পেলোপনেসীয় যুদ্ধে ব্রাসিডাসের ভূমিকা মূল্যায়ন কর।
সমগ্র আর্কিডেমীয় যুদ্ধপর্বে স্পার্টান সেনাপতিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সফল ও উল্লেখযোগ্য হলেন টেলিসের পুত্র ব্রাসিডাস। সামরিক প্রতিভা ও ব্যক্তিগত চরিত্রগুণে তিনি স্পার্টা তথা গ্রীসের ইতিহাসে স্বকীয়তায় ভাস্বর হয়ে আছেন।
চারিত্রিক নানা গুণের জন্য ব্রাসিডাসকে শুধু স্পার্টার নয়, সমগ্র গ্রীসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য। প্লেটো তো ব্রাসিডাসকে পৌরাণিক বীর একিলিসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক।
ব্রাসিডাসের ব্যক্তিগত প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা এথেনীয়দের ক্ষতিকর সম্ভাবনার পক্ষে সর্বাধিক বিপজ্জনক ছিল। গ্রোট মন্তব্য করেছেন : “শুধুমাত্র সাহস নয়, আগ্রাসনের উপায় উদ্ভাধনের দক্ষতা, তড়িৎ গতি, সেনাবাহিনীর মনে উদ্দীপনা জাগানোর ক্ষমতা—এই সবকিছুই এই সেনাপত্তির দক্ষতার কারণ ছিল। শুধু তা-ই নয়, তাঁর অকলুষ ন্যায়পরায়ণতা, তাঁর অটল বিশ্বাস, তাঁর সংযম, দলীয় নির্মমতা বা দুর্নীতি থেকে নির্লিপ্তি এবং গ্রীসের মুক্তিদাতা হিসাবে স্পার্টা যে ঘোষণায় সোচ্চার ছিল, এই ঘোষণার প্রতি অবিচল আনুগত্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংবিধানে অনধিকার হস্তক্ষেপ থেকে তাঁর মুক্ত অবস্থানও তাঁর কুশলী সৈন্যাপত্যের মূলে ছিল। তাঁর মধ্যে যেরূপ সহজাত ক্ষমতা ও যেরূপ সরকারী পদের যোগ্য গুণাবলীর অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল, এরূপ সমাবেশ এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি ”।
বিউরি বলেন, “ব্রাসিডাস ভুলক্রমে স্পার্টান হয়ে [ জন্মেছিলেন” (“Brasidas was a Spartan by mistake’)। ওয়েস্টলেক বলেন, প্রচলিত অর্থে একজন স্পার্টান নেতা বলতে যা বোঝায়, ব্রাসিডাস ছিলেন তার বিপরীত। থুকিডাইডিস মন্তব্য করেছেন যে, তিনি রাজনৈতিক সংকীর্ণতামুক্ত ছিলেন এবং তিনি রাজনৈতিক প্রশ্নের বিচারে সবসময় নিজেকে সহিষ্ণু, ন্যায়ানুগ এবং সংযত বলে প্রমাণ করেছেন।
পেলোপনেসীয় যুদ্ধের প্রথম বছর এথেন্স যখন ল্যাকোনিয়ার অন্তর্গত মেথন আক্রমণ করল, তখন অসম সাহসী নবীন যুবা এই ব্রাসিডাসই মেথনকে রক্ষা করেছিলেন। মেথন রক্ষার সাফল্যের সুযোগ নিয়ে ব্রাসিডাসের সামরিক জীবনের জয়যাত্রা শুরু হল। এই শুধু একবারই যে ব্রাসিডাস এথেন্সের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা নয়। তাঁর এই কৃতিত্বলন খ্যাতিই (মেগন রক্ষা) এক উদ্যোগী উদ্ভাবকরূপে স্পার্টার উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে তাঁকে স্থান করে দিয়েছিল। আর সেই কৃতিত্বের কারণে সমগ্র আর্কিডেমীয় যুদ্ধপর্বে পেলোপনেসীয়গণ তাকে সকলের সম্মুখে উদ্ঘাটিত করেছিল।
