চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্বের মূল্যায়ন কর
Q– চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্বের মূল্যায়ন কর
সর্বভারতীয় স্তরে এদেশে প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্য হিসাবে মৌর্য সাম্রাজ্যের নাম সুবিদিত এবং এর প্রথম শাসক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্বের মূল্যায়ন ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হতে হলে কয়েকটি প্রারম্ভিক বিষয় আলোচনা করে নেওয়া প্রয়োজন। এগুলি হল, কখন ও কী পরিস্থিতিতে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, তাঁর বংশ পরিচয় কী ছিল এবং তিনি কীভাবে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের পত্তন (উত্থান)ঘটিয়েছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্বের মূল্যায়ন
সিংহাসনে আরোহণ:
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ঠিক কবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন সে বিষয়ে দেশীয় সাহিত্য বিশেষত জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্য এবং গ্রিক ঐতিহাসিকদের বিবরণ আমাদের কিছুটা সাহায্য করে থাকে। জৈনগ্রন্থ পরিশিষ্টপর্বণ-এ দাবি করা হয়েছে যে মহাবীরের সিদ্ধিলাভের একশো পঞ্চাশ বছর পর চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। কিন্তু এই মতের কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই। কারণ, অন্যান্য জৈনসূত্র থেকেই এই তথ্য সমর্থিত হয় না। বৌদ্ধ সাহিত্য অনুযায়ী বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণের (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ ) একশো বাধটি বছর পর চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাম্রাজ্য বিস্তার:
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যে পশ্চিম ভারতকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সে বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ আছে। কিছুটা পরবর্তীকালের হলেও পশ্চিম ভারতের শক মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের জুনাগড় স্তম্ভলেখ (১৫০ খ্রিঃ) থেকে জানা যায় যে চন্দ্ৰগুপ্ত মৌর্যের সুরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী (রাষ্ট্রীয়) বৈশ্য পুষ্পগুপ্ত বিখ্যাত সুদর্শন হ্রদ নির্মাণ করেছিলেন। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্ত তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন।
বলাবাহুল্য, মালব অঞ্চল জয় না করে কোনো শাসকের পক্ষে সুরাষ্ট্র শাসন করা সম্ভব নয়। তাই অনুমান করা অমূলক হবে না যে উজ্জয়িনী তথা মালবও তাঁর অধিকারে এসেছিল। মগধ মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হলেও পার্শ্ববর্তী বাংলায় মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল কিনা সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নেই। তবে মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত একটি শিলালেখতে অশোকের অন্যান্য শিলালেখয় ব্যবহৃত ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার থেকে কিন্তু কিছু পণ্ডিত ঐ অঞ্চলটি অশোক ও তাঁর পূর্ববর্তী মৌর্যদের অধিকারে ছিল বলে মনে করেন। নতুন কোনো আকর উপাদান আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এ-বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা:
একটি সাম্রাজ্যের স্থাপয়িতা ও তার সম্প্রসারণের জন্যই কেবল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব নন; বৃহত্তর এই সাম্রাজ্যে এক লক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাও তিনি গড়ে তুলেছিলেন। অর্থাৎ সামরিক সংগঠক ও দক্ষ প্রশাসক উভয়ক্ষেত্রেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের খ্যাতি অম্লান হয়ে রয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকায় তাঁর প্রবর্তিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় (পরে আলোচিতব্য )।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কার্যকলাপের সমালোচনা:
নব প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে দীর্ঘায়ু করে তুলতে হলে যে সুশাসনের প্রয়োজন তা যথার্থভাবে অনুভব করেছিলেন বলেই তিনি এই কাজে মনোযোগী হন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কার্যকলাপের কিছু সমালোচনাও করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান তথ্য হল গ্রিক লেখক জাস্টিনের বিবরণ থেকে উদ্ধৃত একটি উক্তি। জাস্টিন লিখেছেন, চন্দ্রগুপ্ত উত্তর-পশ্চিম ভারতের জনগণকে গ্রিক শাসনের দাসত্ব থেকে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু সেখানে জনগণকে তিনি আবার নিজ দাসত্বে আবদ্ধ করেছিলেন।
জাস্টিনের বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন ঘটনার ন্যায় এক্ষেত্রেও ঐতিহাসিকরা দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে জাস্টিনের বক্তব্যকে যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কিছুটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির শাসক ছিলেন। কিন্তু তাঁর সামগ্রিক শাসনকালের বিভিন্ন ঘটনাপরম্পরা বিশ্লেষণ করলে মনে হয় না যে তিনি তেমন প্রজাপীড়ক বা নিষ্ঠুর ছিলেন। কেননা, তাঁর রাজত্বকালে বেশ কিছু প্রজাকল্যাণমূলক কাজ হয়েছিল। শিল্পকলা ও স্থাপত্য ভাস্কর্যের প্রতিও তাঁর অনুরাগ ছিল। মৌর্য রাজ দরবারে যে অসাধারণ শিল্প সৌন্দর্যের কথা জানা যায় তা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অন্যতম কৃতিত্ব।
উপসংহার:
জৈন গ্রন্থ রাজাবনীকথা থেকে জানা যায় যে, বৃদ্ধ বয়সে চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন পরিত্যাগ করে জৈনগুরু ভদ্রবাহু-র দ্বারা প্রভাবিত হন। শেষপর্যন্ত তিনি মহীশূরের শ্রবণবেলগোলা নামক স্থানে এসে পৌঁছান এবং তপস্বীর জীবন গ্রহণ করেন। আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বে জৈন ধর্মের রীতি অনুযায়ী অনশনের মাধ্যমে তিনি প্রাণত্যাগ করেন।