বাংলার উপর ভারত বিভাগের সাংস্কৃতিক প্রভাব ব্যাখ্যা কর

বাংলার উপর ভারত বিভাগের সাংস্কৃতিক প্রভাব অথবা, বাংলার উপর  দেশভাগের সাংস্কৃতিক প্রভাব।

ভূমিকাঃ

1947 এর ভারত বিভাগের প্রভাব স্বাধীনতার উত্তর কালের বাংলার সাংস্কৃতিক উপর পড়েছিল। বস্তুত ভারত বিভাগের পর এপার বাংলায় চলে আসা ছিন্নমূল মানুষের বিভীষিকাময় স্মৃতি, তাদের অসহায়তা, তাদের সুখ-দুখ সাহিত্য থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র কাদের সৃষ্টি ছিল তার একটি বিষয় হয়ে ওঠে। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে খেলাধুলা বহু জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই দেশভাগের বা বাংলার উপর ভারত বিভাগের সাংস্কৃতিক প্রভাব এর চিহ্নগুলি রয়ে গেছে। তা নিম্নে আলোচনা করা হলো –

সিনেমা বা চলচ্চিত্র ঃ

সত্যজিৎ রায়ের লেখা থেকে জানা যায় যে চল্লিশের দশকের শেষে কলকাতায় এসে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়া একটি উদ্বাস্তু পরিবারের কাহিনী শুনে শিহরিত হন। পূর্ববঙ্গের কোন একটি গ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পর্যন্ত পুরো পথটাই ওই পরিবার নৌকা করে এসেছিলেন। রেনোয়ার মনে হয়েছিল যে, ওই অবিশ্বাস্য ও প্রায় অসম্ভব অভিযানের কাহিনীটি চলচ্চিত্রের আকারে প্রামাণিক করে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

অন্যদেরকে ভারত বিভাগের বেদনা ও দেশ বিভাগের দিনগুলির সামাজিক সংকট প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক কে ব্যাকুল করেছিল। বিভাজনের দশ বারো বছর পরের সময়কালে তিনি সৃষ্টি করেন তিনটি অসামান্য চলচ্চিত্র 1960 এ ‘মেঘে ঢাকা তারা’, 1961তে ‘কোমল গান্ধার’ এবং 1962 তে ‘সুবর্ণরেখা’, তার তিনটি সিনেমাতেই চিত্রিত হয়েছে দ্বিতীয় জীবনে মোটামুটি স্থিত হয়ে যাওয়ার পরও উদ্বাস্তু পরিবার গুলির ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরের মানসিক সংকট। মেঘে ঢাকা তারাতে যেমন বাংলার দুঃসহ জীবনকে প্রকাশ করা হয়েছে কোমল গান্ধারে দেশভাগের ট্রাজেডি, মুখ্য চরিত্র অনুসূয়ার মানসিক দ্বন্দ্ব ও দেশভাগের ফলে ‘Indian People’s Theatre Association’ এ নেতৃত্বে বিভাজনকেও তুলে ধরা হয়েছে। নদীর নামে নামাঙ্কিত ‘সুবর্ণরেখা’ য় পশ্চিমবঙ্গের আশা তিন উদ্বাস্তু এক হিন্দু পুরুষ তার ছোট বোন ও এক নিম্নবর্গীয় বালকের জীবন কাহিনী কে চিত্রিত করা হয়েছে।

Indian People's Theatre Association
Indian People’s Theatre Association

‘Indian People’s Theatre Association (IPTA)’ এর সাহায্য নির্মিত ছিন্নমূল (1950) নামক চলচ্চিত্রটি পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় উদ্বাস্তু হয়ে আসা একদল কৃষকের কাহিনী কে তুলে ধরেছে উদ্বাস্তুদের আশ্রিত মানুষকে এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করানো হয়েছে- কোন মেকআপ ছাড়াই। 2015 সালে শ্রীজিৎ মুখার্জি পরিচালিত রাজকাহিনী দেশ ভাগ উত্তর কালের বাংলায় একদল গণিকার কাহিনী যারা বিভাজনের রেখাকে মানতে চাননি। তাদের গণিতালয় ত্যাগ করতে চাননি। বিভাজন রেখা বা Redcliffe Line তাদের গণিকালয় কে দ্বিখন্ডিত করেছিল। গৌতম ঘোষ এর সখচিল (2016) এর বিষয় দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে এসে একটি পরিবার কিভাবে চিকিৎসা কত কারণে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। 2017 সালে কৌশিক গাঙ্গুলি পরিচালিত ‘বিসর্জন’ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু একটি উদ্বাস্তু বিধবা হিন্দুর সঙ্গে বাংলার এক মুসলিম সমাজবিরোধীর ভালোবাসা কাহিনী। 

অন্যদিকে লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ও শৈবল ব্যানার্জি পরিচালিত মাটি (2018) ছবির বিষয়বস্তু ঢাকায় পৈত্রিক ভিটে দেখতে যাওয়ার কাহিনী। প্রায় অনুরূপ বিষয় নিয়ে তথ্যচিত্র ‘way back home’ (2003) যেখানে পরিচালক সুপ্রিয় সেন তার বাবা-মাকে নিয়ে বাংলাদেশে পৈতৃক বাড়ি দেখতে যাওয়ার কাহিনী কে তুলে ধরেছেন। 2017 সালে প্রযোজিত তথ্যচিত্র সীমান্তরেখা য় বাংলাদেশী পরিচালক তনবীর মোকাম্মেল দেখেছেন দুই বাংলার মানুষের দেশভাগ জনিত কষ্ট।

2017 সালে প্রকাশিত আকরাম খান পরিচালিত ‘খাঁচার’ তে দেখানো হয়েছে এক ব্রাহ্মণ উদ্বাস্ত পরিবার এপার বাংলায় আসতে গিয়ে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হন। 1999 এ মোকাম্মেল পরিচালিত ‘চিত্রা নদীর পারে ‘ তে দেখানো হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও কেন এক হিন্দু পরিবার বাধ্য হয়েছিল অবশেষে দেশ ত্যাগ করতে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে উভয় বাংলার স্বনামধন্য চিত্র পরিচালকগণ দেশভাগ জনিত মানব সমস্যা ও বেদনাকে তাদের চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু রূপে চয়ন করেছিলেন।

সাহিত্যঃ

বাংলার উপর ভারত বিভাগের সাংস্কৃতিক প্রভাব পরেছিল বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস, নাটক, কবিতা  সবক্ষেত্রকেই। উদ্বাস্তুদের দুঃখের জীবন নিয়ে রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক গুলি হল সলিল সেনের নতুন ‘ইহুদি’, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘এই স্বাধীনতা’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘গোত্রান্তির’, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভাৎবগড়া’, ঋত্বিক ঘটকের ‘দলিল’, ‘জ্বালা’, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘মোকাবিলা’ ও ‘মসাল’, তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ ও ‘বাংলার মাটি’, ‘উলুখাড়াড়া’, জলধর চট্টোপাধ্যায়ের ‘থামাও রজপতি’, মুনীর চৌধুরীর ‘মানুষ’, অচিন্ত্য সরকারের ‘সালামের বোন’, অমল রায় এর ‘ধর্মযুদ্ধ’ ইত্যাদি। বিপন্ন মানবতাকে প্রকাশিত করে এই নাটকগুলি, ছিন্নমূল মানুষগুলির বেঁচে থাকার সংগ্রামকে মূর্ত করে তোলে এই নাটক গুলি। আবার 1959 সালে রচিত তুলসী লাহিড়ীর শেষ নাটক ‘লক্ষ্মী প্রিয়ার সংসার’ এ দুর্দিন বেঁচে যাওয়ার আশার বাণীও শোনানো হয়েছে।

নাটকের পাশাপাশি সমকালীন বাংলা উপন্যাসেও উদ্বাস্তু জীবন ও সমস্যার ছবি স্থান লাভ করেছে। প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়া পাতার নৌকা’, অতীত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকন্ঠ পাখির খোঁজ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্জুন, সমরেশ বসুর সুচাদের স্বদেশ যাত্রা, শঙ্করের ‘স্থানীয় সংবাদ’, প্রবোধকুমার সান্যালের ‘হাসু বানু’, নরেন্দ্র নাথ মিত্রের দুরভাষিনী, প্রভৃতি উপন্যাস একদিকে উদ্বাস্তুর আট থেকে যন্ত্রনা। অস্তিত্বের সংকট, দারিদ্র্যের ব্যথা, ক্ষুধার যন্ত্রনা, আত্মমর্যাদা হানির গ্লানি।

