StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

বিজ্ঞান চর্চায় বাঙালির অবদান ।

 

বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা ।                          

Or

বিজ্ঞান চর্চায় বাঙালির অবদান 




 আমাদের দেশে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশদের হাত ধরে। পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ফলে বাঙালি শিক্ষিত সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রসার লক্ষ্য করা যায়। রাজা রামমোহন রায় বিজ্ঞান অনুশীলনের পথ বাতলে তিনি এক নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিলেন।


 1823 সালে রাজা রামমোহন রায় লর্ড আমহার্স্ট কে একটি চিঠি লেখেন সেই চিঠিতে তিনি বলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব useful sciences নিয়ে চর্চা করে অন্যান্য দেশের থেকে এগিয়ে গেছে ভারতীয়দের ও সেই সব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কম্পানি কম্পানি বাহাদুর উদ্যোগ নিয়েছেন শুনে প্রথমতা তার খুব আনন্দ হয়েছিল । কিন্তু , তারপর জানা গিয়েছিল, যে গণিত, Natural philosophy, রসায়ন, এ্যানাটমী এইসব শেখানোর বদলে একটি সংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়লেন। কেননা এই শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই কারণ এই সমস্ত জ্ঞান 2 হাজার বছর আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। তখন আধুনিক ভারতের প্রয়োজন বেকনের দর্শনভিত্তিক বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা । 




  রামমোহনের পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির ওপর প্রথম সুস্পষ্ট ধারণা দেন ইশ্বরচন্দ্র। তিনি এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তন্ত্র রচনা করতে চাইলেন , তিনি বলেন -জীবন ও প্রকৃতিকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে দেখা এবং সত্যকে নিমোহচিত্তে গ্রহণ করা, শাস্ত্রের সঙ্গে মিলল কি মিলল না তার পরোয়া না করে সত্যকে স্বীকার করার মন তৈরি করা।




  ১৮৪৬ সালে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহ-সম্পাদক পদে যোগ দিয়ে মাতৃভাষার সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সভ্যতার মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হন। ১৮৫২ সালে বিদ্যাসাগর রচনা করেন ‘Notes on the Sanskrit college’ , এর মধ্যে তার শিক্ষা দর্শনের পূর্ণরূপ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে , এই ‘Notes’ এ তিনি লেখেন গণিত শাস্ত্রের ক্ষেত্রে সংস্কৃত এর পরিবর্তে ইংরেজি মাধ্যমে গণিত শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শনের মেলবন্ধন ঘটানো।

1853 সালে প্রাচ্যবিদ ডক্টর জে আর ব্যালান্টাইন কলকাতায় আসেন তিনি একটি প্রতিবেদন পেশ করে , বলেন সংস্কৃত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষ বাধ্যতামূলক নয় । আর এই প্রশ্ন ঘিরেই শুরু হয় বিদ্যাসাগর এবং ব্যালান্টাইন এর বিতর্ক । 

  বিজ্ঞান বিষয়ে বঙ্কিমের বিশেষ আগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি তাঁর বয়স্যদের স্মৃতি কথা থেকে । কালিনাথ লিখেছেন কিভাবে বঙ্কিমচন্দ্র অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কীটাণু , পুষ্করিণীর দূষিত জল, উদ্ভিদের সূক্ষ্ম ভাগ এবং জীবশোণিত প্রভৃতি সূক্ষ্ম পদার্থ জাতির পরীক্ষা করতেন।




  বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে দেশের উন্নতির জন্য আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা অত্যন্ত জরুরি এবং তা শুধুমাত্র গুটিকয়েক উচ্চ শিক্ষিত বৈজ্ঞানিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না ।বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বসাধারণের মধ্যে । এই কারণেই তিনি বঙ্গদর্শনের পাতায় বিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয় সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করতে শুরু করেন ।




