ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র ব্যাখ্যা কর
উনিশ শতকের বেশিরভাগ সময় ধরে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন চলছিল বিশের দশকের এর শুরু , নব্বইয়ের দশক এর শেষ। আরবের আব্দুল ওয়াহাব এই আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন, তার নামানুসারে এই আন্দোলন ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। ভারতে এই আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন রায়বেরিলি সৈয়দ আহমেদ। তার মৃত্যুর পর এই আন্দোলনের নেতৃত্বদেন তার দুই শিষ্য এনায়েত আলী ও বেলায়েত আলী । পূর্বে ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিমে পেশোয়ার পর্যন্ত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।
এই আন্দোলনের চরিত্র নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। পশ্চিম ইতিহাসিক জেমস কিনলি ও স্যার উইলিয়াম হান্টার এই আন্দোলনের বিস্তৃত বিচার-বিশ্লেষণ করে এর চরিত্র ব্যাখ্যা করেছেন,এদের মতে এই আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশবিরোধী হান্টার তার Indian musulmans গ্রন্থের দেখেছেন ভারতের মুসলমানরা ছিল দরিদ্র, তারা শাসনক্ষমতা হারিয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিল । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলে বাংলা,বিহার,উরিষ্যা হিন্দুরা জমিদারি পেয়েছিল, মুসলমান কৃষক জমির অধিকার হারিয়েছিল কৃষি অর্থনীতির উপর হিন্দুদের আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল । ওহাবি আন্দোলন ছিল একাধারে ব্রিটিশবিরোধী ও হিন্দু বিরোধী
আলীগড় আন্দোলনের স্রষ্টা স্যার সৈয়দ আহমদ খান এই আন্দোলনের যে বিশ্লেষণ করেছেন তাতে তিনি একে শিখবিরোধী আন্দোলন বলে দেখিয়েছেন । তিনি শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন শুরু করলেও তার আন্দোলনের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল লক্ষ্যটি হলো শাসক ইংরেজদের সহানুভূতি অর্জন করা। ইংরেজদের সঙ্গে তিনি মুসলমানদের বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । এই কারণে তিনি ওহাবি আন্দোলন কে শিখ বিরোধী আন্দোলন বলে ব্যাখ্যা করেন। |
অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরী ডিস্টার্বানেন্স ডিউরিং ব্রিটিশ রুল (1757-1857) ওয়াবি আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ওয়াবিদের ব্রিটিশবিরোধী তার কথা বলেছেন। তিনি বলেন এদের সংগঠন ছিল খুব মজবুত, ব্রিটিশ শাসনের ধ্বংসসাধন করাই ছিল এদের লক্ষ্য । সাম্প্রদায়িক আলিমুদ্দিন আহমেদ ‘wahabi movement in India’ গ্রন্থে এই আন্দোলনের চরিত্র ব্যাখ্যা করে বলেছেন সামাজিক ও ধর্মীয় কার্যাবলী নিয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করেছিল।
ইসলামের শুদ্ধিকরণ বা এই ধরনের মৌল বিশুদ্ধতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ।ইসলামের মধ্যে অনেক অনাচার প্রবেশ করেছিল বিধর্মী সংস্কৃতির অনেক কিছু স্থান পেয়েছিল ইসলামের শুদ্ধতা ও পুরনো পবিত্রতা ফেরানোর জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন এবং উত্তর-পশ্চিমের শাসন স্থাপিত হলে ভারতীয় মুসলমানরা ধরে নিয়েছিল তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে । যদি ইসলামী দেশ বিদেশীরা অধিকার করে নেয় অথবা বিদেশি অধিকৃত দেশে ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান পালনে অসুবিধা দেখা দেয় তবে হিজরত অর্থাৎ Migration করতে হবে। সৈয়দ আহমদ সুরক্ষিত আফগানিস্থান সংলগ্ন উত্তর পশ্চিম প্রদেশে হিজরতের কথা ভেবেছিলেন । ঐ খান থেকে জেহাদ অর্থাৎ সংগ্রাম শুরু করে দারুল হরব (বিধর্মীদের শাসনাধীন) ভারতকে দারুল ইসলামে( মুসলমানদের শাসনাধীন) পরিণত করা ছিল তার লক্ষ্য ।
শিখদের সঙ্গে ওয়াহাবিদের সংঘাতের কারণ হলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভারতে আসার পথে ছিল শিখদের রাজ্য । শিখরা ছিল না তার আসল শত্রু , আসল শত্রু ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য , বণিক ইংরেজরা ছিল তার প্রধান শত্রু হায়দ্রাবাদের সিকান্দার জা এবং গোয়ালিয়রের হিন্দুরাও কে লেখা চিঠিতে সৈয়দ আহমেদ তার ইংরেজবিরোধী তার কথা বলেছিলেন । অবশ্যই এর অর্থ এই নয় যে ওয়াহাবি আন্দোলনের ধর্মীয় দিক ছিল না ।ধর্মীয় দিক অবশ্যই ছিল ,প্রথম পর্যায়ে সমাজ ও ধর্ম সংস্কার কর্মসূচি ছিল সৈয়দ আহমদ ধর্মীয়-সামাজিক, অন্যায়ের ও অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এজন্য একে শিখ বিরোধী আন্দোলন বলা ঠিক নয় ।
উইলিয়াম হান্টার এর গবেষণায় এর ব্রিটিশবিরোধী চরিত্রের চরিত্র ধরা পড়েছে। তিনি এর সংগঠনিক পরিচয় দিয়েছেন ।আলীগড় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমেদ খান একে শিখ বিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলতে চান এই আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী ছিল না এনায়েত আলী, বেলায়েত আলী ইসমাইল কেউ একে ইংরেজবিরোধী বলে উল্লেখ করেনি। সৈয়দ আহমদ রাজনৈতিক কারণে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করেছিলেন এজন্য ওয়াহাবি আন্দোলনের তিনি যে ব্যাখ্যা দেন তা বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মোহাম্মদ জাফর বা আব্দুর রহিম এই আন্দোলনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাকেও নিরপেক্ষ বা বাস্তবসম্মত বলা যায়না । তারা এই আন্দোলনের ব্রিটিশবিরোধী কে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো সমকালীন ব্রিটিশ লেখকদের সকলের ব্রিটিশবিরোধী তার কথা উল্লেখ করেছেন। রায়বেরিলির সৈয়দ আহমেদ ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ,তিনি মুসলমান জগতের ইমাম। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবাদী আত্মত্যাগী সাধক। সামাজিক ও ধর্মীয় অনাচার দূর করে তিনি ইসলামের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হন।
ভারতব্যপী এই জাতীয় আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না । শুধু মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। হিন্দু ব্যাংকাররা ওয়াহাবীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। অমুসলমানরা অর্থসাহায্য দিয়েছিল। হিন্দুরাজারা ওয়াহাবি আন্দোলনের পরিবারবর্গ কে আশ্রয় দেন। সম্ভবত হিন্দু-মুসলমান সকলের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী ছিল ,এর থেকে হিন্দু ও মুসলমানের কাছে এসেছিল ।