StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

বাংলার উপর ভারত বিভাগের সামাজিক প্রভাব

বাংলার উপর ভারত বিভাগের সামাজিক প্রভাব ব্যাখ্যা কর।

1947 এ এ স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে একইসঙ্গে এসেছিল দেশভাগের বিষাদ। যে বিষাদের মধ্যে মিশেছিল হিংসা, হানাহানি, দাঙ্গার ভয়াবহতা, স্বজন হারানোর কান্না, ঘরবাড়ি হারানোর অসহায়তা, উদ্বাস্তু হয়ে অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকার নির্মম ও নিষ্ঠুর স্মৃতি। বলাবাহুল্য উপমহাদেশের পশ্চিমে পাঞ্জাব ও পূর্ব দিকে দ্বিখন্ডিত বাংলার উপর ভারত বিভাগের সামাজিক প্রভাব এর স্মৃতি ছিল সব থেকে ভয়াবহ বাংলা ও বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব অবর্ণনীয়। সরকারি নথিপত্র স্মৃতিকথা ও তথ্যউপাদান এবং নানা সময়ে প্রকাশিত পত্র পত্রিকা থেকে এই নিষ্ঠুর বাস্তবের কিছু বিবৃতি খন্ডাকার। 

বাংলার উপর ভারত বিভাগের সামাজিক প্রভাব 

বাংলার উপর ভারত বিভাগের সামাজিক প্রভাব দেশভাগ এক নিদারুণ মানব বিপর্যয়ের আখ্যান। এই বিপর্যয় দায়ী সকলেই উপনিবেশিক শক্তিরূপে দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্রিটিশ সরকার রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা অর্জনকারি নবগঠিত ভারতীয় ও পাকিস্তানী সরকার এবং সর্বোপরি ভারতে বসবাসকারী হিন্দু মুসলিম শিক ধর্মাবলম্বী সেই সকল মানুষগণ যারা দাঙ্গা করার সময় বা হিংসাত্মক ঘটনায় লিপ্ত হবার সময় মানবতার মূল ধর্ম ও মনুষ্যত্ব বিস্তৃত হয়েছিল। আর যারা সেখানে হিংসার শিকার হয়েছিল তারা জ্বলন্ত ঘরবাড়ি,অগ্নি লিপ্ত আকাশ,ছিন্ন বিচিত্র মানবদেহ রক্ত স্নাত রাস্তাঘাট, ইত্যাদির স্মৃতিকে দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলতে চেয়েছিলেন। বাংলার উপর ভারত বিভাগের সামাজিক প্রভাব নিম্নে আলোচনা করা হলো–

ন্যায় নীতি বিবহির্ত সময়:

দেশভাগের হিংসা ন্যায়নীতির জগতটাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছিল। অধ্যাপক আশিস নন্দী লিখেছেন সভ্য জীবনের ভিত্তিটাই গিয়েছিল চুরমার হয়ে। জনগণকে প্রজ্ঞা হিসেবে মনে করা ও নিজেকে জনসাধারণের প্রতিভু হিসেবে দায়ী করা রাষ্ট্র কোন সদর্থক দায়িত্ব নেয়নি। সমাজ বিরোধীদের ‘ওরা’ হিসেবে চিহ্নিত করে দায় এড়িয়েছিল। যেমন 1947 এর ডিসেম্বরের পর ভারত পাকিস্তান চুক্তি অনুসারে যখন অপহৃতা নারীদের উদ্ধার আর পুনবাসনের কাজ শুরু করেছিল তখন দেখা যায় যে অপহৃতা, ধর্ষিতা নারীদের অনেকেরই অপহারক বা ধর্ষক পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকে সন্তানের জননীয় হয়েছিল। অনেক নারীই এই পূর্ণবাসন মানতে চাননি তাতে পুনরায় তাদের ঘর ভাঙত কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র সেই আদেশক কান না দিয়ে গ্রামান্তিক সমস্যা তৈরি করে। 

1949 এর 14 ই জানুয়ারি ব্যারাকপুরে জওহরলাল নেহেরুর কাছে উদ্বাস্তুরা দাবি পত্র দিতে গিয়ে পুলিশের লাঠি খেয়েছিল এবং তার প্রতিবাদে 18 ই জানুয়ারি কলকাতায় মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের গুলি খাই তাতে ১০ জনের মৃত্যু হয়।

অবিশ্বাস হিন্দু মুসলিম:

দেশভাগ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম জনমানসে চরম সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বার্তা বরণ তৈরি করেছিল। কিন্তু সমসাময়িক মানুষের জবানবন্দি থেকে জানা যায় যে সে সম্পর্কে ফাটল ধরা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের মেঘ তৈরি হওয়া দুটি দেশ ভাগের সময় আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পায়। 

