ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান।
ভূমিকাঃ
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১- ১৯৫১) ছিলেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার একজন অন্যতম পথিকৃৎ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেমন নব্যবঙ্গীয় চিত্র রীতির জনক বলা হয়, ঠিক তেমনি তাঁকে আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার পুরোধাও বলা হয়। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন। ভারতীয় চিত্র শিল্পীদের মধ্যে রাজা রবিবর্মার পরেই যিনি সমাদৃত হতেন তিনি হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর পিতা ছিলেন দ্বারকানাথের পৌত্র গুণেন্দ্রনাথ । নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতিরও জনক ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এই কৃতী পুরুষটি ছোটবেলায় অঙ্কনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ড্রয়িং, প্যাস্টেল, জলরং এবং অয়েল পেইন্টিং শিখেছিলেন বিদেশী শিল্পীদের কাছে।
![]() |
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানঃ
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ড্রয়িং, প্যাস্টেল, অয়েল পিন্টিং ও জল রঙের কাজ শেখেন উনিশ শতকের শেষ দশকের প্রথম দিকে। শিক্ষক হিসেবে প্রথম দিকে ছিলেন গিলার্ডি ও পরে ব্রিটিশ চিত্রকর চার্লস পামার।তবে তিনি বেশী স্বচ্ছন্দবোধ করতেন ভারতীয় রীতিতে। পাশ্চাত্যের চিত্রশৈলীর প্রতি তাঁর অপরিসীম আকাঙ্খা থাকলেও এইসকল শিল্পকর্ম তাঁকে তৃপ্ত করতে পারেনি। শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে তিনি ভারতীয় সনাতন চিত্রাঙ্কন-রীতি পুনরুদ্ধারের সাধনা শুরু করেন। তাঁর চিত্রচর্চার বিষয় হয় বৈষ্ণব পদাবলী।
রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তিনি আঁকেন গোবিন্দদাসের পদ ‘পৌখালি রজনী পবন বহে মন্দা/চৌদিশে হিমকর, হিমকরু, হিম করু বন্দ।’ – বর্ণিত ‘অভিসারিকা’ কিন্তু এই নামেই তার একটি অধিক পরিচিত ছবি থাকার জন্য এটি ‘শ্বেত অভিসারিকা’ নামে খ্যাত। এই বৈষ্ণব পদাবলীকে অবলম্বন করে তিনি এঁকেছিলেন বিখ্যাত ‘শ্বেতঅভিসারিকা’। তারপরেই কৃষ্ণলীলা সিরিজের ছবিগুলি তাঁকে বিশেষ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। বলা হয় যে, এই কৃষ্ণলীলা সিরিজের ছবিগুলির মাধ্যমেই আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার জয়যাত্রা শুরু হয়। চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেতে থাকেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ওয়াশ পেইন্টিং’ পদ্ধতিতে ছবি আঁকতেন। জলরঙ্গে আঁকা ছবিগুলি তিনি বারবার ধুয়ে ফেলতেন যা ওয়াশ পদ্ধতি নামে পরিচিত। এরফলে ছবিগুলিতে রঙের চরিত্র হয়ে উঠত কোমল। ছবিগুলি দৃশ্যমান জগতের চেয়ে বেশি অনুভূতির জগতকে তুলে ধরত।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা উল্লেখযোগ্য চিত্র গুলি হল: শাহজাহানের মৃত্যু, কয়েদী, বাহাদুরশাহ, দেবদাসী, জেবুন্নিসা, কাজরী নৃত্য, পথিক ও পথ, পুষ্পধারা, কবিকঙ্কন, কৃষ্ণমঙ্গল, ত্রয়ী, রবীন্দ্রনাথ (প্যাস্টেল রঙে আঁকা), অভিসার, গণেশ জননী, ঔরঙ্গজেব, শেষ বোঝা, কচ ও দেবযানী (ফ্রোস্কোপদ্ধতিতে আঁকা), শ্বেত অভিসারিকা, ভারতমাতা, কৃষ্ণলীলা সিরিজ, কচ ও দেবযানী, অশোকের রানী, দেবদাসী, কাজরী নৃত্য, অন্তিম শয্যায় শাহজাহান ইত্যাদি। ‘অন্তিম শয্যায় শাহজাহান’ ছবিতে দেখা যায় বৃদ্ধ ও অসহায় সম্রাট তাজমহলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছবিটিতে দিনান্তের আলোর ব্যবহারে একটি বিষাদগ্রস্ত রূপ ফুটে উঠেছে। তাঁর ছোট মেয়ের প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে গেছিল মহামারী প্লেগ। তিনি ‘অন্তিম শয্যায় শাহজাহান’ ছবির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।” অবনীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ছবি রয়েছে।
অবনীন্দ্রনাথের বেশ কিছু চিত্রকলা রয়েছে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি, শান্তিনিকেতনের কলাভবন এবং এ ছাড়াও দেশ-বিদেশে বহু ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহে লাভ করে। শেষ জীবনে তিনি কুটুম কাটাম’ নামে বিখ্যাত আকারনিষ্ঠ বিমূর্তরূপ সৃষ্টি করেন। ভগিনী নিবেদিতা, স্যার জন উডরক, হ্যাভেল প্রমুখের উদ্যোগে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পাদর্শ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি’ স্থাপিত হয়। ভারত ছাড়াও লন্ডনে, প্যারিসে, জাপানে তাঁর ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয় ভারতের পাশাপাশি লন্ডন প্যারিস এবং জাপানেও। তিনি আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ হন ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২১-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যোগদান করেন বাগেশ্বরী অধ্যাপক হিসেবে, শেষজীবনে তিনি বিশ্বভারতীর আচার্য হিসেবে যোগদান করেছিলেন।
চিত্রাঙ্কন ছাড়াও কারুকাজে অবনীন্দ্রনাথ পারদর্শীতা প্রদর্শন করেছিলেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি ফেলে দেওয়া গৃহস্থালীর জিনিসপত্র, কাঠের টুকরো, গাছের শিকড়, ফলের শক্ত খোসা, বীজ, পেরেক, ভাঙা টিনের টুকরো, তুলো, দড়ি ইত্যাদি দিয়ে অদ্ভূত ধরনের এক শিল্পকর্ম প্রস্তুত করেন, যা ‘কাটুম-কুটুম’ নামে খ্যাতি লাভ করে। এগুলির মধ্যে মাছ, বেড়াল, প্রজাপতি, বাদ্যকর, বাউল ইত্যাদি খুবই বিখ্যাত।
মূল্যায়নঃ
পরিশেষে বলা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে সঞ্জীবনী সুধার পরশ দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফলে তার অঙ্কিত চিত্র ভাবুকদের চিত্তে আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই কারণেই ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অনস্বীকার্য। এবং অবনীন্দ্রনাথকে ভারতীয় শিল্পের জনক’ বা ‘শিল্পের গুরু’ বলে অভিহিত করা হয়।