নারীদের অধিকার রক্ষায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ভূমিকা
প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই জাতিপুঞ্জো যেমন মানব অধিকার গুলিকে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে এবং সেগুলির সুরক্ষায় যথাযথ নির্দেশিকা দিয়েছে তেমনি সমগ্র বিশ্বজুড়ে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করা এবং নারীদের জন্য সম-অধিকার নিশ্চিত করতেও ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।1945 খ্রিস্টাব্দে গৃহীত জাতিপুঞ্জের সনদ এই প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে,”পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের মর্যাদা ও গুরুত্ব-কে যেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয় হয়েছে তেমনই পুরুষ ও নারীদের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।”সনদের প্রথম ধারায় সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য কে পুনরায় বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে যে জাতিসংঘের অন্যতম ভূমিকা হল -বিশ্বজুড়ে মানব অধিকার গুলিকে এবং মানুষের স্বাধীন সত্তাকে যাতে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়, সেই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা ও প্রচার চালানো এবং এই অধিকার রক্ষার প্রশ্নে জাতিপুঞ্জো জাতি লিঙ্গ ভাষা ও ধর্ম নির্বিশেষে কোনরূপ ভেদাভেদ করবে না।
1948 খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জো যখন সার্বজনীন মানব অধিকারের ঘোষণা বা ”universal declaration of human rights” প্রণয়ন করে তখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকারের কথা বলা হয়। এই ঘোষনা পত্রের খসড়া যখন তৈরি করা হচ্ছিল তখন সেখানে “all men” এই শব্দটির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয় এবং এরুপ লিঙ্গবৈষম্য প্রকাশকারী শব্দগুচ্ছের পরিবর্তে লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দগুচ্ছ হিসেবে “all human being” এবং “everyone” শব্দগুলি ব্যবহার করা হয় যাতে করে লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান অধিকার প্রদানের প্রশ্নে জাতিপুঞ্জের নিরপেক্ষ অবস্থান স্পষ্ট করা যায়।
1948 খ্রিস্টাব্দের 10 ডিসেম্বার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নগরীতে অনুষ্ঠিত সভায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা 217a3 নম্বর অনুচ্ছেদে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ”Udhr” লিপিবদ্ধ করেন। সাধারণ সভা এর মাধ্যমে ঘোষনা করে যে বিশ্বজুড়ে সকল মানুষের জন্য এই udhr মানব অধিকার রক্ষার একটি সার্বজনীন এবং সরবরাহ নির্দেশিকা রূপে চিহ্নিত হবে এবং সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তা অনুসরণ করবে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জো কর্তৃক গৃহীত udhr and international covenant on civil and political rights (iccpr) এবং international covenant on economic, social and cultural rights(icescr) একত্রিত করে তৈরি হয়েছে international bill of of human rights।মানব অধিকার সংক্রান্ত জাতিপুঞ্জের সকল চুক্তি ঘোষণা পত্র এবং এই international of human rights এর মধ্যে এমন কি ঘোষণাপত্র দলিল সংশোধনের মধ্যে দিয়েও শ্রী ও পুরুষের সমান অধিকারের আদর্শটি প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে।
international covenant on civil and political rights এবং international covenant on economic, social and cultural rights এর 2 নম্বর এবং তিন নম্বর ধারায় বলা হয়েছে যে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে লিঙ্গ ভিত্তিক কোনরূপ বৈষম্য রাখা যাবে না । এবং উভয়ের সমভাবে তাদের অধিকার গুলি কে ভোগ করতে পারবে ।
International covenant on civil এ যে সকল অধিকার গুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেগুলি হলো জীবনের অধিকার শোষিতও অত্যাচারিত না হওয়ার অধিকার দাসত্ব না করার অধিকার ও স্বাধীনতার অধিকার ও নিরাপত্তা রাধিকা অপরাধমূলক আইন এর সঙ্গে সম্পর্কিত অধিকার আইনের চোখে সবাই সমান অধিকার স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার স্বাধীনভাবে চিন্তা করা চেতনা ও ধরনের অধিকার সভা সংগঠনের অধিকার পরিবার ও সন্তানের সঙ্গে সম্পাদিত অধিকার নাগরিত্ব রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ধর্ম ও ভাষা রাখা করার অধিকার ।
