প্রাচীন রোমের নগরায়ন সম্পর্কে লেখ
প্রাচীন রোমের নগরায়নের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা গ্রেগ উলফ্ উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে,
- খ্রিস্টপূর্ব ৪০-এর দশকের আগে রোমে নতুন শহর গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ অঞ্চলেই অগাস্টাসের সময় থেকে নগরায়ণের সূচনা হয়।
- সব স্থানেই নগরায়ণের পর্যায়ক্রম মোটামুটি একই ছিল। রাস্তা ও মন্দিরের আগে রাষ্ট্রের অট্টালিকাগুলি (public monuments) নির্মিত হয়েছিল।
- প্রাচীন রোমের নগরায়ন গঠনের প্রক্রিয়া বহু প্রজন্ম ধরে চলেছিল। এই প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, রোমের বাইরে থেকে স্থপতি, হস্তশিল্পী ও উপকরণ আমদানি করা হত।
পশ্চিম ভূমধ্যসাগর থেকে ফিনিশিয়ান ও গ্রিক অভিপ্রয়াণের সাথে ইটালির নগরায়ণ জড়িত। খ্রিস্টপূর্ব নবম ও অষ্টম শতাব্দী থেকে এরা ইটালিতে প্রবেশ করতে থাকে এবং নানা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী শক্তি সঙ্গে নিয়ে আসতে শুরু করে। ইটালির লৌহ যুগের সাথে এই নবাগত সংস্কৃতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমে বাণিজ্য দিয়ে শুরু হলেও কোথাও কোথাও ঔপনিবেশিকরণও হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ফিনিশিয়ানরা উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম সিসিলি এবং দক্ষিণ স্পেনে ও গ্রিকরা পূর্ব সিসিলি, দক্ষিণ ইটালি এবং ভূমধ্যসাগরীয় ফ্রান্সে বসতি স্থাপন করে।
রোম এই দুইয়ের মধ্যে অবস্থিত ছিল, যাকে বলা হয় পুরোনো ল্যাটিয়াম (Old Latium)। খ্রিস্টপূর্ব নবম ও অষ্টম শতাব্দীতে রোমের সংস্কৃতি তার প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে ভিন্ন ছিল এবং এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। রোমে এই সময়কার প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে দারিদ্র্যের স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। ইটুস্তান নগর, যেমন— তেই, টার্কুইনি এবং কেরে ও গ্রিক নগর, যেমন—কিউমে এবং নেপলস্ ইত্যাদির সাথে রোমের নগরের কোনো তুলনাই করা যেত না। ল্যাটিয়ামের উত্তরে নগর বলতে বরং কয়েক গুচ্ছ গ্রামকে (cluster of villages) বোঝাত।
প্রত্যেকটি রোমান শহরের নকশা সাধারণত নির্ভরশীল ছিল দুটি প্রধান অক্ষ পথের আড়াআড়ি ভাবে পরস্পরকে ছেদ করার ওপর। এই দুটি অক্ষ পথ হল, কার্ডো ম্যাক্সিমাস (cardo maximus ), যেটা উত্তর-দক্ষিণে চলে গেছে এবং ডেকুমানুস ম্যাক্সিমাস (decumamus maximus), যেটা পূর্ব-পশ্চিমে চলে গেছে। এছাড়া ছিল অসংখ্য অপ্রধান সড়ক পথ যেগুলো দিয়ে ব্লক তৈরি হত এবং এদের বলা হত ইন্সুলে (insulae)। এখানে বসত বাড়ি নির্মাণ করা হত। এই নকশার কেন্দ্রে ছিল একটি পৌর কেন্দ্র বা ফোরাম, মন্দির, থিয়েটার, আম্ফিথিয়েটার ইত্যাদি।
