পাবনা বিদ্রোহের প্রতি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা কর।
Q – পাবনা বিদ্রোহের প্রতি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি , অথবা অবদান/ ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
1873 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণ, চরিত্র, প্রকৃতি, প্রভৃতি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে। তবে পাবনা বিদ্রোহ যে জমিদার বিদ্রোহী এই বিদ্রোহ যে মূলত সম্পন্ন ও বার্ধষ্ণু কৃষক বা জোতদার শ্রেণীর বিদ্রোহ তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন মত বিরোধ নেই। পাবনা বিদ্রোহে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন – ড: কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত, বিনয় চৌধুরী ও সুপ্রকাশ রায় । পাবনা বিদ্রোহের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
![]() |
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ |
পাবনার বিদ্রোহের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই জমিদার শ্রেণীর শোষণ অত্যাচারের কথা উল্লেখ করেছেন। এই শোষণ ও অত্যাচারের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো যথেষ্ট কর বৃদ্ধি। 1793-1872 সালের মধ্যে করের বোঝা বেড়েছিল সাত গুণ। 1859 সালের দশম আইনকে আগ্রহ করে জমিদারেরা কৃষকদের কাছ থেকে বর্ধিত কর আদায় করত। পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ইউসুফশাহী পরগনা ছিল নাটোর রাজার অধীনে। কিন্তু রাজস্ব বাকি থাকার কারণে এই জমিদারি নিলামে ওঠে এবং তা কিছু ধনী জমিদারি পরিবার কিনে নেয়। এই জমিদারদের মধ্যে ঠাকুর পরিবারের দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর তার জমিদারের খাজনা শতকরা ৫০ ভাগ বাড়িয়েছিল।
1859 সালের আইনে কর বৃদ্ধির সুযোগ কিছুটা সংকুচিত হওয়ায় অনেক সময় জমিদারেরা সরাসরি খাজিনার হার বৃদ্ধি না করলেও নানাভাবে অবৈধ পথে অর্থ আদায় করতো। মূল করের সঙ্গে এইসব আবওয়াব যুক্ত হওয়ায় কৃষকদের পক্ষে এই বোঝা দুর্বাহ বলে মনে হতো। 1872 সালে সরকার আবওয়াব হুলে দিতে তৎপর হয়। জমিদারেরা তখন আবওয়াব থেকে যে টাকা আদায় হতো তা মূল খাজনার সঙ্গে জুড়ে দেয় এবং এর জন্য তারা প্রজাদের কাছ থেকে কবুলিয়ত দাবি করে। আরেকটি অবৈধ পথেও জমিদারেরা কর বৃদ্ধি করতে তৎপর হয়। তাহলে জমি জরিপ পদ্ধতি। নতুন জমিদারেরা তাদের রায়দের জমি এমন অবৈধভাবে জরিপ করে যে তার ফলে কৃষকদের জমির পরিমাণ হ্রাস পায়। তখন সেই বারতি জমি অপর কৃষকদের কাছে নতুনভাবে পত্তনি দেওয়া হয়। এবং তা থেকেও খাজনা আদায় করা হয়।
ড: কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত কর বৃদ্ধিকেই পাবনা বিদ্রোহের প্রধান কারণ বলে মনে করেন না। 1859 সালের দশম আইন জমিদারেরা মেনে নিতে পারেননি। এই আইনে কৃষকেরা যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল জমিদারের দাতা থেকে তাদের বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। অন্যদিকে কৃষকেরা ও তাদের অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিল। সুতরাং তারা জমিদারদের এই প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর ছিল। এই অবস্থায় বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
জমিদারি শোষন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাবনার কৃষকেরা যে সংঘবাদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা ভারতের কৃষক আন্দোলনে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তারা কর দেয় বন্ধ করে ও আদালতের আশ্রয় নিয়ে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়। তারা একটি কৃষক সমিতি গড়ে তোলে। মামলার ব্যয় বহন করার জন্য এই সমিতি এক অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলে। যে সমস্ত গ্রাম বিদ্রোহ হয়, অংশগ্রহণ করত না সেখানে প্রচারক পাঠানো হতো। অনেক সময় অনিচ্ছুক কৃষককে বিদ্রোহের অংশগ্রহণে বাধ্য করা হতো। এক কথায় বলা যায় বিদ্রোহীদের সংগঠন ছিল খুব জোরালো ও মজবুত।
বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল কৃষক বা জোতদার শ্রেণী। নেতাদের মধ্যে দৌলত পুরের ঈশান চন্দ্র রায়, মেসুল্লা গ্রামের শম্ভুনাথ পাল ও জোগতল্লার খুদি মোল্লার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঈশান চন্দ্র কে কৃষকেরা বিদ্রোহী রাজা বলে অভিহিত করত। শম্ভুনাথ পাল ছিল তার সহকারি। সাধারণভাবে গ্রাম প্রধানের কাজ ছিল রায়দদের কাজ থেকে চাঁদা আদায় করা ও গ্রাম স্তরে বিদ্রোহ হয়ে নেতৃত্ব করা। এই বিদ্রোহে ধ্বনি কৃষক শ্রেণীর ভূমিকা প্রধান হলেও অস্থায়ী কৃষক, ভাগ চাষী ও বিভিন্ন কৃষি শ্রমিক ও যারা কর বৃদ্ধির ফলে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তারাও বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল। জমিদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ ও সসন্তোষ ই তাদের এই বিদ্রোহে উৎসাহিত করেছিল।