মনস্তাত্ত্বিক:

পূর্ববঙ্গ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ এর নানা অঞ্চল থেকে প্রায় 11 লক্ষ হিন্দু 1950 এর আগেই তাদের ভিটেমাটি সর্বস্ত ছেড়ে ভারতে চলে আসেন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আধিপত্য স্থাপনকারী মুসলিমরা তাদের কাছে অচেনা হয়ে উঠেছিল এবং যান ও তার থেকেও বেশি মান খেয়ানোর ভয়ে ভীত হয়ে তারা এ দেশে চলে আসেন। বলা বাহুল্য অগ্নিগর্ভে, গর্বিত হিন্দুদের অনেকেই মুসলমানদের নিচে দেখতে চেয়েছিলেন। দেশভাগ পরিস্থিতি পাল্টে দেয় এবং অহংকারে আঘাত লাগার কারণে হিন্দুদের একাংশের মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি হয়। আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার তাগিদে তারা দেশত্যাগী হন। অশোক মিত্র দেখেছেন যে দেশভাগের পর এক ব্রাহ্মণ সপরিবারে দেশত্যাগ করেছিলেন কারণ একদিন এক মুসলমান ব্যক্তি তার বাড়িতে এসে বেক্কে বসেছিলেন। ঐ মুসলমান তার বাড়িতে এলে মেঝেতে পাতা মাদুরের উপরে বসতো। 

নস্টালজিয়া:

আতঙ্কের কারণে বা নিরাপত্তার তাগিদে যারা দেশ ত্যাগের বাধ্য হয়েছিলেন তাদের স্মৃতি কারণে নস্টালজিয়া প্রকাশিত হয়ে পূর্বাশ্রমের স্মৃতি কিছুতেই তারা ভুলতে পারিনি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন অন্যের তুলনায় পার্টিশানে আমরা কমি হারিয়েছি বলতে হবে। তবে হারিয়েছি কৈশোর রূপকথা আর জলজান্তি এক জোড়া নদী রুপসা আর ভৈরব। স্নেহলতা বিশ্বাস লিখেছেন “চোখ বুঝলে আজও দেখতে পাই তপব বনের মত আমাদের সেই বাড়িটা। আমার শ্বশুরমশাই খতম পায়ে গেরুয়া পড়ে বসে ওষুধ দিচ্ছেন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে অসুস্থ মানুষকে”।

হিংস্র হত্যা ও রক্তপাতের স্মৃতিকথা:

যারা প্রত্যেক আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন তাদের কাছে দেশভাগের স্মৃতি হল হিংসা হত্যা ও রক্তপাতের স্মৃতি। সেই স্মৃতি মনে হয় দেশভাগের ফলে মানবতার মৃত্যু ঘটেছিল। 

ব্যতিক্রমী মানবিকতা:

দেশভাগের রক্ত স্নাত বাংলার সমাজে মানবিকতার দৃষ্টান্তিও ছিল কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা ছিল তবে তা বিস্মিত ও অবশ্যই ব্যতিক্রমী প্রবণতা।

শরণার্থীদের বিপদ সঙ্কুল যাত্রা:

ভারত বিভাগের অব্যবহিত পরে বা দেশ ভাগের সময় যারা চলে এসেছিলেন তাদের যাত্রার অভিজ্ঞতা অতটা ভয়ংকর না হলেও কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয়েছিল দেশ ত্যাগ বাসীদের উপর অত্যাচার। সীমান্তে শরণার্থীদের উপর নির্যাতন নিত্য নৌমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল পূর্ববঙ্গ থেকে শিয়ালদহে এসে পৌঁছানো একটি ট্রেনের কামরায় পাওয়া গিয়েছিল কয়েকটি রক্তমাখা ধুতি শাড়ি আর ভাঙ্গা শাখা ময়মনসিংহে ভৈরব ব্রিজের উপর ট্রেন থামিয়ে বৃশংভাবে শরণার্থী যাত্রীদের খুন করে নদীতে মেলে দেওয়া হয়। 

শরণার্থীদের যাত্রা শেষ ও ছিল কষ্টকর দীর্ঘ ও বিপদসঙ্কুল। ঢাকার লোকেরা খুলনা হয়ে শিয়ালদহ- র ট্রেন ধরতাম কুষ্টিয়ার লোকেরা দর্শনা ও সীমান্তে গেদে হয়ে এপার বাংলায় আসেন উত্তরবঙ্গের লোকেরা চলে যাচ্ছিল আসামে ত্রিপুরায় ও শিলঙে , চট্টগ্রামের লোকেরা গোয়ালন্দ পর্যন্ত স্টিমারে এসে ট্রেন ধরেছিলেন। বড় সালের লোকেরা বরিশাল এক্সপ্রেস নামক স্টিমারে মাদারিপুর সেখান থেকে খুলনা হয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বনগাঁ বা শিয়ালদহ বেনাপোল বা দর্শনা সীমান্তে পাকিস্তানের ইঞ্জিন খুলে ভারতের ইঞ্জিন লাগানো হতো। এছাড়াও বিড়লা, বিজু পষ্টনায়ক, প্রমখ বিমানে করে ও মুসলিম শরণার্থীরা এপার বাংলা থেকে ওপার যায় আবার বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরাও এপারে আছে। ট্রেন স্টিমার বা বিমানের জন্য শরণার্থীদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো। ভয়াবহ যাত্রার স্মৃতি ভেসে ওঠে দু স্বপ্নের মত মায়া ভট্টাচার্যের বিবরণে।

নিরাশ্রয় অনাথ শিশু :

বাংলার উপর ভারত বিভাগের সামাজিক প্রভাব ছিল নিরাশ্রয়কৃত। দেশ ভাগ জনিত হিংসায় কত শিশু যে অনাথ হয়েছিল তার কোন হিসাব নেই। শিশুরা হয় বাবা-মাকে হারিয়েছিল অথবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। অনেক অনাথ আবার দেশভাগের আগে ও পরে একাধিকবার নিরাশ্রয় হয়। পূর্ববঙ্গের ভোলা নামক স্থানে অনাথ শিশুদের হোম পরিচালনা করতেন সরসূবালা সেন, দেশভাগের সময় তিনি হোম চালাতে পারেননি, হোমের মুসলমান শিশুদের পাঠিয়ে দেন ঢাকার সলিমুল্লাহ অরফ্যানেজ ও , আর হিন্দু শিশুদের নিয়ে তিনি চলে আসেন এপার বাংলায় দ্বিতীয়বার অনাথ হওয়া এই শিশুদের শেষ পর্যন্ত স্থান হয় ডা: মৈত্রয়ী বসু পরিচালনারধীন ঠাকুরপুকুর শিশুসদান । 

অন্যদিকে 1931 এ ঢাকায় চারুশীলা দেবী কর্তৃক নিরাশ্রয় বালিকাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত আনন্দ আশ্রম 1950 এর দাঙ্গায় বিপন্ন হয়ে পড়ে। তখন ড: বিধান চন্দ্র রায় এর উদ্যোগে অনাথ মহিলাদের নিয়ে সমগ্র আশ্রমটিকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়, প্রথমে দমদমে পরে নাকতলায়। সরকারি ক্যাম্প গুলি থেকে আরো 300 জন অনাথ বালিকাকে এই আশ্রমে আশ্রয় দেওয়া হয়।

পি.এল ক্যাম্প ও উদ্বাস্তু:

পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থীদের অনেকেরই বাংলায় কোন বন্ধুবান্ধব ছিল না। সহায়মম্বলহীনদের মধ্যে ছিল অথর্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নিরাশ্রয় নারী ও অনাথ শিশুরা। নিরাশ্রয় নারীদের মধ্যে ছিল বিধবা , অপহৃতা লঞ্জিতা নারীগণ যাদের আশ্রয় দানকারী পরিবার গুলি দেশভাগের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়াই তারাও নিরাশ্রয় হয়ে পড়েন। সরকারি পরিভাষায় এই সহায়সম্বলহীন্দের চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি’ বা পি.এল বলে। এবং তাদের জন্য তৈরি করা হয়, পি.এল ক্যাম্প নদীয়ার রূপশ্রীপল্লী, ধুবুলিয়া, বধক্কানের নবান নগর, হুগলির বাঁশবেড়িয়া, ভদ্রকালী সহ নানা স্থানে। পরে এই ক্যাম্প গুলি থেকে নিরাশ্রয়দের পাঠানো হয় ‘আনন্দ আশ্রম’ বা ‘উদয় ভিলায়’।

1950 এর দাঙ্গার সময়কালের হিসেবে প্রায় 37,000 নিরাস্রয় মানুষ উদ্বাস্তু নামে চিহ্নিত হয়ে দ্বিতীয় জীবনের নির্দয় বাস্তবের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। সরকারি খাতায় ‘রেফিউজি’ বা ‘পার্লামেন্ট লায়াবিলিটি’– দেশ স্বাধীন কিন্তু তারা নিঃস্ব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top