সুয়েজ সংকটের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর / সুয়েজ সংকটের তাৎপর্য আলোচনা করো।
সুয়েজ সংকটের তাৎপর্য : মধ্যপ্রাচ্য তথা আন্তর্জাতিক ইতিহাসে সুয়েজ সংকটের তাৎপর্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মিশর সামরিক দিক দিয়ে নিজ লক্ষ্য পূরণ করল, নাসেরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেল, তিনি হয়ে উঠলেন আরব জাতীয়তাবাদের নতুন বীর বা ‘আধুনিক সালাদিন’। জর্ডন ইঙ্গ-জর্ডন চুক্তি বাতিল করে মিশরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করল। ১৯৫৮ সালে মিশর ও সিরিয়া অঙ্গীভুত হয়ে গঠন করল সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র।
![]() |
সুয়েজ সংকটের তাৎপর্য |
দ্বিতীয়ত, সামরিক দিক দিয়ে নিজ শক্তিকে প্রকাশিত করলেও ইজরায়েল শেষ পর্যন্ত অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
তৃতীয়ত, সুয়েজ সংকটের ব্যর্থতা ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের পক্ষে ক্ষতিকারক হল। একদিকে নাসেরকে উৎখাতের স্বপ্ন অধরা থেকে গেল, অন্যদিকে সুয়েজ খালের উপর নিয়ন্ত্রন নষ্ট হল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এন্টনি ইডেনের ভাবমূর্তি নষ্ট হল এবং তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ছেদ পড়ল, ১৯৫৭ সালে ইডেন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর রাজনীতিতেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রভাব অবসৃত হল, অনেকেই এই কারণে সুয়েজ সংকটের বিপর্যয়কে ‘দ্বিতীয় দিয়েন বিয়েন ফু’ বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়েছিল প্রচুর, ১৯৫৬ সালের শেষ তিন মাসে ব্রিটেনের আর্থিক ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪০০ মিলিয়ান ডলার।
চতুর্থত, সুয়েজ সংকটের অন্যতম তাৎপর্য বা গুরুত্ব ছিল সুয়েজ সংকটে প্রকৃত অর্থে লাভবান হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ান। সুয়েজ সংকটের ফলে সৃষ্ট যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যখন সমগ্র বিশ্বের চোখ নিহিত সেই সুযোগে চরম বর্বরতায় পূর্ব ইওরোপে হাঙ্গেরীর বিদ্রোহ দমন করেছিল সোভিয়েত রাশিয়া। অন্যদিকে সুয়েজ সংকটের ফলে ন্যাটোর ঐক্যে ফাটল বা চিড় লক্ষ্য করা যায়।
অন্যদিকে আরব জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে এবং মিশরের পাশে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে রাশিয়া কার্যত তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়, আরব দেশগুলিও পাশ্চাত্য জোটের বিরোধী হয়ে ওঠে। ইরাকে জেনারেল কাশেম ক্ষমতা দখল করেন এবং ইরাক পশ্চিমী জোটের বাগদাদ চুক্তি থেকে সরে আসে। মিশরে আসোয়ান বাধ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করার জন্য রাশিয়া মিশরকে প্রতিশ্রুতি দিল।
পঞ্চমত, সুয়েজ সংকটজনিত কারণে একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের প্রভাব হ্রাস এবং অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৫৭’র ৫ই জানুয়ারী মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে তাঁর ঘোষণায় বলেন যে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কোন রাষ্ট্রের সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন দেশ সাহায্যের আবেদন জানালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সাহায্যপ্রার্থনাকারী দেশের নিরাপত্তার জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করবে। মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ নীতির নায্য প্রমাণ করার জন্য শূন্যতার তত্ত্ব তুলে ধরে এবং দুই বছরের জন্য ৪০০ থেকে ৫০০ মিলায়ান ডলার অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে লেবাননের রাষ্ট্রপতি শামুন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের জন্য মার্কিন হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করলে মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহরের ১৭ হাজার নৌ সেনা লেবাননে অবতরণ করে বিরোধীদের দমন করে। লেবাননের পাশাপাশি জর্ডন এবং সোধি আরবের উপরেও মার্কিন নিয়ন্ত্রন বজায় থাকে। এইভাবে পিটার কালভোকুরেশির মতে মধ্যপ্রাচ্য ঠান্ডা লড়াই’র রাজনেতিক আবর্তে একটি সংজোনে পরিণত হয়।