তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব বিশ্লেষণ কর ।
বিশ্বায়নের সমালোচনা সবচেয়ে প্রবল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব অধিক যুক্তিযুক্ত। ১৯৭৩ সালে ‘OPEC’ অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারী দেশগুলির সংগঠিত সংস্থা এক ধাপে প্রাকৃতিক তেলের মূল্য চারগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে সৌদি আরব, কুয়েৎ, কাতার, দুবাই, আবু ধাবি, ইরাক, ইরান, ওমান, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা, নাইজেরিয়া, ব্রুনেই ইত্যাদি দেশের শাসকদের হাতে প্রচুর সম্পদ আসে। কিন্তু এই দেশগুলির নিজস্ব শিল্পোন্নয়নের কোন কাঠামো না থাকায় এই সম্পদ গিয়ে জড়ো হয় ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বড় বড় ব্যাঙ্ক যথা সিটি ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক ওফ আমেরিকা, বাররেজ ব্যাঙ্ক, মিডল্যান্ড ব্যাঙ্ক, ডয়েশ ব্যাঙ্ক, ক্রেডিট লিয়নেজ ইত্যাদি ব্যাঙ্কের তোষাখানায়। তখন এই ব্যাঙ্কগুলি চিলি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল প্রভৃতি একনায়কশাসিত গরিব দেশগুলিকে কোটি কোটি টাকা ধার দিতে থাকে।
উদারনীতির নামে সরকারকে গ্যারিন্টি করে এই ধার নেওয়া অর্থ ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রনায়ক মার্কোস, আইভরি কোস্টের রাষ্ট্রপতি হুয়ে বোইনি মতো স্বৈরাচারী শাসক বা শাসকগোষ্ঠী বা আমলা বা ধনী ব্যবসায়ীদের ভোগ ও বিলাসব্যসনে খরচ হতে থাকে। ঋনের দ্বারা আহত সম্পদের সিংহভাগ তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে পাচার করতে থাকে।
১৯৮১ সাল নাগাদ আমেরিকার ব্যাঙ্কগুলিতে সুদের হার প্রচন্ড বেড়ে যাওয়ায় দেখা গেল যে উপরোক্ত ঋন নেওয়া দেশগুলির কারোর পক্ষেই আর সুদাসলে ঋন ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৮২তে প্রথমে মেক্সিকো এবং পরে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, ফিলিপিন্স এবং সাহারা মরুভূমির নিকটবর্তী আফ্রিকার অনেক দেশ পুনরায় মা যু ও আর্ন্তজাতিক মুদ্রা . ভান্ডারের শরণাপন্ন হল। তখন শুরু হল বিভিন্ন দেশের ঋনগুলিকে নতুন করে কিস্তিবাদী (re scheduling) করার খেলা এবং তাদের উপর কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের (structural adjustment) চাপ। বিশ্বঅর্থনীতির নিয়ন্তারা যে সব শর্ত আরোপ করল, তাতে ঋনী দেশের সরকারগুলি তাদের জনকল্যান ও বিনিয়োগ খাতে খরচ কমাতে এবং অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানির উপর সব নিয়ন্ত্রন তুলে নিতে বাধা হল। এইভাবেই মহাজনী মূলধনের উদ্ধত উত্থান বিশ্ব অর্থনীতির কর্মকান্ডে এক পরিবর্তন নিয়ে এল যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপর বিশ্বায়নের প্রভাব বিস্তার করতে লাগল।
![]() |
তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব |
আর্থিক উন্নয়নের ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে এল, একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গজিয়ে উঠল, বুয়েনস এয়ারস’এ নিত্য নতুন শপিং মল তৈরী হল। কিন্তু এই আর্থিক নীতির সুদূরপ্রসারী ফল হল: মারাত্মক। দেশটি ক্রমাগত বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন হল- ১৯৮০ সালে ৪৭১ কোটি টাকার ঘাটতি ১৯৯৪ সালে বেড়ে হয় ১০৩৯ কোটি ডলার। ২০০১ সাল নাগাদ দেশটির বিদেশী ঋনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৩২১৪ কোটি ডলার জা জাতীয় আয়ের ৪৬.৮%। ১৯৯৬ সাল থেকে ঐ দেশের বার্ষিক গড় আয় বছরে ৪.১ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছিল, ২০০১-০২ এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ %।