পাইলস অবরোধের সময় এথেনীয় পক্ষে যেমন ছিলেন ক্লিয়ন, তেমনি স্পার্টার পক্ষে ছিলেন সাহসে, উদ্যোগে আর উদ্ভাবনী শক্তিতে সদক্ষতাসম্পন্ন ব্রাসিডাস। সামুদ্রিক আক্রমণের সময় অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে একটি যুদ্ধজাহাজকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সহজাত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রবল উৎসাহ ও তীব্রতা নিয়ে তিনি শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু প্রতিরক্ষা ক্ষমতা যথোপযুক্ত না হওয়ায় তিনি আহত হয়ে তাঁর বর্মটি হারালেন। অ্যাডকক লিখছেন – “এথেনীয়রা তাঁর (ব্রাসিডাস) কর্মটি কেড়ে নিল এবং স্পার্টানরা হারাল তার উপদেশবাণী।”
নিসিয়া অধিকার করে এথেনীয়রা যখন মেগারা অবরোধ করল, ব্রাসিডাস তখন সাইকিয়ন ও করিন্থের সংলগ্ন অঞ্চল এবং প্রেস আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ব্রাসিডাস সেখান থেকেই মেগারার সাহায্যে এগিরে এলেন। আর করিছ ও বিয়োসিয়ার সামরিক সাহায্য নিয়ে মেগারাকে ঘিরে ফেললেন। এথেনীয়রা যুদ্ধের কোন রকম ঝুঁকি না নিয়েই পিছু হটে গেল।
ব্রাসিডাস কূট রাজনৈতিক কৃতিত্ব ও যুদ্ধের দ্বারা এথেন্সের কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্রকে স্বপক্ষে আনতে পেরেছিলেন। সুকৌশলে অ্যাম্ফিপোলিস দখল করে থ্রেসে এথেনীয় সাম্রাজ্য বিপন্ন করে তুলেছিলেন। আর এ সবকিছুই তিনি করেছিলেন স্বদেশের পূর্ণ সাহায্য ও সমর্থন ব্যতিরেকে। ওয়েস্টলেক বলেন, স্পার্টান নেতৃবৃন্দের মধ্যে একমাত্র তিনিই অন্যান্য গ্রীকরাষ্ট্রের স্বার্থ উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাকে মূল্য দিয়েছিলেন। তবে তাঁর সামরিক কার্যকলাপ একেবারে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সুতরাং, পেলোপনেসীয় যুদ্ধে ব্রাসিডাসের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
পেলোপনেসীয় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার তিনি ছিলেন প্রধান সমর্থক। তাঁর উচ্চাশা জাগ্রত হওয়ার পর তিনি যুদ্ধের খেলায় মেতে উঠেছিলেন। স্পার্টার শান্তির প্রচেষ্টায় তিনি বাধা দিয়েছিলেন। স্কিওন ও মেন্ডি সম্পর্কে তাঁর মনোভাব সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, বিউরির ভাষায় তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করেছিলেন। এথেনীয় নৌবহরের বিরোধিতার জন্য স্পার্টা প্যালেনের নগরগুলি রক্ষা করতে পারেনি, এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাসিডাসের নীতিকে আরো অসন্তোষজনক মনে হয়। তবুও পেলোপনেসীয় যুদ্ধে ব্রাসিডাসের ভূমিকা স্মরণীয়। এথেনীয় সাম্রাজ্যকে বিপন্ন করবার প্রচেষ্টায় তিনি আমৃত্যু লড়ে গেছেন। পেরিক্লিসের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ তিনিই সব এলোমেলো করে দিয়েছিলেন।
ব্রাসিডাসের অকালমৃত্যু না হলে স্পার্টার চেয়ে এথেন্সই হয়ত বেশি লাভবান হত। কেননা, ব্রাসিডাস আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে তাঁর ক্রিয়াকলাপের জন্য এথেন্সকে সব দেশে এত বিব্রত হতে হত যে, তার পক্ষে সিসিলি অভিযান করা সম্ভব হত না, আর ঐ অভিযানের ব্যর্থতার মানি তাকে বইতে হত না। সামরিক দক্ষতা ও চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য ব্রাসিডাস স্পার্টা তথা গ্রীসের ইতিহাসের এক অনন্যসাধারণ পুরুষ। এই স্পার্টাকেশরীর গ্রীক ইতিহাসে অপরিজ্ঞান হয়ে থাকবে।