সম্প্রতি উৎখননের ফলে বহু কুঁড়ে ঘর ও কবর আবিষ্কৃত হয়েছে যার তারিখ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী মনে করা হচ্ছে, কিন্তু তার থেকে প্রাচীন রোমের নগরায়ন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে ক্রমে প্যালাটাইনের উত্তরের জলাভূমি শুষ্ক হয়ে গিয়ে ফোরামটি তৈরি হয়। ফোরাম একটি সাধারণ বাজার-চত্বর থেকে খোলা আকাশের নীচে এক বিরাট প্রদর্শনীশালায় উন্নীত হয়। প্রস্তর নির্মিত প্রধান প্রধান রাজপথগুলি ফোরামে এসে মিলত। প্রায় প্রত্যেক সম্রাটই খ্যাতি অর্জনের জন্য ফোরাম চত্বরের উপর জমকালো ইমারত তৈরি করতেন এবং নিজের মূর্তি স্থাপন করতেন। ফোরামের একপাশে ছিল প্যালাটাইন টিলা। তার ওপর শ্বেতপাথরের তৈরি স্বর্ণখচিত রাজপ্রাসাদ অবস্থিত ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে বৃহৎ বৃহৎ প্রাচীর নির্মিত হতে থাকে। ক্যাপিটোলের চারদিকে সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরগুলি এই সময়ই গড়ে ওঠে। এই সমস্ত প্রকল্পে নিঃসন্দেহে বিপুল পরিমাণে লোকবল নিযুক্ত হয়েছিল যা থেকে এক ধরনের যৌথ সংগঠনের আভাস মেলে। প্রকাণ্ড অভিজাত আবাসনগুলির ধ্বংসাবশেষ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর বলেই প্রমাণিত হয়েছে। অতএব বলা যায়, এই সময়ে রোম বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত হয়ে বেশ কিছু কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান সহ একটি নগরে পরিণত হয়েছিল। তবে জেলার বিভাজন নিতান্তই প্রাথমিক স্তরে ছিল। ফোরাম বা শহরের কেন্দ্রে সবরকম বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কার্যাবলী সম্পাদিত হত। ক্যাপিটোলাইন পূর্বত বহুদিন যাবৎ ধর্মীয় উপাসনালয় ছাড়াও নগরদুর্গ বা সিটাডেল রূপে গণ্য হত।
রোমের সঙ্গে গ্রিক শহর এথেন্স কিংবা করিন্থের তুলনায় ইস্কান শহর ভেইয়ের মিল বেশি পাওয়া যায়। রোমের প্রায় সর্বত্র গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ইস্কান মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে, যাকে বুচেরো (bucchero) বলা হয়। ইটুস্কানদের সদৃশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, পরিবেশ এবং ভূতত্ত্ব মধ্য ইটালিতে এক আঞ্চলিক নগরায়ণের জন্ম দেয়। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, কীভাবে ল্যাটিয়াম সংস্কৃতির দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়ে রোম ইটুরিয়ার মহান নগর সভ্যতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল।
রোমের ভৌগোলিক অবস্থান অবশ্যই তার একটা কারণ। ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতায় টাইবার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নদী না হলেও রোমকে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুলভতা দান করেছিল। টাইবার উপত্যকা থেকে কাঠ ও নির্মাণ কার্যে ব্যবহৃত পাথর আসত। এর শাখানদী থেকে জল-প্রণালী ও কাদামাটি থেকে ইট প্রস্তুত করা হত। ধাতু কিংবা খাদ্যশস্য কোনোটার জোগানই রোমে ভালো ছিল না। কিন্তু বহিঃবাণিজ্যের উন্নতির ফলে সেই প্রয়োজনও পূরণ করা হত। টাইবারের উত্তরে ইস্তান ও দক্ষিণে ল্যাটিন, রোমে