ব্যাঙ্কে টাকা থাকলেও সরকারী আইনানুসারে কেউই ২৫০ পেসোর বেশি তা খরচ করতে পারত না (২০০১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত)। এর সঙ্গে যুক্ত হল ট্যাক্স বৃদ্ধির চাপ, পেনসন ছাঁটাই, বেতন সংকোচন, বোনাস বন্ধ এবং সর্বোপরি চাকরি হারাবার আশঙ্কা। এর ফলে দেশবাসী বাধ্য হয় আন্দোলন করতে এবং তা এতটাই সর্বাত্মক ও ব্যাপক আকার ধারণ করে যে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ নাগরিক নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং তাদের অর্থমন্ত্রীরা দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন।
তবে ভূতপূর্ব তৃতীয় বিশ্বের কয়েকটি দেশ যেমন পূর্ব এশিয়ার নগররাজ্য হংকং ও সিঙ্গাপুর, ছোট দেশ তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ সাধারণতন্ত্রী চীন ১৯৮০’র দশক থেকেই নিজেদের আয় ও সাধারণ সমৃদ্ধি বাড়িয়ে চলেছিল। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর ও হংকংএ জমিদার শ্রেণি ছিল না চীন ও কোরিয়ায় উচ্ছেদ ঘটেছিল আগেই। উপরোক্ত দেশগুলির সবকটাই ১৯৯৫ সাল নাগাদ নিরক্ষরতার হার প্রচণ্ড হারে কমিয়ে এনেছিল (চীন ১৯%, কোরিয়া ৫%, হংকং ৮%, সিঙ্গাপুর ১%); এবং সবকটি দেশই তাদের প্রচন্ড স্বজাত্যবোধের উপর নির্ভর করে জাতীয় আয়ের ৩০ থেকে ৪০% পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিল।
উপরোক্ত দেশগুলি নিজেদের অঞ্চলে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালেশিয়াকে নিয়ে বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় এবং পরে বিশ্বের নানান স্থানে বিনিয়োগ করতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডেইউ, হান্ডে স্যামসুভ নামক দক্ষিণ কোরিয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলির নাম যারা আজ ভারতীয় বাজারে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। এমনকি ১৯৯৭ সাল নাগাদ যখন থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া দঙিণ কোরিয়া সহ পূর্বিেশয়ার দেশগুলি আর্থিক সংকটে পড়েছিল তখনও এই দেশগুলির সরকার দৃঢ় আর্থিক নীতি গ্রহণ করে আর্ন্তজাতিক সংকটকে প্রতিরোধ করেছিল। তবে এখানে উল্লেখ্য যে বিদেশীকৃত প্রত্যক্ষ লগ্নির ( Foreign Direct Investment) স্রোত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধনী দেশ থেকে ধনী দেশে প্রবাহিত হয়।
১৯৯৪ সালের হিসাবানুযায়ী মোট লগ্নির পরিমাণ ছিল ২২,৫৬৯ কোটি ডলার যার মধ্যে ১৩,৪৯৮ কোটি ডলার গেছিল এক ধনী দেশ থেকে আপর এক ধনী দেশে। এই পরিমাণের আবার সিংহভাগ লগ্নি হয়েছিল পূর্ব এশিয়ার উপরোক্ত দেশগুলিতে। যেমন চীনে হয়েছিল ৩৩৮০ কোটি ডলার, সিঙ্গাপুরে ৭১০ কোটি ডলার, মালেশিয়ায় ৪৫০ কোটি ডলার। তুলনায় ঐ বছর ভারতে লগ্নি হয়েছিল মাত্র ১৫ কোটি ডলার। ফলে সর্বজনীন শিক্ষা, স্বজাত্যবোধ, এবং স্বাবলম্বনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পূর্ব এশিয়ার ঐ দেশগুলি বিশ্বায়নের সুফলকে দেখতে পাচ্ছে। অধ্যাপক আমিয় বাগচীর মতে ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মত দেশে এরূপ সদর্থক অর্থনৈতিক অগ্রগতির আশা অনেকাংশেই কম।