  বঙ্গদর্শনের দ্বিতীয় সংখ্যাতেই বঙ্কিম দুটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘স্যার উইলিয়াম টমসনকৃত জীব সৃষ্টির ব্যাখ্যা ‘ এবং ‘আশ্চর্য সৌরৎপাত’ । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বঙ্গদর্শনের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সঙ্গীত ‘ প্রবন্ধ টিও তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। তিনি বীজগণিত, মিশ্রগণিত , রসায়ন, উদ্ভিদ বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি সঙ্গীতেরও বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা করেছেন ।আলোচনা করেছেন শব্দ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়েও। বিজ্ঞান বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ,কবিতা লিখেছেন । 


  কায়েমী স্বার্থরক্ষাকারী ও প্রভুত্ববাদী ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানচর্চার প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সম্প্রসারণ এবং জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণাগার নির্মাণে এগিয়ে এসেছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় এম. ডি. ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। পেশায় চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস দূর করে তাদের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মনস্ক হওয়ার পরামর্শ দন। বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লফো-র সহায়তায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন “ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অব সায়েন্স” (আই. এ. সি. এস) বা ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা।




বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা, বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতার আয়ােজন প্রভৃতিতে এই প্রতিষ্ঠান তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আই. এ. সি. এস-এর নিজস্ব পত্রিকা ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’-সহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকায় এখানকার বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতাে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও গবেষক নানা সময়ে এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণাকর্মে নিযুক্ত ছিলেন। ডঃ রমন এখানে গবেষণা করেই তাঁর বিখ্যাত রমন ক্রিয়া’ আবিষ্কার করেন এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় নােবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

  


  বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা পরবর্তীকালে এখানে একটি সক্রিয় গবেষণা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে এক্স রশ্মি, আলােক-বিজ্ঞান, চৌম্বকত্ব, রমন ক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে নানা মৌলিক গবেষণার কাজ হয়।



  ঔপনিবেশিক বাংলা তথা ভারতে বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে আই. এ. সি. এস এবং তার প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের নাম নিঃসন্দেহে উল্লেখযােগ্য। আজও এই প্রতিষ্ঠান সগৌরবে তার অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে।




  ভারত ছিল বিজ্ঞানের সবার চেয়ে উন্নত অথচ বিজ্ঞানকে মানুষের চেতনায় প্রবেশ করানোর কাজ ছিল সবচেয়ে অনীহ । উনিশ শতকের শেষের দিকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাথ সাহা, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ , প্রমুখ মহাকায়দেবের জন্ম , নিলেও স্নাতকোত্তর গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা খুব কম কলেজে ছিল । মহেন্দ্রলাল সরকার এর প্রতিষ্ঠিত ‘the Indian association for the the cultivation of science ‘ এ পাঠের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয় । এছাড়া কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এর ল্যাবরটরি চলতো বিজ্ঞান গবেষণার কাজ । জগদীশচন্দ্র এবং প্রফুল্ল চন্দ্র দুজনেই এতে কর্মরত ছিল । অল্পকালের মধ্যেই 1917 সালে স্থাপিত হয় ‘বোস ইনস্টিটিউট ‘ । 