এক মিশ্র সংস্কৃতির (hybrid) জন্ম দেয়। তাই ইটুস্কান প্রভাব থাকা সত্ত্বেও রোমানদের ভাষা ছিল ল্যাটিন। রোম কিন্তু প্রথম দিকে ইটুমান রাজনীতির কেন্দ্র ছিল না। লৌহযুগে পার্সিয়ানরা একে-একে মিশর, অ্যাসিরিয়া, ব্যাবিলোনিয়া এবং বিভিন্ন সিরিয়ান ও অ্যানাটোলিয়ান রাষ্ট্র দখল করে নিলে এদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ইতি পড়ে। ফলে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে রোম ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসতে শুরু করে।
প্যাক্স রোমানার (Pax Romana) প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে রোমের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন রুমে নগরায়ণ এবং শহরে বুর্জোয়া শ্রেণির সমৃদ্ধির অনুযস হয়ে ওঠে। এই শহুরে বুর্জোয়াই ব্রিটেন, গল এবং স্পেনের নতুন নতুন অঞ্চলে শহরে জীবনযাত্রার প্রসারে সাহায্য করে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্ডারের পরে গ্রিক বুর্জোয়া শ্রেণি নিকট ও মধ্য প্রাচ্যের গ্রিক শহরগুলিতে জড়ো হতে থাকে এবং হেলেনীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে থাকে। এই গ্রিক শহরগুলি আধুনিক শহরের তুলনায় আকারে অনেক বড়ো ছিল। এবার ইটালিয়ান বুর্জোয়ারা এই পদ্ধতিই গ্রহণ করল এবং রোমান সম্রাটের সাহায্যে পশ্চিমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পশ্চিমের মতোই পূর্বেও তাদের আগমন ঘটতে দেরি হল না।
প্রিন্সিপেটের প্রতিষ্ঠার ফলে নতুন নতুন আবাসন গড়ে উঠল, এবং তার সাথে স্থানীয় মুদ্রাও নবজীবন লাভ করল। বিশেষ করে ফ্লাভিয়ান সম্রাটদের রাজত্বকালে (৬৯-৯৬ খ্রিস্টাব্দ) পশ্চিমের নতুন নতুন এলাকায় সভ্যতার বিস্তার ঘটতে লাগল। বিভিন্ন শহরের নির্মাণে রোমানীয়করণের ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, যেমন— উত্তর আফ্রিকার টিমগাড (থাউমুগাডি), ব্রিটেনের সারওয়েন্ট, সাইরেনসেস্টার, লন্ডন এবং কলচেস্টার, গলের অটুন ও ভাইসন এবং রোমান জার্মানির ট্রায়ার ও হেডারনহেইম (ফ্রাঙ্কফুর্ট-আম-মাইনের কাছে) উল্লেখযোগ্য। রাইন, দানিয়ুব ও আফ্রিকার বহু সামরিক ঘাঁটিকে নগরে পরিণত করা হয়েছিল। এই সময় এশিয়া ও সিরিয়ার সঙ্গে বস্ত্রশিল্পের যে রপ্তানি বাণিজ্য হত তা আরো বৃদ্ধি পায় এবং এখানেও নগরায়ণ ঘটতে থাকে। এই সকল শহরে, যার আয়তন ২০ থেকে ৫০০ একর, তাদের নিজস্ব সুপরিকল্পিত প্রশস্ত সম্মেলন স্থান এবং জনগণের নিমিত্ত অট্টালিকা ছিল। এছাড়া ছিল দোকানপাট এবং আবাসনসহ জনগণের স্নানাগার এবং থিয়েটার। এই শহরগুলি ব্রিটেন ও গলের মতো দেশে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে।
রোমান সাম্রাজ্যের গ্রামগুলি হেলেনীয় নগর সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। গ্রামীণ শাসন ব্যবস্থায় নগরের হস্তক্ষেপ ছিল না। পৌর অভিজাত সম্প্রদায়ও এক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ দেখাত না। অর্থাৎ নগর সংগঠনের তলায় গ্রামগুলি নিজেদের মতো স্থানীয় অ-গ্রিক রাজনৈতিক জীবনযাপন করত। মিশেল গ্রান্ট বলেছেন, রোমানদের মধ্যে নগরায়ণের প্রতি একটা স্বাভাবিক প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়।
