StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ফরাসী বিপ্লব দারিদ্র্য না প্রাচুর্যের পরিণাম ছিল

ফরাসী বিপ্লব দারিদ্র্য না প্রাচুর্যের পরিণাম ছিল?

ভূমিকাঃ

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ছাড়া মানবজাতির ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের মতো গভীর ও ব্যাপক বিপ্লব আর হয়নি। এই বিপ্লব কেবলমাত্র ফ্রান্সকেই আলোড়িত করেনি, এই বিপ্লবের ফলে সমগ্র ইউরোপকে প্লাবনের তরঙ্গের ন্যায় আঘাত করেছিল। এই বিপ্লব পুরানো জরাজীর্ণ ব্যবস্থাকে সমূলে আঘাত করে নতুন সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করেছিল। তবে ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯) দারিদ্র্য না প্রাচুর্যের পরিণাম ছিল? এরূপ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ফরাসী বিপ্লবের পরিণাম ছিল প্রাচুর্যের কারণ এর ফলে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে  ফ্রান্সে এক নতুন সমাজের সৃষ্টি হয় এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক ধারণার দিক দিয়ে মানুষ অধিকতর প্রগতিশীল হয়ে উঠেছিল।

ফরাসী বিপ্লব প্রাচুর্য ছিল নাকি দারিদ্র্য ছিলঃ

ফরাসী বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামন্ততন্ত্রের উপর প্রচণ্ড আঘাত করে তার অবসান ঘটায়। ১৭৮৯ সালের ১১ই আগস্ট ফরাসি সংবিধান সভা সকল প্রকার সামন্তকর, সামন্ত সত্ত্ব বিলোপ করে। এই ব্যবস্থার দ্বারা দেশত্যাগী অভিজাতদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সামন্তশ্রেণীর বিশেষ অধিকার, সামাজিক মর্যাদা লোপ করা হয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটে সমাজে সাম্যের বাতাবরণ তৈরি হয় যাকে ফরাসি বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ অবদান বলা যায়।

ফরাসী বিপ্লব দারিদ্র্য না প্রাচুর্যের পরিণাম ছিল

সামন্ত প্রথার অবসানের ফলে ফ্রান্সে এক নতুন সমাজের সৃষ্টি হয়। এই সমাজের প্রধান অংশ ছিল কৃষক শ্রেণী। স্বাধীন কৃষক নতুন সমাজ গঠনে বিভোর ছিল। তারা সামন্তদের বাজেয়াপ্ত জমি কিনে সম্পদশালী হয়ে উঠে। ভূমিদাসরা মুক্ত হয়ে স্বাধীন জীবিকা অর্জনের সুযোগ পায়। অবশ্য একথা ঠিক যে ভূমিবণ্টনের দ্বারা সকল শ্রেণীর কৃষকই স্বচ্ছল জীবনযাপনের সুযোগ পায়নি। প্রকৃতপক্ষে ধনী কৃষকরাই বাজেয়াপ্ত জমি কিনেছিল। ভূমিহীন কৃষকদের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ধনী কৃষকদের লেফেভর ‘কৃষক বুর্জোয়া’ বলেছেন।

ফরাসি বিপ্লবের ফলে সমাজে আইনের চোখে সকলে সমান বলে বিবেচিত হয়। যোগ্যতাই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বলে স্বীকৃত হয়। ফলে সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকেরা যারা ছিল অবহেলিত তারা স্বাধীনভাবে জীবিকা গ্রহণের সুযোগ পায়।

ফরাসি বিপ্লবের ফলে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয় এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা যে অচল হয়ে যাচ্ছে তার পথ প্রশস্ত করে দেয় এই বিপ্লব। যদিও নেপোলিয়ান এবং পুনঃস্থাপিত বুর্বো রাজারা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপ্রধানরা একথা স্মরণ করে চলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে তাদের পদ ও ক্ষমতা জনগণের সমর্থনের উপরে নির্ভরশীল। ফরাসি বিপ্লবের এই শিক্ষাকে অস্বীকার করা যায় না।

ধর্মের ক্ষেত্রেও এই বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ধর্ম সম্পর্কে প্রত্যেকের নিজস্ব মতামতকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এমনকি সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে এই বিপ্লব নতুন যুগের সূচনা হয়। সামন্ততান্ত্রিক সম্বোধন ‘মশিয়ে’ পরিবর্তে বিপ্লবী সম্বোধন ‘সিটিজেন’ চালু হয়। ফরাসি বিপ্লবের প্রতীকরূপে তিনরঙা পোশাক ও লাল টুপির ব্যবহার আরম্ভ হয়।

ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব কেবলমাত্র ফ্রান্সের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমগ্র ইউরোপের উপরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। নেপোলিয়ানের আমলে ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে এসে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে নেদারল্যান্ড, নেপলস্, জার্মান, রাইন নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে সামাজিক সাম্য, আইনের চোখে সকলে সমান এবং পরধর্মসহিষ্ণুতা বিস্তার লাভ করেছিল। ইউরোপের সর্বত্র নেপোলিয়ানের আইনবিধি কার্যকর হয়।

আধুনিক জাতীয়তাবাদ ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। বিদেশী আক্রমণের ফলে জাতীয়তাবাদের দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়ে ফরাসিগণ আক্রমণকারীদের বিতাড়িত করেছিল এবং ইউরোপের এক বড় অংশে আধিপত্য স্থাপন করেছিল। ফরাসিদের অনুকরণে ইউরোপের অন্য দেশেও জাতীয়তাবাদ সঞ্চারিত হয়েছিল। আবার নেপোলিয়ানের শাসনের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ স্পেন, জার্মানি ইত্যাদি দেশে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার মূলে ছিল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের জন্যই জার্মানি ও ইতালির ঐক্য সম্পন্ন হয়। নেপোলিয়ানের পতনের পর এই জাতীয়তাবাদের অগ্রগতিকে রোধ করার চেষ্টা হয়েছিল—কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভিয়েনা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

ফরাসি বিপ্লব ব্যক্তিবিশেষের উপর প্রতিফলিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক ধারণার দিক দিয়ে মানুষ অধিকতর প্রগতিশীল হয়ে উঠেছিল। ফলে এদিক দিয়ে দেখলে ফরাসী বিপ্লব ছিল প্রাচুর্যের পরিণাম। বিপ্লবের বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল তার ফলে ভবিষ্যত সম্পর্কে নতুন চিন্তাধারা জন্ম নিয়েছিল।

মূল্যায়নঃ

ফরাসী বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণী প্রধান ভূমিকা নেয় এবং বিপ্লবের ফলে সমাজে যে নতুন ফসল ফলে তা ঐ শ্রেণীর করায়ত্ত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও অন্তঃশুল্ক লোপ পাওয়ার ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। তা সত্ত্বেও ফরাসি বিপ্লব ছিল সুদূর প্রসারী বিপ্লব এতে কোন সন্দেহ নেই। সকল দিক বিচার করে বলা যায়, ফরাসী বিপ্লবের পরিণাম ছিল প্রাচুর্যের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *