আফিম যুদ্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় কী আফিম ছিল আলোচনা করো ?
ইংল্যান্ড ও চীনের মধ্যে সংঘটিত আফিম যুদ্ধকে চীনারা আফিমের যুদ্ধ আখ্যা দিয়েছিলেন, কারণ আফিম সমস্যাই ছিল কেন্দ্রীয় বিষয়। কিন্তু ইংরেজদের কাছে আফিম ছিল উপলক্ষ মাত্র, যুদ্ধের মূল কারণ নয়।
ঐতিহাসিক এইচ এম ভিনাক লিখেছেন : “Opium however, was the occasion and not the cause of the war | between the British and the Chinese”। আফিম যুদ্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় বা প্রকৃত কারণ নিহিত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি, চীনের ক্যান্টন বাণিজ্যের অসম অপমানকর ও কঠোর শর্তাবলী, চীনের ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠত্ব এবং পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলিকে সমমর্যাদা দানে অস্বীকৃতির মধ্যে। অপমানকর কাউটাউ প্রথা ও নজরানা প্রথার অবসান তারা চেয়েছিলেন।
![]() |
আফিম যুদ্ধ (Opium Wars) |
ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে আফিম বাণিজ্যের বিরুদ্ধে চীনের সক্রিয় সংগ্রাম এবং নজরানা প্রথার বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সক্রিয় প্রতিরোধ এই যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। বস্তুত চীন ব্রিটেনকে সমমর্যাদা সম্পন্ন রাষ্ট্রের সম্মান না দিয়ে করদ রাজ্যরূপে গণ্য করে বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা দিতে চাইলে তা ব্রিটিশদের মর্যাদায় আঘাত হানে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্ররূপে ব্রিটেন যেমন চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তেমনি নজরানা না দিয়ে, কাউটাউপ্রথা পালন না করে এবং হং বণিকদের বাণিজ্যিক মধ্যস্থতা দূর করে অবাধ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আরও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল।
তাছাড়া চীনের কনফুসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী চীনের সর্বজনীন প্রভুত্ব (Universal overlordship) ইউরোপীয় জাতীয় সার্বভৌমত্বের (national sovereignty) পরিপন্থী ছিল। বাণিজ্যিক তথা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ভিত উচ্চ-নীচ ধারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। চীনের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার কোন সামরিক ভিত্তি ছিল না এবং আধুনিক যুগোপযোগীও ছিল না। পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে, বিশেষত শিল্পবিপ্লবজাত ব্রিটেন আর্থিক ও সামরিক শক্তিতে কতটা বলীয়ান ছিল সে সম্পর্কে চীনের কোন ধারণাই ছিল না। বহির্বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে সামন্ত্রতান্ত্রিক চীনের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কোন ধারণাই গড়ে ওঠেনি। তাদের এই অজ্ঞতাই এবং অবাধ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে ব্রিটেনের দৃঢ়তাই যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
তাই আফিম সমস্যাকে কেন্দ্রীয় বিষয় করে যুদ্ধ না বাধলেও অন্য কোন বিষয়কে উপলক্ষ করে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
সপ্তম শতকের শেষে অথবা অষ্টম শতকের প্রারম্ভে চীনে আরব ও তুর্কী বাণিকেরা আফিমের প্রচলন শুরু করেছিল। চীনারা আফিমকে ব্যাথা ও উদ্বেগ কমানোর ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করত এবং এর নাম দিয়েছিল Ying-su বা mi- nang অথবা শুধু Po-pi। আফিম নেশার বস্তুরূপে ব্যবহার অনেক পরে শুরু হয়। নেশার বস্তু হিসেবে তামাকের সঙ্গে মিশিয়ে নলে বা পাইপে ব্যবহার প্রথম বিদেশীরাই শুরু করে। চীনে।
১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ফরমোজায় ডাচ উপনিবেশ স্থাপনের পর তামাকের সঙ্গে মিশিয়ে এর ব্যবহার শুরু করে ফরমোজানরা যা ১৬৬০-এর দশকে ফুকিয়েন এবং কোয়াংতুং- এ শীঘ্র ছড়িয়ে পড়ে আফিমের নেশা দ্রুত চীনবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আরামপ্রিয় অলস ব্যক্তিরা আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। যুবা-বৃদ্ধ, ধনী-গরীব চীনের সকল শ্রেণীর জনগণ আফিমের নেশায় আক্রান্ত হ’লে তা জাতীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়। চীনে আফিমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী বণিকেরা বিশেষ করে ইংরেজরা ভারত থেকে এর যোগান দেয়। তাছাড়া চীনের জেচুয়ান ( Szechuan ) মুন্নান (Yunnahn) ফুকিয়েন, চেকিয়াং এবং কোয়াংতুং-এ আফিমের চাষ শুরু হয়।
চীনে আফিমের নেশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে চীনা সরকারের টনক নড়ে। ১৮৩০-র দশকে ছয় মিলিয়ন থেকে দশ মিলিয়ন চীনা অধিবাসী এই নেশার কবলে পড়ে। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে সম্রাট য়ুংচেং (Yung Cheng) (১৭২৩-৩৫) ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে আফিম সেবন এবং আফিমের বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সম্রাট চিয়া-চিং (১৭৯৬-১৮২০) ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে আফিমের আমদানি ও আফিমের চাষ বেআইনী ঘোষণা করেন।
১৮২০ এবং ১৮৩০-র দশকে চীনা সরকারের নৈতিক ভাবনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উদ্বেগও শুরু হয়। কারণ চীনে ব্যাপক আফিম আমদানির ফলে চীনের রৌপ্য বেরিয়ে যাচ্ছিল। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজদের কাছ থেকে আফিম আমদানির নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল ব্রিটেন। এই সময় ইংলিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ভারতে আফিমের চারাগাছ থেকে সম্পূর্ণ তৈরী আফিমের উপর একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেছিল। কোম্পানী ভারতে সস্তা ও ব্যাপক আফিম উৎপাদনের কৌশল রপ্ত করেছিল। আইনগত ভাবে ও সরকারিভাবে কোম্পানী আফিম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। চীনে আফিম ব্যবসার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে কোম্পানী নিজেকে এই ব্যবসার সঙ্গে না জড়িয়ে “Country ship” বা দেশীয় জাহাজের মাধ্যমে আফিমের বন্টন করত। এই “Country Ship”-গুলি কোম্পানীর লাইসেন্স প্রাপ্ত জাহাজ ছিল। প্রকাশ্য সমুদ্র যাত্রায় আফিম পরিবহনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া হত যাতে কোম্পানী কোন আইনী ঝামেলায় না জড়িয়ে পড়ে।
আফিম ব্যবসার নৈতিক এবং অর্থনৈতিক কুপ্রভাবের বিরুদ্ধে চীনা কর্তৃপক্ষ ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আফিম প্রশ্ন নিয়ে কোম্পানীকে কোন প্রশ্ন করেনি চীনা সরকার। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে আফিম বিরোধী আইনকে প্রয়োগ করার চেষ্টা করার পরে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এই বিষয়ে আরেকবার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার এবং জনগণকে প্রথম আফিম ব্যবসার বাণিজ্যিক এবং আর্থিক কুপ্রভাব সম্পর্কে অবগত করা হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের দ্বারা আফিমের চোরা চালান বন্ধ করা রীতিমত কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতিপরায়ণ চীনা কর্মচারীদের উৎকোচ দিয়ে প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা চীনে বাংলা প্রদেশের আফিম রপ্তানি করতে থাকে। এর ফলে চীনা সম্রাটের কোন নিষেধাজ্ঞাই কার্যকর করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ৩রা নভেম্বর চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য রয়্যাল স্যাক্সন জাহাজ বোগের (Bogue) উদ্দেশ্যে রওনা দিলে H.M.S. Volage এর ক্যাপ্টেন এইচ স্মিথ গুলি চালায়। এর ফলে Royal Saxon-এর সঙ্গে যুক্ত চীনা নৌবাহিনীর ২৯টি যুদ্ধ জাঙ্ক জাহাজগুলির একটি ধ্বংস হয়, তিনটি ডুবে যায় এবং আরোও বেশ কয়েকটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইভাবে আফিম যুদ্ধের সূচনা হয়, যেখানে দেখা যায় আফিম সমস্যা-কে কেন্দ্রীয় বিষয় করে যুদ্ধের সূচনা হলেও যুদ্ধের প্রকৃত কারণ আফিম ছিল না। চীনা কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা না করলেও ব্রিটিশ রাজের পক্ষ থেকে ভারত সরকার ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারী যুদ্ধ ঘোষণা করে। দুটি পর্যায়ে যুদ্ধ চলে – প্রথমটি ১৮৪০-৪১ এবং দ্বিতীয়টি ১৮৪১-৪২।