international covenant on economic, social and cultural rights এর মধ্যে যে অধিকার গুলি কে চিহ্নিত ও সংরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল কর্মের অধিকার শ্রমিক বা পেশাদারী সংগঠন তৈরির অধিকার বিবাহ মাতৃত্ব ও সন্তানের প্রতিপালনে অধিকার যথোপযুক্ত জীবন ধারণের মান বজায় রাখার অধিকারও স্বাস্থ্য বজায় রাখা ও চিকিৎসা লাভের অধিকার শিক্ষার অধিকার ও সংস্কৃতি বিজ্ঞান এর সঙ্গে সম্পর্কিত অধিকারসমূহ বলাবাহুল্য উভয় চুক্তিতে শিক্ষিত ও উল্লেখিত অধিকার গুলি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক অনুসৃত এবং পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সম্ভব হবে এই অধিকার গুলি ভোগ করতে পারেন।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘UNO’ এর সদস্য গুলি ‘Declaration on the Elimination of Discrimination against Women’ গ্রহণ করে যেখানে বিশ্বজুড়ে সকল রাষ্ট্রে নারদের বিরুদ্ধে ঘটা বৈষম্যমূলক আনানকে তার মর্যাদা ও সম্মানের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয় । এবং রাষ্ট্রগুলিকে এরূণ বৈষম্য প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয় ঘোষনা বা চুক্তির এক বছরের মধ্যে ঠিক হয়। যে নারীদের অধিকার রক্ষামূলক আইনগুনিকে একত্রে গ্রন্থিত করে একটি সংকলিত আইন তৈরী করা হবে। পরে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে The Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women’ গৃহীত হয় যার প্রস্তাবনাতে বলা হয় যে আইন ও চুক্তিমূলক ঘোষণাগুলি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে নারীরা পুরুষদের সমান অধিকার ভোগ করতে পারছে না। এই কনভেনশানে লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষমাকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয় এবং লিঙ্গ বৈষম্য দুর করে লিঙ্গ ভিত্তিক সম মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির দায়িত্ব কর্তবকেও চিহ্নিত করা হয়। বলা হয় যে সদস্য রাষ্ট্রগুলি যে কেবল বৈষম্যমূলক আইনগুনিকে সংশোধন করবে তা নয়, তার সাথে প্রতি সামাজিক রীতিনীতি পরস্পরা ও আচরণগুলিকেও প্রতিরোধ করবে যার মাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিগতত্ত্বরে অধিকার ও মর্যাদা লঙ্ঘিত হচ্ছে বা হয়ে আসছে।
এরূপ নীতি নিয়ে ১6টি ধারায় সুস্পষ্টভাবে নারীদের অধিকার এবং তাকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রগুলির সুনির্দিষ্ট দায়িতগুলিকে ব্যাখ্যা করা হয়। নারীদের নাগরিক ও রাজনৈতিক এবং অন্যদিকে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলি যেমন, ভোট দানের অধিকার, রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের অধিকার, নাগরিকত্ব ত্যাগ বজায় রাখা ও গ্রহণের অধিকার আইনের চোখে সম অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, শিক্ষার্জনের অধিকার কর্মের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, আর্থিক ধন লাভের অধিকার ইত্যাদিতে উল্লেখিত করা হয়। এই কনভেনশনে গ্রামীন দরিদ্র নারীদের পাচার করা এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে বা কর্মক্ষেত্রে সংকটাপন্ন নারীদের অধিকার রক্ষার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়।
The Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women’ ধারায় লিঙ্গ বৈষমাকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে নারীদের অধিকার, মর্যাদা ও তাকে বাধা দানকারী যে কোনো রকমের উদ্দেশ্য বা কাজকেই বৈষম্যমূলক রূপে চিহ্নিত করা হবে। এখানে বলা হয়েছে, অর্থাৎ পরিষ্কার করে বলা হল যে তাদের বৈবাহিক স্বত্বা নির্বিশেষে নারীরা পুরুষদের সম মর্যাদা এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে এবং এই অধিকার মর্যাদা বা স্বাধীনতাকে বাধাদানকারী যে কোনরকনের বর্জনমূলক, পাথক্যমূলক ও সীমাবদ্ধতা প্রতিষ্ঠাকারী উদ্দেশ্যমূলক কাজকেই বৈষমা রূপে দেখা হবে যা নারীদের স্বীকৃতি বা অধিকারভোগের ক্ষেত্রটিকে সংকোচিত করে। এরপ বৈষম্যমূলক আচরণ রূপে পরিগণিত হবে এমন সব আচরণ যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নারীদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে থাকে, অথবা যে সমাজ বা সামাজিক আচরণসমূহ নারীদের ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় অধিকারকে লঙ্ঘন করে বা তাদের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বা স্বাধীনতাকে ।
সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে এরপ বৈষম্য দূর করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়। যেমন যথাযথ রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন করে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, নারীদের আইনী অধিকারগুলিকে বলবৎ করা যে কোন বৈষম্যমূলক আচরণ করা থেকে বিরত থাকা এবং কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন সংগঠনকেও এরূপ কাজ থেকে বিরত রাখা প্রচলিত বৈষম্যমূলক আইন ও পরস্পরাগতমানে চলে আসা সামাজিক বিধিগুলিকে বর্জন করা। রাষ্ট্রগুলিকে এক্ষেত্রে সমর্থক ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি কনভেশনে বলা হয় যে প্রয়োজনে লিঙ্গ বৈষমা দূর না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রগুলি সাময়িকভাবে কোন বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে যা নারীদের প্রতি বৈষম্যকে দূর করতে সক্ষম। এইভাবে এই কনভেনশান আনুষ্ঠানিক সাম্য স্থাপনের ধারণাকে অতিক্রম করে বাড়বে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে প্রকৃত সাম্য(equality of opportunity and equality of outcome) উপনীত হতে চেয়েছিল।
লিঙ্গবৈষম্যকে দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই কনভেনসান জাতিপুঞ্জের অন্যান্য যোগাতেও স্বতন্ত্র, অধিত্বব্যঞ্জক ও প্রকৃত কিছু বিধান দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। যেমন, ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল যে নারীদের আইনগত ক্ষেত্রে সাম্য এবং বাস্তবোচিত সাম্য (legal and de facto equality)প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রগুলি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যবাহী সেই সকল প্রথা বা পরম্পরাগুলিকে বর্জন বা পরিহার করবে যেগুলি নারীদের দমন করে রাখে এবং পাশপাশি এমন এক সামাজিক কাঠামো রচনাকরবে যা কিনা নারীদের মৌলিক অধিকারগুলি সম্পূর্ণভাবে ভোগ করার সুযোগ করে দেয়।
উপরোক্ত নারী বিষয়ক অঙ্গিকার বা ঘোষণাপত্র বা কনভেনশান ছাড়াও ‘UND’ কর্তৃক জারি করা আরও বেশ কয়েকটি কনভেনশানের সনদে বা অঙ্গীকারপত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নর ও বালিকাদের উপর হিংসাত্মক ঘটনা প্রতিরোধ নিয়মিতভাবে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। জাতিসংঘের সনদ এবং মানব অধিকারমূলক বিভিন্ন সম্মেলন এ গৃহীত অঙ্গিকারপত্রগুলী যাতে যথাযথভাবে প্রযুক্ত হয় সেই কারণে মহাদেশীয় বা আঞ্চলিক স্তরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় জোট বা সংগঠন নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য তাদের নিজ নিজ হাতিয়ার বা ‘ instrument” গড়ে তুলেছে। এরূপ কিছু হাতিয়ারমূলক সনদ charter/protocol’ এ তালিকা
নিম্নরূপ
1981 খ্রিস্টাব্দে Organization of African Unity’ কর্তৃক গৃহীত The Africal (Banjul) Charter on Human and Peoples Rights’ সনদের 2 নম্বর এবং 18 নম্বর ধারায় নারীদের প্রতি সকল রকমের বৈষম্য
দূরীকরণের কথা বলা হয়েছে এবং 2003 খ্রিস্টাব্দে এই সনদের অনুসরণে The Charter’s Protocol on the
Rights of Women in Africa (Maputo Protocol) গৃহীত হয়েছে।
একইভাবে Charter of the Organization of American Statest এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩ নম্বর ধারায় এবং American Convention on Human Rights এর 1 নম্বর ধারায় এবং ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত Inter American Convention on the Prevention, Punishment and Eradication of Vilence against Women (Beleda Para Convention) এ নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। ইওরোপ মহাদেশে The European Convention on Human Rights and Fundamental Freedoms 18 নম্বর ধারায় নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচান থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে এবং স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে উক্ত ধারায় উল্লেখিত সকল অধিকার নারীরা সমানভাবে ভোগ করতে পারবেন।
Council of Europe’ ২০১১ খ্রিস্টাব্দে Convention on preventing and combating violence against women and dometic violence (Istanbul Convention) গ্রহণ করে নারীদের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ব্রতী হন৷৷ উপরোভ আঞ্চলিক রাষ্ট্রজোটগুলি Association For South East Asian Nations, South Asian Association for Regional Cooperation Economic Community of West African States”,” Southern African Development Community নারী বৈষম্য রোধে বিভিন্ন চুক্তি বা ঘোষণা বা বিধান জারি করে করেছে যার মাধ্যমে নারীদের অধিকারগুলিকে সুরক্ষিত করা যায়।