সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি আলোচনা করো। অথবা, শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি।
শিক্ষার সমাজতত্ত্বে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বগুলি শিক্ষার ক্ষেত্রে উপযুক্তভাবে প্রযুক্ত হওয়ার পথনির্দেশ পায়। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানীর মতানুযায়ী সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষা হল সমাজবিজ্ঞানেরই একটি শাখা, যেখানে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের সাহায্যে শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন সমস্যাসমাধানের চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
Emile Durkheim-এর মতে: সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষা হল “Systematic Study of Sociological perspectives”; অর্থাৎ শিক্ষার সমাজতাত্ত্বিক ক্ষেত্রগুলির সুসংবদ্ধ অধ্যয়ন। সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষা শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে তা যথাযথভাবে বুঝতে সহায়ক হয়।
সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষার মূল উপজীব্য হল সমাজের বিভিন্ন উপাদানগুলির মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কীভাবে শিক্ষাকে প্রভাবিত করে তা উন্মোচিত করা। প্রকৃতিগতভাবে বলা যায় এটি শিক্ষাবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর প্রয়োজন ও সম্পর্কভিত্তিক সংমিশ্রণে তৈরি নতুন এক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। এর আলোচনায় বারবার শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রয়োগের দিকটিই অধিক গুরুত্ব পায়। এক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য যে সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষায় কেবলমাত্র বিধিবদ্ধ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয় পরিবার, পরিজন, ধর্মীয় সংগঠন প্রভৃতি সকল বিধিবহির্ভূত শিক্ষার ক্ষেত্রগুলিকে নিয়েও আলোচনা করা হয়ে থাকে।
![]() |
শিক্ষার সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি |
শিক্ষা কীভাবে সামাজিক জীবনের মান তথা সামগ্রিক সমাজজীবনকে প্রভাবিত করে তাও সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষা বিষয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যেতে পারে। সমাজের বিভিন্ন ভালো দিকগুলির উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে শিক্ষার হাত ধরে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাও শিক্ষার প্রভাবে সংশোধিত হয়।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সমাজেরই অংশ। তাই, শিক্ষার লক্ষ্য, পদ্ধতি, পাঠক্রম, মাধ্যম এই সকল কিছুই নির্ধারিত হয় সামাজিক চাহিদা ও সমাজের গতিপ্রকৃতি দ্বারা। যদি শিক্ষার সমাজতত্ত্বকে স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি দিক সম্বন্ধে বলা যেতে পারে—
আন্তর্বিদ্যামূলক:
এই বিষয়ের মূল উপজীব্য বস্তুগলি একই সঙ্গে শিক্ষাবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। কেবল তাই নয় এই দুই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়সমূহের প্রভাবও এর উপর পরিলক্ষিত হয়।
ব্যাবহারিক:
সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি হলো ব্যাবহারিক। সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলির শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনানুগ ও সঠিক প্রয়োগের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপিত হয় সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষায়।
ক্ষেত্র:
সামাজিক গঠন, সামাজিক চাহিদা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার লক্ষ্য, শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠক্রম, শিক্ষার মাধ্যম প্রভৃতি শিক্ষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত ক্ষেত্রে এটি পরিব্যাপ্ত।
আরো পড়ুন – সমাজতত্ত্বের পরিধি সম্পর্কে আলোচনা করো
গুরুত্বদান:
সমাজতত্ত্বের অন্যতম প্রকৃতি গুরুত্বদান। সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষায় অতীতের থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তুগুলিকে অধিক গুরুত্বদান করা হয়ে থাকে। যদিও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কখনোই সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয় না।
প্রয়োগবাদী অভিমুখ:
বহু শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিদগণের মতে এই বিষয়ের গুরুত্ব এর প্রয়োগে। সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষার প্রয়োগের ফলে শিক্ষাবিজ্ঞান তথা শিক্ষাব্যবস্থাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী করা সম্ভব হয়।
ক্রিয়াকলাপ:
সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষার প্রয়োগবাদী প্রকৃতি কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। এ ছাড়াও D W Dodson-এর মতে শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক পরিবেশে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য যেসকল ক্রিয়াকলাপ, সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষা সেগুলিকেই বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।
সংস্কৃতির প্রভাব:
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি হলো সংস্কৃতির প্রভাব। সমাজ ও সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষায় বিভিন্ন সংস্কৃতির ধারাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে।
সমাজতন্ত্রের প্রভাব:
সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষায় বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রভাবও অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক প্রভৃতি ধারাগুলি শিক্ষাব্যবস্থার কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তাও বিবেচিত হয়। সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষা শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় একটি সুনির্দিষ্ট মান গঠন করে তাকে সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভিমুখে পরিচালিত করে যাতে ব্যক্তি তথা সমাজের উন্নতি হয় ও শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয়।