মেগালিথ সংস্কৃতি সম্পর্কে টীকা লেখো।
ভারতবর্ষে লোহার প্রচলন শুরু হয় আনুমানিক ১১০০ খ্রিস্টপূর্ব বা এর কাছাকাছি সময়ে। প্রচলিত ধারণার তুলনায় লোহার ব্যবহারের সূত্রপাতের সময়কাল আরো প্রায় ৩০০ বছর পুরোনো বলে এখন মনে করা হচ্ছে। এই পরিবর্তিত ধারণার পিছনে কিছু মেগালিথ সংস্কৃতি -কে হাজির করা হয়ে থাকে, যার স্রষ্টারা কিছু বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র এবং তার সঙ্গে লোহার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। সমকালীন ভারত ও ভারত সংলগ্ন কিছু এলাকায় বিশেষ ধরনের এই মৃৎপাত্র সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছিল।
এই সংস্কৃতিসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত, বালুচিস্তানের কয়েকটি সমাধিক্ষেত্রে একটি সমজাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। উল্লেখ্য, এর স্রষ্টারা লৌহের ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। এর সময়কাল আনুমানিক ১১০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৭৫০ খ্রিস্টপূর্ব। দ্বিতীয়ত, পেন্টেড গ্রে-ওয়্যার (সংক্ষেপে পি. জি. ডব্লিউ.(P.G.W) বলা হয়) বা চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি নামে একটি সংস্কৃতির নাম খুবই পরিচিত। উল্লেখ্য, উর্ধগাঙ্গেয় উপত্যকার বিশেষত্ব হল এই সংস্কৃতি। এক কথায় উত্তর ভারতের লৌহ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে এই বিশেষ মৃৎশিল্প সংস্কৃতির ধারা সম্পর্কিত। এই সংস্কৃতির সময়কাল আনুমানিক ১১০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৪৫০ খ্রিস্টপূর্ব-এর মধ্যে।
তৃতীয়ত, নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড ওয়্যার (সংক্ষেপে এন. বি. পি.) বা উত্তরের কৃষ্ণ-মসৃণ মৃৎপাত্র নামে একটি সংস্কৃতির নামকরণ করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। গাঙ্গেয় পূর্ব-উত্তরাংশের লৌহযুগের বসতিগুলির সঙ্গে এই সংস্কৃতির নাম জড়িত। এই সংস্কৃতির বিকাশকাল ৫০০ খ্রিস্টপূর্বের পর থেকে। যদিও এর সূত্রপাত ঘটেছে বেশ কিছুকাল আগে আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে। চতুর্থত, দক্ষিণ ভারতের মেগালিথ বা মহাশ্মীয় সংস্কৃতি। প্রসঙ্গত বলা যায় মহাশ্মীয় সমাধিক্ষেত্রগুলিতে লৌহযুগের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। মহাশ্মীয় সমাধিগুলি বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে এই সভ্যতা স্থায়ী হয়েছিল ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত।
![]() |
মেগালিথ সংস্কৃতি |
দক্ষিণ ভারতে লোহার ব্যবহারের সূত্রপাতের সঙ্গে মেগালিথ বা মহাশ্মীয় সমাধি প্রথা জড়িত। দক্ষিণ ভারত বলতে এখানে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত নীচের সমগ্র এলাকাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মেগালিথ সমাধি ছিল কয়েক ধরনের। যেমন—গর্ত সমাধি (পিট বেরিয়াল), কক্ষ সমাধি বা চেম্বার বেরিয়াল, পা লাগানো কোনো কোনো ক্ষেত্রে না লাগানো মৃৎপাত্রে সমাধি এবং স্মারক অর্থে সমাধি। এগুলির আবার বিভিন্ন রকমফের আছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সিষ্ট বেরিয়াল বা চৌবাচ্চার মতো চতুষ্কোণ ক্ষেত্র। সমাধিক্ষেত্রগুলি থেকে প্রাপ্ত লৌহজাত উপকরণ থেকে দক্ষিণ ভারতে লৌহযুগের সূত্রপাত সংক্রান্ত ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়।
দক্ষিণ ভারতে মেগালিথ সমাধিক্ষেত্রের ব্যাপকতর নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রধানত উপদ্বীপীয় ভারতে। প্রধান প্রধান মেগালিথ বা মহাশ্মীয় কেন্দ্রগুলি হল কর্ণাটকের ব্রহ্মগিরি, মাসকি, জনগণহল্লি, হালিঙ্গলি, টেরডাল, নুর ও হাল্লুর মহারাষ্ট্রের জনাপানি ও খাপা; অন্ধ্রপ্রদেশের ইয়েলেশ্বরম, নাগার্জুনিকোণ্ডা ও কেশরপরে এবং তামিলনাড়ুর সানুর, কুন্নাতুর, অমৃथমঙ্গলম ও পইয়মপল্লি। উল্লেখ্য, এগুলির মধ্যে তামিলনাড়ুর চিঙ্গলেপুট জেলার অমৃখমঙ্গলমে একটি এলাকায় বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের দ্বারা চিহ্নিত ২৫০টিরও বেশি পাত্রসমাধি পাওয়া গেছে।
সমাধিগুলিতে লৌহজাত সামগ্রী ছাড়াও কালো ও লাল মৃৎপাত্রের নিদর্শন মিলেছে। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে তামিলনাড়ুরই তিরুনেলভেলি জেলার আদিত্যনাল্লুরে ১১৪ একর জায়গার সমন্বয়ে বিশাল একটি সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। অন্যান্য বিভিন্ন জিনিসপত্র ছাড়াও লৌহজাত যেসব উপকরণ পাওয়া গেছে সেগুলি হল ত্রিশূল, হাঁসুলি, কাস্তে জাতীয় অস্ত্র, বর্শা, তরবারি ও প্রদীপ। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে আদিত্যনাল্লুর ছাড়া অন্য কোনো মেগালিথ সমাধিক্ষেত্র থেকে প্রদীপ আবিষ্কৃত হয়নি। এছাড়া, স্বল্প পরিমাণে হলেও স্বর্ণ সামগ্রীর পরিচাও মিলেছে। এছাড়া, এখানে একসঙ্গে অসংখ্য ব্রোঞ্জের সামগ্রী পাওয়া গেছে, যেগুলির বৈচিত্র্য ও কারুকার্য উল্লেখের দাবি রাখে।” অন্যান্য অঞ্চলের সমাধিক্ষেত্রগুলি থেকে প্রাপ্ত লৌহজাত সামগ্রী প্রায় আদিত্যনান্নুরের মতোই।
লৌহের ঐতিহ্যবাহী মহাশ্মীয় সমাধি দক্ষিণ ভারতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নয়। কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন দক্ষিণ ভারতের মেগালিথ সংস্কৃতি সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মেগালিথিক সভ্যতার হুবহু মিল রয়েছে। এমন কথাও বলা হয় যে পশ্চিম এশিয়া থেকেই মহাশ্মীয় সমাধি সংস্কৃতি উত্তর ভারতে আসে এবং সেখান থেকে দক্ষিণ ভারতে এসে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। এই শ্রেণীর পণ্ডিতদের মধ্যে একজন হলেন রোমিলা থাপার। তবে এই ধরনের মতামত এখনও সমস্ত পণ্ডিত দ্বিধাহীনভাবে মেনে নেননি।
দক্ষিণ ভারতের মেগালিথ মহাশ্মীয় সমাধির ব্যাপারে নানা প্রশ্ন ও সমস্যা এখনও থেকে গিয়েছে। তথাপি সমাধিক্ষেত্রগুলির সূত্র ধরে যে বিষয়টি পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে তা হল গ্রাম গড়ে ওঠার ইতিহাস। বেশিরভাগ পণ্ডিত যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তা হল। আলোচ্য সময়কালে চাষবাসের ভালোই রেওয়াজ ছিল। ধান, গম, বিভিন্ন ধরনের বাজরা, ডাল প্রভৃতির চাষ হত। গবাদিপশু পালন যথার্থ রূপ ধারণ করেছিল। মৃৎশিল্প, কাঠের কাজ ও ধাতুর কাজ যথাযথভাবেই তখন চলছিল। সমাধিগুলির সার্বিক বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতেরা দেখেছেন যে মৃতের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সংখ্যাই বেশি।