বিশ্বায়নের অর্থনীতি আসলে বিশ্বব্যাঙ্ক, আর্ন্তজাতিক মুদ্রাভান্ডার এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অনুমোদিত অর্থনীতি, স্বাভাবিক ভাবেই এই সংগঠনগুলিকে যারা পরিচালনা করে মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের মত বা ব্রিটেনের মত পুঁজিবাদি দেশগুলি নিজেদের স্বার্থে বৈষয়িক বিশ্বায়নকে পরিচালিত করবে এটা ধরে নেওয়া যায়। বহুজাতিক সংস্থাগুলি বিশ্বায়নের ফলে কি পরিমাণে লাভবান হচ্ছে তা অবশ্য সংখ্যাতত্ত্বের আকারে দেখানো যেতে পারে। ১৯৯৪ সাল নাগাদ রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাবানুযায়ী সরা পৃথিবীতে ৩৮, ৫৪১টি বহুজাতিক সংস্থা ছিল এবং তাদের সহযোগী সংস্থার সংখ্যা ছিল ২.৫১,৪৫০টি। অর্থাৎ গড়ে দেশ প্রতি ১৬৫টি করে শাখা। এই ৩৮,৫৪১টি বহুজাতিকের মধ্যে ৩৪,৫৪৩টির আসল ঘর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিটেন, ইত্যাদি মুষ্টিমেয় দেশ। ছোট দেশ সুইজারল্যান্ডেরই ৩০০০টি বহুজাতিক সংস্থা রয়েছে।
১৯৯২ সালের হিসাব অনুসারে সমস্ত বহুজাতিক সংস্থার মোট বিক্রীর পরিমাণ ছিল ৫২০০ বিলিয়ন ডলার বা ৫,২০,০০০ কোটি ডলার। সেখানে ১৯৯৪ সালে ভারতের জাতীয় আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৯,৩৫২ কোটি ডলার। সিনেমার জগৎ( যা কিনা সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের পর্যায়ভুক্ত) থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া হল যা থেকে ধনতান্ত্রিক দেশে ডলার প্রবাহের প্রমাণ বহন করে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে টাইটানিক ছবিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৬৭৪টি পর্দায় মুক্তি পায় এবং ১৯৯৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬০ কোটি ৮০ লক্ষ ডলার লাভ করে। এক বছরে আমেরিকার বাইরের দেশ থেকে ছবিটি লাভ করে প্রায় ১২১ কোটি ১৪ লক্ষ ডলার, অর্থাৎ মোট এক বছরে লাভ হয় ১৮১ কোটি ৯৪ লক্ষ ডলার। প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন, ক্যাসেট বিক্রী, গানের ক্যাসেট বিক্রী থেকে টাইটানিক ছবিটি যে লাভ তুলেছিল তার একটি বিরাট অংশ এসেছিল আর্জেন্তিনা, ভারত, পাকিস্তানের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি থেকে।
মূল্যায়ন
তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব – কে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো খুব চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন উন্নয়নশীল দেশগুলির জোট জি-৭৭’র সম্মেলনে ভাষণ প্রসঙ্গে। তিনি বলেছেন যে বিশ্বায়ন আজ বাস্তব সত্য। বর্তমান পৃথিবীকে একটি জাহাজের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন যে সেই জাহাজের হাতে গোনা কয়েকজন আরোহী বিলাসবহুল কেবিনে বসবাস করেন যেখানে ইন্টারনেট, সেলফোন, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা হাতের মুঠোয় রয়েছে। অথচ জাহাজের ৮৫% যাত্রী বিপর্যস্ত, যন্ত্রণাবিদ্ধ ও অসহনীয় অবস্থায় জাহাজের নোংরা খোদলে গাদাগাদি করে আছে- রোগ আর অসহায়তা তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। জাহাজে এত বেশি অন্যায় আবিচার চলছে যে মনে হচ্ছে যে এর ভেসে থাকা দুঃসাধ্য এবং এই জাহাজ কোন বন্দরে না ভিড়ে সম্ভবত কোন হিমশৈলে ধাক্কা খাবে। বস্তুতপক্ষে আধুনিক তৃতীয় দুনিয়ার মানুষদের কাছে বিশ্বায়ন দুর্ভাবনা বহন করে এনেছে ।