গ্ৰীসের জনজীবনে খেলাধূলার ভূমিকা পরীক্ষা কর।
ভূমিকাঃ
পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্মভূমি গ্রীস শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেনি, নানা ধরনের খেলাধূলারও পীঠস্থান রূপে চিহ্নিত হয়েছিল। হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’-তে গ্রীক সমাজজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরূপে ক্রীড়ার উল্লেখ রয়েছে। গ্রীকদের কাছে খেলাধূলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানুষের কাছে স্বাস্থ্যই সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্য—গ্রীকরা মনে করত স্বাস্থ্যই সব থেকে মূল্যবান হওয়া উচিত। প্রাচীনকালের যুদ্ধগুলিতেও সুঠাম স্বাস্থ্যবান যোদ্ধার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই দেখতে পাই শুধু ইস্কাইলাস বা প্লেটোর ভক্ত ছিল না, তারা ছিল স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের পূজারী। সুতরাং গ্ৰীসের জনজীবনে খেলাধূলার ভূমিকা বা প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিসীম।
গ্ৰীসের জনজীবনে খেলাধুলার ভূমিকা পরীক্ষাঃ
গ্রীক ভাষায় “অ্যাথলীট” শব্দের অর্থ প্রতিযোগিতা এবং গ্রীক জীবনের সর্বত্রই ছিল প্রতিযোগিতা। সমস্ত রকমের খেলাধূলায় প্রতিযোগীদের মধ্যে জয়ী হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। কেননা, তারা যে সামাজিক সম্মান পেতেন, তা যে কোন সময় বিজয়ী সেনানায়কের সম্মানের চেয়ে ঢের বেশি। নিতান্ত আনন্দলাভ ও সুন্দর শরীর গঠন করাই গ্রীকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল—পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা কখনো খেলাধূলাকে বিচার করেনি।
ক্রীড়া নিয়মাবলী মান্য করা অবশ্য কর্তব্য ছিল। নিয়মানুবর্তিতা প্রতিযোগিতার গুরুত্ব ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত, অসাধু প্রতিযোতিনীর প্রাপ্য ছিল বিদ্রূপ। ক্রীড়াঙ্গন ছিল শ্রীকদের কাছে মহৎ শিক্ষাকেন্দ্র, শরীরচর্চা ও মনোবিকাশের এক উৎকৃষ্ট স্থান। পেশী আর মননের উৎকর্ষ সাধনই ছিল তদানীন্তন গ্রীসের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। পরিমিতিবোধ গ্রীক জীবনের একটি বৈশিষ্ট্য। আর এই পরিমিতিবোধ গ্রীক শারীর শিক্ষার মধ্যেও দেখা যায়। ব্যায়ামে সাহায্যে একটি সবল সুন্দর সুষমান্বিত দেহ তৈরী করাই গ্রীকদের উদ্দেশ্য ছিল।
হোমারের যুগে জিমনাস্টিক ও অ্যাথলেটিকস গ্রীক সমাজে খুবই গুরুত্ব পেয়েছিল। ধর্মানুষ্ঠান এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে লিমনাস্টিকের ব্যবস্থা ছিল। অবশ্য এই জিমনাস্টিক অনেকটা নৃত্যভঙ্গির আকারে প্রদর্শিত হত। হোমারের বর্ণনা থেকে মনে হয়, অ্যাথলেটিকসের চর্চা রাজপরিবার ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জনসাধারণ থাকত দর্শকের ভূমিকায় – অংশগ্রহণের অধিকার তাদের ছিল না।
![]() |
গ্ৰীসের দৌড় প্রতিযোগিতার মাঠ |