পশ্চিমের মতো পূর্বেও উপজাতি এককগুলি যথেষ্ট উন্নতিলাভ করলে এবং ‘নিরাপদ’ হলে সাম্রাজ্যবাদী সরকার তাদের নগরে উন্নীত করত। তবে এই প্রক্রিয়া সুচিন্তিত হলেও খুব একটা গভীরতা লাভ করেনি। ২68-290 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নগরায়ণের প্রক্রিয়ার উদাহরণ পাওয়া যাবে পূর্বের বিভিন্ন রোমান নগরের মুদ্রায়। কয়েকটি পুরোনো উপনিবেশের মুদ্রা রোমান মডেল অনুসরণ করলেও নতুন মুদ্রাগুলি মূলত গ্রিক নকশা ও লিপি ব্যবহার করত। কিন্তু খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী নাগাদ গ্রিক হেলেনীয় রাজক্ষমতার আধিপত্য ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়লে রোমান মুদ্রাতেও তার প্রভাব পড়ে।
পূর্ব ও পশ্চিম উভয় শহরের ক্ষেত্রেই প্রাদেশিক সভার (provincial council) অস্তিত্ব ছিল, যা সম্রাটের আরাধনা এবং রোমানীয়করণের প্রসারের কেন্দ্র স্বরূপ কাজ করত; কিন্তু বিশেষ করে পূর্বে, যেখানে রোমান অভিযানের আগে থেকেই সভার অস্তিত্ব ছিল, সেখানে এখন থেকে রোমান সম্রাটের ইচ্ছে অনুযায়ী কার্যকলাপ পরিচালিত হতে লাগল। আগে এদের কাজের মধ্যে খুব একটা সামঞ্জস্য না থাকলেও একটা তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিমের প্রদেশগুলির মধ্যে রোম এবং ইটালির নগরের প্যাটার্ন অনুসরণ করে নির্মিত শহরগুলিতে বার্ষিক ম্যাজিস্ট্রেট ও অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন সেনেটের দ্বারা শাসন করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এই সেনেটের সদস্যদের সারা জীবনের জন্য নিয়োগ করা হত।
প্রাথমিক সভাগুলির ভূমিকা ছিল নগণ্য এবং সরকার ছিল অলিগার্কিক। কিন্তু এখন থেকে রোমান সম্রাটের অধীনে পূর্বেও পশ্চিমের প্যাটার্ন অনুসরণ করা হয় যার থেকে দুই প্রকার ফল হয় : সম্পদশালী শ্রেণির হাতে ক্ষমতা চলে আসে এবং আমলাতান্ত্রিক দখলদারি বৃদ্ধি পায়। গৃহযুদ্ধের ফলে রোমান সেনেট ও রোমান ভূস্বামীদের অভিজাত সেনেটোরিয়াল শ্রেণির পরাজয় ঘটলে এবং টিবেরিয়াস থেকে নেরোর রাজত্বকালে জুলিও-ক্লডিয়ান রাজবংশের সন্ত্রাসে তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ইটালির বুর্জোয়া শ্রেণি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইটালি ও প্রদেশগুলির উচ্চ শ্রেণি রোমানীয়করণে এবং পশ্চিমের নগরায়ণে সম্রাটকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। কিন্তু উল্লেখ্য যে এত সাম্রাজ্যবাদী উৎসাহ প্রদান করা সত্ত্বেও নগরায়ণ আগেকার হেলেনীয় নগরায়ণের মতো গভীর ও সর্বব্যাপী হতে পারেনি এবং অর্থনৈতিকভাবেও এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার প্রদেশগুলি থেকে পশ্চিম অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। এর থেকে বোঝা যায় পশ্চিমের থেকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ছিল।