কি পদ্ধতিতে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
অধ্যাপক বিনয় চৌধুরী ও সুপ্রকাশ রায় মনে করেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল হিংসাশ্রয়ী। তার এই বক্তব্য সম্পন্ন অমূলক নয়। বহু স্থানে বিদ্রোহীরা খর, বাড়ি লুট করে। অনেকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা চতুর্দিকে ত্রাসের সঞ্চার করে। অনেক জমিদারি ভয়ে সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে শহরে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে ড: কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত বলেছেন যে, পাবনা বিদ্রোহে হিংসাশ্রয়ী ঘটনা ছিল নিত্যান্তই অকিঞ্চিকর। বিদ্রোহীরা কখনোই আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়নি বরং তারা সবসময়ই চেষ্টা করত আইনের সীমা অতিক্রম না করতে।
বিদ্রোহের জমিদারদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও বলা যায়। কৃষক সমিতি গর্বিত হওয়ার পর জমিদাররা এই বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি তারা ভেবেছিল উত্তেজনা আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসবে। এবং আদালতে প্রজাদের হার হবে। তবে তাদের এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এই অবস্থায় জমিদারী রাম আদালতে প্রজাদের নানাভাবে হেনস্থা করতে থাকে। স্থায়ী রায়েরদের শায়েস্তা করার জন্য তারা অস্থায়ী রায়তদের পাট্টা দিতে থাকে। জমিদার শ্রেণীতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন, হিন্দু প্যাট্রিয়ট ও অমৃতবাজার পত্রিকা সমর্থন করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ অবশ্য কৃষকদের পক্ষে ছিল। পরের দিকে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ও কৃষকদের ন্যায্য পাওয়া সমর্থন করেছিল। সরকার জমিদার মনোভাবী হয়ে পড়লে বিদ্রোহে ক্রমশ গতি হারিয়ে ফেলতে থাকে। ঈষান চন্দ্র রায় সহ বহু কৃষক নেতা ধরা পড়ে। তাকে অবশ্য পরে মুক্তি দেওয়া হয়।
পাবনা বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়নি এই বিদ্রোহের ফলে 1885 সালে প্রজাস্বত্ব ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই বিদ্রোহ জমিদার বিরোধী হলেও কখনোই প্রত্যক্ষভাবে সরকার বিরোধী ছিল না। আসলে বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল খুবই সীমিত। তাদের কর বয়কটের আন্দোলন উদ্দেশ্য ছিল অবৈধ জরিপ ব্যবস্থার বদল, আবওয়াব বা অবৈধ কর এর বিলোপ করের পরিমাণ হ্রাস শি ইত্যাদি। তারা জমিদারকে কর দিতে না চাইলেও সরকারকে কর দিতে কখনোই আপত্তি করেনি।
পাবনার বিদ্রোহ কতটা সাম্প্রদায়িক ছিল তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের বক্তব্যের সারাংশ হল কৃষক সমিতির অধিকাংশ সমস্যায় ছিল মুসলমান এবং ধৃত অপরাধীদের দুই তৃতীয়াংশ ছিল মুসলমান। অন্যদিকে জমিদারেরা ছিল হিন্দু। সুতরাং পাবনা বিদ্রোহ ছিল হিন্দু মুসলমানের লড়াই। হিন্দু প্যাট্রিয়ট ও হালিশহর পত্রিকা এই মতকে সমর্থন জানিয়েছিল। এই বক্তব্যের তীব্র আলোচনা করে, ড: সেনগুপ্ত বলেছেন যে পাবনা বিদ্রোহের মূল বিষয় ছিল জমিদার ও কৃষকদের শ্রেণী সংঘর্ষ এবং এই সংগ্রাম ধর্মকে কেন্দ্র করে কি করে গড়ে ওঠেনি। রনজিৎ গুহ ড: সেনগুপ্ত এই মদকে সমালোচনা করে বলেছেন যে উনিশ শতকে বাংলার কৃষকেরা ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। তাদের মধ্যে চেতনা সঞ্চারে ধর্ম ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। পাবনা বিদ্রোহের ক্ষেত্র ও তা ব্যতিক্রম হয়নি। মুসলিম ধর্ম পাবনার কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছিল। বিশেষত সারাজি আদর্শ মুসলিম কৃষকদের দিয়েছিল এক সর্বাঙ্গক ঐকের প্রিরনা।
মূল্যায়ন
জমিদারি শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হিসাবে পাবনা বিদ্রোহ বাংলার কৃষকদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়। এর ফলে জমিদারি শোষণ ও অত্যাচারের অবসান না হলেও এই বিদ্রোহ তখন বাংলার গ্রাম জীবনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পাবনা বিদ্রোহের প্রভাব শুধু পাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই বিদ্রোহ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। পার্শ্ববর্তী জেলা বগুড়াতেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল। বস্তুত 1873 থেকে 1883 সালে মধ্য ও পূর্ব বিভিন্ন জেলায় যেমন ঢাকা ময়মনসিংহ ত্রিপুরা এবং রাজশাহীতে কৃষকেরা জমিদারদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বিভিন্ন স্থানে কৃষক সভা স্থাপিত হয়েছিল। যাইহোক এইসব বিদ্রোহের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পাবনা বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ অবদান স্বীকার করতে হবে।