  উনিশ শতকের শেষেজ গদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র দুজনেই বিলেত থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফেরা সত্বেও এবং মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণা যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখানো সত্ত্বেও ব্রিটিশ শাসকরা তাদের প্রাপ্য বেতন ও মর্যাদা দিতে কি আপত্তি দিয়েছিলেন তা বিজ্ঞানের ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন। সেই অমর্যাদা খানিকটা সহ্য করে খানিকটা তার বিরুদ্ধে লড়াই করে বহুকষ্টে তারা কলকাতায় বিশ্বজনীন বিজ্ঞান চর্চার ধারা কে বহমান রেখেছিলেন । অথচ অল্পকালের মধ্যেই সেই প্রফুল্লচন্দ্র ও জগদীশচন্দ্রকে ‘স্যার’ উপাধি দিয়ে সম্মান জানাতে কসুর করল না তারা । এমনকি জগদীশচন্দ্রের অবসর গ্রহণের পরেও তাকে professor Emeritus করে গবেষণা চালিয়ে যেতে সম্মতি দিল । এরই পাশাপাশি দেখতে পাই বাঙালি অভিজাত সম্প্রদায় ও হাত খুলে অর্থদানে কাপন্য করেনি। মহেন্দ্রলাল সরকার কে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে বাঙালি তথা ভারতীয় অভিজাতদের কি ভয়ানক আপত্তি ছিল , তা আমরা দেখেছি । তখন তাদের ভয় ছিল পাছে নেটিভরা দস্তরমত বিজ্ঞান চর্চা করলে লাট-বেলাটরা চটে যায়। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় শতকে দেখতে পাই, তারকনাথ পালিত 13.66 লক্ষ্য এবং রাসবিহারী ঘোষ 24.46 লক্ষ টাকা দান করেন বিজ্ঞান কলেজের জন্য । রাজাবাজারে এবং বালিগঞ্জে দু’খন্ড জমি দান করেন পালিত । রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র বহরমপুরে তার প্রতিষ্ঠিত কলেজে পদার্থবিদ্যায় অনার্স ক্লাস চালু করার জন্য অনেক টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন।




  বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করার জন্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরকারের একাংশের কাছ থেকে প্রচুর বিরোধিতা পেতে হয়েছিল একথা ঠিক একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের এক শক্তিশালী অংশের সমর্থন যদি তার পেছনে না থাকতো তাহলে তার কর্মযজ্ঞ সমাধা হতো না । কলকাতায় আশুতোষ বিজ্ঞান ও গবেষণার জন্য প্রাণপাত করছেন ঠিক সেই পর্বেই ব্রিটেনে বিজ্ঞান শিক্ষা গবেষণা ও চর্চার নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চলছে । বিজ্ঞানীর কাছ থেকে আশুতোষ কিছুটা সমর্থন পেয়েছিলেন আর ঠিক একই কারণে হিন্দু অভিজাত বাঙালিরা হঠাৎ বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি সদয় হয়ে উঠেছিলেন । তারা বুঝেছিলেন বিশ শতকে বিজ্ঞান শাসকদের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল বিজ্ঞান আর আগের মত অসত্যের মায়াজাল কেটে সত্য কে অপাবৃত করার তীক্ষ্ণ অস্ত্র নয় । বিজ্ঞান শিখলেই বাঙালি হিন্দু ভদ্র ছেলেরা সব কালাপাহাড় এই আশঙ্কা তাদের মন থেকে সরে যাচ্ছিল ।



  পরবর্তীকালে , রাসবিহারী ঘোষ এবং তারকনাথ পালিতের অর্থানুকূল্যে গড়ে উঠল বিজ্ঞান কলেজ ।তারকনাথ পালিত 13.66 লক্ষ এবং রাসবিহারী ঘোষ 24.46 লক্ষ টাকা দান করেন বিজ্ঞান কলেজের জন্য ।

রাজাবাজারে এবং বালিগঞ্জে দু’খন্ড জমিও দান করেন পালিত । এছাড়াও রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র বহরমপুরে প্রতিষ্ঠিত কলেজে পদার্থবিদ্যায় অনার্স ক্লাস চালু করতে অনেক টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন ।




 বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ এবং ভালোবাসায় বাঙ্গালীদের সকল দোসের ঊর্ধ্বে তুলে একটি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি দান করেছে। দীর্ঘদিনের চর্চা এবং শিক্ষার ফলে বিজ্ঞান শুধু বাঙালীর কর্মেই নয়, স্থান পেয়েছে মননও । শিক্ষিত বাঙালি সমাজ কে দান করেছে একটি সক্রিয় অনন্যতা এই অনন্যতাকেই বাঙালি জাতির কাছে বৈষয়িক সম্পদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শিক্ষার সম্পদ তথা জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত মানুষেরা তাই বাঙালি সমাজে পূজিত হন বিজ্ঞানের মহিষ রুপে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *