যাবট। ক্লুনির স্থাপয়িতার উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা যেখানে বেনেডিক্টের বিধান অনুসারে সন্ন্যাসীরা আধ্যাত্ব সাধনা করবেন এবং যা হবে সর্ব প্রকার লৌকিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত। আরশ্রমিকরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজেদের অ্যাবট নির্বাচন করতেন এবং স্থানীয় বিশপ বা দেশের শাসকবৃন্দের প্রভাব বিস্তারের সামান্যতম সুযগও ছিলনা ।
তাই ক্লুনি স্বাভাবিক ছন্দে বিকশিত হতে পেরেছিল, মুক্তি তাকে বেগ সঞ্চারিত করে দেয়। পরিবেশের এই আনুকূল্য ছাড়াও ক্লুনির অসামান্য খ্যাতির মূলে ছিল শুরুর দিকের কয়েকজন অ্যাবট কুশলী নেতৃত্ব। সুযোগ্য দক্ষ পাঁচজন পুন্যাত্মাদের অধীনে অতিবাহিত হয়েছিল। ক্লুনির জীবনের প্রথম 148 বছর যার মধ্যে সুখ্যাত ছিলেন অডো , মায়োলাস, এবং ওডিলো । তাছাড়া অ্যাকুতার ডিউক ক্লুনির মঠকে যে সর্ববিষয়ে শুধু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তাই নয়, সেই স্বাধীনতা নাশে কেউ উদ্যত হলে তিনি যে অভিশপ্ত হবেন তা জানাতে তিনি দ্বিধা করেননি। ক্লুনির এই বিশেষ অধিকার একাদশ দ্বাদশ শতকে বহু মঠ কে বিশপের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি অর্জনের উৎসাহিত করেছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণে বার্গান্ডি অ্যাঁকুতার শাসকের হস্তচ্যুত হাওয়ায় ক্লুনির স্বেচ্ছাকৃত পথে চলতে সামান্যতম বাধা টুকুও সরে যায়।
বেনেডিক্ট সম্প্রদায় ভুক্তদের দৈনন্দিন জীবনে গৃহী ভক্তদের যে ভূমিকা ছিল এবং মঠের সন্নিহিত ক্ষেত-খামার গুলিতে শ্রমিকদের দৈহিক শ্রমদানের যে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল, ক্লুনির আবাসিকদের জীবনে তার পুনরাবির্ভাব ঘটেনি। প্রথম থেকেই ক্লুনি ছিল খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল প্রত্যাহিক জীবনে প্রার্থনাও ঈশ্বর আধারনাই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছিল। সন্ন্যাসীর পবিত্রজীবনে উৎসর্গীকৃত বালকদের ধর্ম শিক্ষা দানই ক্লুনির মঠ বাসিদের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্ত মূর্খতার ছিল ক্লুনির আশ্রমিকদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
বিষয়াসক্ত মানুষের মধ্যে অথবা আদর্শচ্যুত মঠবাসিদের ঈশ্বরের প্রেমে উদ্ধুদ্ধ করে ক্লনি যুগের একটি প্রয়োজন সিদ্ধ করেছিল। প্রথম থেকেই ধর্মযাজক শ্রেণীর প্রতি উদাসীন এর জন্য প্রতিপত্তির শিখরে পৌঁছে ও ক্লুনি একাদশ শতকে পোপ ও সম্রাটের দীর্ঘ ও তিক্ত দ্বন্ধে সামান্য উৎসাহ ও দেখায়নি। পার্থিব শক্তি অর্জনের তার সামান্যতম আগ্রহ ও ছিল না। পারলে আর ইনভেস্টিচার দ্বন্ধে অংশগ্রহণ ছিল ক্লুনির প্রতিটি আশ্রমিকদের আদর্শ বিরোধী।
প্রভাব:
প্রত্যক্ষভাবে না হলেও সমাজের বহু স্তরে ক্লুনির প্রভাব পড়েছিল । দ্বাদশ শতাব্দীতে তা মধ্যযুগের বৃহত্তম মঠের পরিণত হয়েছিল। প্রথম অধ্যক্ষ বনোর সময় থেকেই অন্যান্য বহু মঠের অধ্যক্ষ বা পৃষ্ঠপোষক তাদের প্রতিষ্ঠান সংস্কার বা অন্য কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য ক্লুনির শরণাপন্ন হতেন। সংকটে ত্রাতা হিসেবে কখনো অনুরুদ্ধ হয়ে কখনো বা অন্তরের তাগিদে অ্যাবটসেন্ট অডোকে দেখা গিয়েছিল বারংবার ফ্রান্স ও ইতালির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছে যেতে। তার এই অসামান্য সাফল্যের একটি কারণ ছিল যে তিনি বহু ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী ভূস্বামীদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলাম। তার গুনমুগ্ধ অন্যান্য মঠের পৃষ্ঠপোষকরা তার উপর ই অর্পণ করতেন মঠগুলির সংস্কারের দায়িত্ব।
শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে 1450 টি মঠ নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্লুনির সুবিশাল এক পরিবার। আশ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের প্রায়বদের নির্বাচন ছবি পরিচালিত হতো ক্লুনির অ্যাবটের নির্দেশে। বেনেডিক্ট সম্প্রদায়ভুক্ত দের স্ব-শাসিত এবং অপেক্ষাকৃত পরিচিত মঠগুলির পাশে এভাবেই একটি এককেন্দ্রিক সুবিশাল সন্ন্যাসী সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগীয় সমাজের ওপর যার প্রভাব ছিল সুগভীর।
তাছাড়া উপাসনা পদ্ধতি সুষ্ঠু রূপদানে ধর্ম শাস্ত্রের অনুশীলন এবং শিল্প স্থাপত্য কে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মহিমা বৃদ্ধির কাজে নিয়োগ করার ব্যাপারে ক্লুনি অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে ও ক্লুনির প্রার্থনা উপাসনা পদ্ধতি র প্রতি সুগভীর আকর্ষণ ছিল । খ্রিস্টান জগতের মঠ গুলির সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্লুনির সন্ন্যাসীরা অভিনবত্বের পরিবর্তে প্রাচীন ও সম্মানিত বেনেডিক্টিয় বিধানের উপর ই বেশি গুরুত্ব দিতেন। খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের ব্রহ্মচর্য পালন সম্পর্কিত যাজকীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ যাজকদের নির্বাচন এবং মঠের হৃত ভূসম্পত্তি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে তাদের মনোভাব ছিল অনমনীয়। অ্যাবট ওডিলো হিউ এর সময় থেকেই ক্লুনি স্বীয় অধীনস্থ মঠগুলিকে একটি স্থায়ী শৃংখলায় আবদ্ধ করেছিল।
একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ক্লনি নিয়ন্ত্রিত মাঠের মধ্যে 100 টি ছিল ব্রিটেনের স্পেন ইতালিতে আর শুধু ফ্রান্স ও বাগান্ডিতে ছিল আটশর বেশি । পপ তন্ত্রের অস্তিত্ব সত্বে খ্রিস্টান জগতের আত্মজীবনীর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল বার্গান্ডির এই আশ্রম। মধ্যযুগীয় সমাজে গৃহযুদ্ধ আঞ্চলিক সংঘর্ষের তিত্ততা বিভীষিকা হ্রাস করার জন্য উদ্যোগ ও অবিস্মরণীয়। 989 খ্রিস্টাব্দ বার্গান্ডি এক সম্মেলনে ঘোষিত হয় যে শিল্প বেকন বা সাধারণ যাজকের স্বদেশে বা বিদেশে অবস্থানকালে ক্ষতি সাধনের চেষ্টা র সমাজচ্যুত ।
তবে যে বৈভব ও ঐশ্বর্য ক্লুনির আধ্যাত্বসাধনা সঙ্গে অচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল ক্রমশ তাই তাকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন করে দিয়েছিল। আশ্রমের সৌন্দর্য আরম্ভর ও আতিশয্য কে অনেক কৃচ্ছতা সাধনের বিরোধী বলে মনে করেন। ক্লুনি মঠ দৃষ্টি নন্দন ছিল সন্দেহ নেই কিন্তু এই ঐশ্বর্য্যের আতিশয্য ভক্তের আত্মনিবেদনের পথ রোধ করে দাঁড়ায় বলে সেন্ট বার্নার্ড সমালোচনা করেছিলেন। তাছাড়া ক্লুনি নির্দেশিত ও পরিচালিত মঠ গুলিতে কোন সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিদর্শক পাঠানোর প্রথা যোগাযোগের ব্যবস্থা দরুন বিঘ্নিত হত।
10 বছরেও বেশি কাল অ্যাবট পদ মন্দবুদ্ধি পন্টিয়াস প্রতিষ্ঠানটির অধঃপতনের পথ প্রশস্ত করে দেন। অসংখ্য মঠের বহুবিধ দায়িত্ব পালনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ক্ষেত-খামারের খাদ্যশস্য উৎপাদন, সাফ নিয়ন্ত্রিত ও নানাবিধ সামন্ততান্ত্রিক কর্তব্য পালনের গুরুভার । ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রকার লৌকিক কর্তৃত্ব মুক্ত করার ব্রত নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল দ্বাদশ শতকে তার আদর্শচ্যুতি ঘাটে, মঠ জীবনবাদ কে ভিন্ন পথে মুক্তি লাভের সচেষ্ট হতে দেখা গিয়েছিল,
ক্লুনি নিয়ন্ত্রিত মঠজিবন বাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে পোপ তন্ত্রের নেতৃত্বাধীন সংস্কার আন্দোলনের সম্পর্ক মধ্যযুগের ইতিহাসের অতীবিতর্কিত একটি বিষয়। একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই পোপ তন্ত্র সমস্ত খ্রিস্টান জগতে চার্চের সাংগঠনিক সংস্কারের ব্রতী হয় এবং পভ সপ্তম গ্ৰেগরির সময় তা পরিপূর্ণতা পায়। তাসত্ত্বেও টমসন জনসন ঐতিহাসিকদের মতে ক্লুনির আন্দলন শুধুমাত্র মঠবাসী সন্ন্যাসীদের জীবনই স্পর্শ করেনি তার মধ্যে প্রচণ্ড ও ব্যাপকতর আন্দোলনের অফুরন্ত রসদ ও ছিল । ‘সিমনি’র বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সেকুলার ক্লাজি কে ব্রহ্মচর্যের ব্রত পালনে আহ্বান করে সাধারণভাবে যাজক সম্প্রদায়ের নৈতিক মানোন্নয়নে প্রয়াসী হয়েছিল ক্লনি ।
ক্লুনির অসাধারণ সাংগঠনিক সংহতি কেন্দ্র নির্ভর প্রশাসনিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী পোপদেরও অভিভূত করেছিল ক্লুনির হয়ে উঠেছিল তাদের আদর্শ। ক্লুনির আন্দোলন যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই সপ্তম গ্রেগরি শুরু করেছিলেন।