কোন একটি প্রতিযোগিতায় নানা ধরনের ক্রীড়ানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত। প্রথমেই অনুষ্ঠিত হত রথচালনা প্রতিযোগিতা। দুটি অশ্বচালিত রথের সারথি হতেন স্বয়ং রথের মালিক। – মুক্তিযুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীদের মুষ্টি কখনো বর্মাবৃত থাকত, কখনো অনাবৃত। তৃতীয় প্রতিযোগিতা ছিল দণ্ডায়মান কুস্তি। এরপর ছিল দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীরা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াত। তারপর সঙ্কেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় শুরু করত এবং নির্দিষ্ট স্থান পরিক্রম করে আবার সেখানে ফিরে আসত। বর্শা নিক্ষেপ ছিল সর্বশেষ প্রতিযোগিতা।
এই যুগেই খেলাধুলা শিল্পী-সাহিত্যিক ও কবিদের দারুণভাবে প্রভাবিত করল। শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্মে সুন্দর দেহাবয়বের রূপ দিলেন, কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করলেন খেলাধূলা প্রশস্তি, সংগীতজ্ঞরা গাইলেন ক্রীড়াবিদদের নিয়ে গান। স্বভাবতই শারীর শিক্ষায় এল একটি নুতন প্রেরণা। বিভিন্ন ক্রীড়াঙ্গনে এথেনীয়রা পেল মুক্তির আস্বাদ, ক্রীড়াঙ্গনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে উঠল সৌভ্রাতৃত্ব।
প্রতিযোগিতাতেই এথেনীয়রা শক্তি ও গতির তেমন পরিচয় দেয়নি। কেননা, তাদের নজর ছিল সৌন্দর্যের দিকে, শক্তি বা গতির দিকে নয়। এথেনীয়রা খেলাধূলার সৌন্দর্যের সঙ্গে মানবিক গুণকে সমন্বিত করেছিল। তাই তৎকালীন এথেন্সের শারীর শিক্ষা ছিল শক্তি ও বিনয়-সংযমের সমন্বয়।
এথেন্সে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নানা ধরনের খেলাধূলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শারীর শিক্ষার প্রসার ঘটে। এই সব অনুষ্ঠানে অ্যাথলেটিকস, সঙ্গীত, নাটক, কাব্য, শিল্প ইত্যাদির প্রতিযোগিতা হত। এর মধ্যে অ্যাথলেটিকসের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। প্রতিযোগী হিসাবে এথেন্স তেমন সফল হত না, কিন্তু আয়োজক হিসাবে এথেন্স সবার শীর্ষে ছিল।
খেলাধূলা প্রথমদিকে ছিল ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান। পরে স্থানীয় ভিত্তিতে খেলাধূলার প্রচলন হয়। ক্রমে নিখিল গ্রীস বা প্যান-হেলেনিক ক্রীড়ানুষ্ঠানের সূচনা হয়। অলিম্পিক, ইহামিয়ান, পাইথিয়ান ও নিমিয়ান—এই চারটি উৎসব সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। এই সব অনুষ্ঠানে নানা ধরনের খেলাধূলা অনুষ্ঠিত হত। ক্রমশ অ্যাথলেটিকস জনপ্রিয়তা লাভ করলে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি শুধু উদ্বোধন কর্মসূচীতে সীমাবদ্ধ রইল। খেলাধূলাই তখন এই উৎসবগুলির প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়াল।
![]() |
অলিম্পিক মাঠ |
আচ্ছাদনহীন খোলা মাঠে খেলাধূলার অনুশীলন চলত। শিশুর পায়ের পেশী শক্ত করার জন্য দৌড়-ঝাপ শেখানো হত। সত্যেরা আঠারো বয়স পর্যন্ত সমস্ত ছেলেকেই বল খেলতে হত। এরপর বর্শা নিক্ষেপ, খালি হাতে মুষ্টি যুদ্ধ, কুস্তি ইত্যাদি শেখানো হত। প্যানক্রেসিয়ামের বীভৎসতা ও শিকারের উন্মাদনাও শিক্ষার্থীদের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাইরিক নামে বর্শা ও ঢাল সহযোগে একপ্রকার সমর নৃত্যও শারীর শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর একটি খেলা হল – পনের জনের একটি দল একটি খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। অপর দল তাদের ঠেলে খালের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করবে। দণ্ডায়মান দল খালে পড়ে গেলে পরাজিত হবে।
আঠারো বছর বয়সে সৈন্যদলে যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল। তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত চলত সামরিক শিক্ষা। কঠোর ক্রীড়ানুশীলনের মাধ্যমে মজবুত শরীর তৈরি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। শারীরিক সামর্থ্য হ্রাস পেলে সৈনিকরা অল্পবয়সীদের শিক্ষাদানের কাজে নিযুক্ত হত। চুরি করা, লুঠতরাজ করতে শেখানো ইত্যাদি সামরিক শিক্ষার অঙ্গ ছিল।
সঙ্গীতের সঙ্গে জিমনাস্টিক, দৌড়-ঝাপ, বর্শা ও ডিসকাস নিক্ষেপ, অশ্বরোহণ ইত্যাদি ছিল স্পার্টার নারীদের শিক্ষণীয় বিষয়। সাঁতার ও কুস্তিতেও তারা অংশগ্রহণ করত। বোর্ডিং বা ব্যারাক নয়, গৃহাসনই ছিল তাদের শিক্ষাকেন্দ্র। বিবাহিত নারীরা কোন রকম শারীর শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হত না।
যেদিন থেকে স্পার্টা খেলাধূলাকে সামরিক শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ করে নিল, সেদিন থেকে তাদের ক্রীড়াজগতের মান নিম্নগামী হল। অলিম্পিকের আসরেও তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ল। খেলাধূলার নির্মল আনন্দ পবিত্রাতা তিরোহিত হল।
সুপ্রাচীন কাল থেকে গ্রীক রমণীরা খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করত। পুরাণকাহিনীর রাজকন্যা আটলান্টা নানাবিধ খেলায় পারদর্শিনী ছিলেন। তিনি পেলিয়াসের (আনু. ১২৪৫ খ্রিঃ পুঃ) সম্মানে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রমণীরা দৌড়, কুস্তি, ডিসকাস নিক্ষেপ ইত্যাদি খেলায় অংশগ্রহণ করত বলে উইল ডুরান্ট উল্লেখ করেন। সুস্থ সবল সন্তানের জননী হবে এই আশায় লাইকারগাস রমণীদের জন্য দৌড়, কুস্তি, ডিসকাস নিক্ষেপ ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করেছিলেন।
গ্রীক ক্রীড়াবিদরা সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য যে সাধনা করত, সেই সাধনা তাদের মধ্যে এমন এক নতুন জীবনবোধের সৃষ্টি করেছিল, যেখানে হতাশা, দুঃখ ও নৈরাশ্যের কোন স্থান ছিল। না। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলায় প্রতিফলিত হয়। অ্যারিস্টট্ল বলতেন, দৈহিক স্বাস্থ্যের উপরই মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভরশীল। এ কথা যদি মেনে নিই, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই, গ্রীক সভ্যতার অগ্রগতির মূলে খেলাধূলা একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল এবং গ্ৰীসের জনজীবনে খেলাধূলার ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
মূল্যায়নঃ
খেলাধূলার মাধ্যমে গ্রীকরা স্বপ্ন দেখেছিল, সৌভ্রাতৃত্বের বিশ্বশান্তির। তারা বিশ্বাস করেছিল গ্রীক ক্রীড়াঙ্গনে প্রজ্বলিত মশালের শিখা গ্রীক জগৎ তথা মানবজাতির মিলনের পথকে আলোকিত করে তাদের নিয়ে যাবে বিশ্বশান্তির বন্দরে। খেলাধূলার মাধ্যমে গ্রীকরাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে ঐক্যবোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়ত কোন রাজনৈতিক ঐক্যের সূচনা করেনি কিন্তু এই ঐক্যবোধ পেলোপনেসীয় রাষ্ট্রসংঘ, ডিলীয় রাষ্ট্রসংঘ ও বিয়োসীয় সংঘ ইত্যাদি রাজনৈতিক সংঘ সৃষ্টির পথকে ত্বরান্বিত করেছিল। তাই, শুধু দেহসৌষ্ঠব ও মননে নয়, গ্ৰীসের জনজীবনে সর্বস্তরে খেলাধূলার ভূমিকা অনুভূত হয়।