অন্যদিকে বিরূপ পরিবেশের প্রতি প্রতিবাদী কন্ঠস্থ্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সরোজ কুমার রায় চৌধুরী নীল আগুন, প্রফুল্ল রায়ের নোনা জল, মিঠে মাটি, নারায়ণ সান্যালের বল্মীক, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘নিশ্চিন্ত পুরের মানুষ‘ , ইত্যাদি উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও উদ্বাস্তুদের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না স্থান পেয়েছে। নারায়ণ সান্যালের ‘বাকুলতলা পি এল ক্যাম্প‘, মনিন্দ্র রায়ের নকসী কাঁথার কাহিনী, কল্যাণ মজুমদারের ‘কোন বাড়ি কাল দেশ‘ শেখর দাসের বিন্দু বিন্দু জল, ইত্যাদি অনেক উপন্যাসেই চিত্রিত হয়েছে প্লাটফর্মের জীবন, ফুটপাতে পড়ে থাকা, রানাঘাটের কুপার্স, বা রায়পুরের ক্যাম্প গুলিতে পোকামাকড়ের মত জীবন কাটানোর বা পূর্ণবাসনের নামে নিষ্ঠুর নিবাসনের দুঃসহ জীবন কাহিনী। 1955 তে মনিন্দ্র রায় নকশীকাঁথার কাহিনীতে লিখেছেন –

“কে দেখেছে জীবনের অপচয় বেশি তার চেয়ে ? কে সয়েছে এত গ্লানি রানাঘাটে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে পথে, উড়িষ্যার তেপান্তরে, জ্ঞানহীন দ্বীপান্তরে আর হাওড়ার স্টেশনে?”

1950 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে 1954 সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুর সংখ্যা 26,62,601 জন। কেবল ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলির ক্যাম্প গুলিতেই ছিল 54,954 জন উদ্বাস্ত। স্বাভাবিকভাবে সংবেদনশীল কবি মনও এই সমস্যা দ্বারা আলোড়িত হয় এবং উদ্বাস্তু জীবনের সমস্যা বাংলা কবিতা স্থান পায়। বিষ্ণুদে’র ‘অন্তিষ্ট সংকলনের ‘জল দাও‘ , জ্যোগীরেন্দ্র মৈত্রের চৌমাথা, দীনেশ দাসের পদ্মা নদীর চরে, এবং ভাঙা গাছ, মার্কসবাদী কবি সমর সেনের ‘নষ্টনীড়’ , কুমিল্লা থেকে কলকাতায় আসা কবি শঙ্খ ঘোষের ‘একা‘, তরুণ স্যানেলের ‘কায়া নৌকায়‘, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আমার স্বপ্ন, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের পূর্ব-পশ্চিম সংকলনের উদ্বাস্তু, ইফতারি অসংখ্য কবিতার মধ্যে দিয়ে দেশভাগের ফলে ভিটেমাটি ছাড়া আর যন্ত্রণা ব্যক্ত হয়েছে।

দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে যে প্রজন্ম পশ্চিমবাংলাতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল তা আজ প্রায় অতীত। 1947-50 এর দশকে যারা কৈশোরে ছিলেন তারাও অনেক পরলোক গমন করেছেন। কেউ কেউ বেঁচে আছেন, ভিটেমাটি ছাড়ার অপরিসীম কষ্ট আর উদ্বাস্তু জীবনের দুর্বিসহ লড়াই ও বেদনার স্মৃতি সে কারণেই ক্রমশ স্ফীন থেকে স্ফীনতর হয়ে আসছে। 

জীবনে ও জীবিকাই অনেকাংশেই স্থিত বাস্তুহারা পরিবার গুলির পরবর্তী বা বর্তমান প্রজন্মের জীবনচর্চায় দেশভাগের নঞর্থক স্মৃতির থেকে স্মৃতির থেকে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে ময়দানে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে ঘটি বাঙালের প্রতিটি লড়াই, বা জীবনে একবার পূর্বপুরুষদের ভিটে দেখার জন্য পাসপোর্ট ভিসা তৈরি করে বাংলাদেশ ভ্রমণ, অথবা বাড়িতে বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে চিতল মাছের মুইঠ্যা বা বরিশালি ইলি শ ভাপা বা কঠুর লতি চিংড়ি মাছ বা কলাপাতার পাতুরীর স্বাদ আস্বাদন করা অথবা পরিবারের মধ্যে বাঙাল ভাষায় কথোপকথন করে ভাষাগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চিহ্ন টাকে বাঁচিয়ে রাখা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *