পল্লবদের উৎপত্তি ও আদি বাসস্থান।
ভূমিকা :
ভারতবর্ষে শাসনরত অন্যান্য রাজবংশের ন্যায় পল্লবদের উৎপত্তি তথা আদি বাসস্থান সংক্রান্ত বিষয়টি যথেষ্ট বিতর্কিত। এই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি। বেশ কিছুকাল আগে বি. ভি. কে. রাও এ হিস্ট্রি অফ দ্য আর্লি ডাইন্যাস্টিজ অফ অন্ধ্রদেশ নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “পল্লবদের উৎপত্তির ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত।” এরপর নানা পণ্ডিত এই বিষয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন।
পল্লবদের উৎপত্তি ও আদি বাসস্থান:
প্রসঙ্গত বলা যায় পল্লবদের লেখমালা এবং স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে তাঁদের আপাতদৃষ্টিতে তোণ্ডমণ্ডলমের সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়। তোণ্ডমণ্ডলমের অবস্থান ছিল উত্তর পেন্নার ও উত্তর ভেল্লারের মধ্যবর্তী অঞ্চল, যার প্রধান নগর ছিল কাঞ্চী। কিন্তু তামিল ঐতিহ্য অনুযায়ী চোল, পাণ্ড্য ও কেরল রাজ্যগুলির ন্যায় তোণ্ডমণ্ডলম ঐ অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
পল্লবদের প্রথম দিকের লেখগুলি প্রাকৃত ভাষায় এবং পরের দিকের লেখগুলি সংস্কৃত ভাষায় লেখা এবং প্রথম পর্বের শাসকদের অনেকেই ‘ধর্মমহারাজ’ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। এস্থলে মনে রাখা দরকার সঙ্গম যুগের শাসকদের ন্যায় তাঁরা কিন্তু তামিল ভাষা-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। এছাড়া আদি পর্বের পল্লবদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন শাসনব্যবস্থার অনেকাংশে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আবার সাতবাহন শাসনব্যবস্থা অনেকাংশেই কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নির্ভর। এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে পদ্মবদের লেখমালা ও স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিদর্শনসমূহ তোণ্ডমণ্ডলম ও সংলগ্ন অঞ্চলে পাওয়া গেলেও আদি পর্বের পল্লবদের সঙ্গে তোগুমণ্ডলমের সম্পর্ক কতখানি ছিল সে বিষয়ে প্রশ্ন ও কৌতূহল থেকেই যায়।
এক শ্রেণীর পণ্ডিত পল্লবদের বিদেশীয় উৎপত্তির তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বি. এল. রাইস ও ভি. ভেনকয়। এঁরা পল্লবদের সঙ্গে পারসিক পহ্লব বা পার্থিয়ানদের এক ও অভিন্ন বলে মনে করেন। এঁদের মনে হয়েছে পহ্লব বা পল্লবরা প্রথমে উত্তর-পশ্চিমাংশে বাস করত এবং পরে দাক্ষিণাত্যে সাতবাহনদের পতনকালে তোওমণ্ডলমে বাসবাস করতে থাকে। কিন্তু এই মত বেশিরভাগ ঐতিহাসিক কর্তৃক গৃহীত হয়নি। কেননা, উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে পহ্লবদের কাঞ্চী তথা তোণ্ডমণ্ডলম এলাকায় অভিপ্রয়াণের কোনো ইতিহাসনির্ভর ও তথ্যনিষ্ঠ প্রমাণ নেই।
পহ্লবদের সঙ্গে পল্লবদের শনাক্তকরণ যে সঠিক নয় তার আরো অনেক প্রমাণ আছে। কনৌজের ওর্জর প্রতিহার রাজদরবারে বিখ্যাত কবি রাজশেখরের জন্মস্থান ছিল দাক্ষিণাত্যে। খ্রিস্টীয় দশম শতকের এই কবি তাঁর কাব্যমীমাংসায় পহ্লব ও পল্লবদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে পহ্লবরা সিন্ধু পরবর্তী অঞ্চলের এবং পল্লবরা দক্ষিণ ভারতের আধিবাসী ছিলেন। পল্লবদের প্রথম দিকের শাসকেরা নিজেদের ভরদ্বাজ গোত্রীয় বলে দাবি করতেন। অপরদিকে পহ্লব তথা পারসিকদের কোনো গোত্র পরিচয় ছিল না। এছাড়া, পল্লবদের ন্যায় পহ্লব তথা উত্তর-পশ্চিম ভারতের কোনো বিদেশীয় শাসক কখনো অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করেননি। সুতরাং দক্ষিণ ভারতের পরবরা বিদেশীয় ছিলেন, এই মত গ্রহণযোগ্য নয়।
পল্লবদের উৎপত্তি দক্ষিণ ভারতেই তামিল ভাষাভাষী অঞ্চলে এইরকম ধারণায় বিশ্বাসী কিছু ঐতিহাসিক রয়েছেন। এই পর্যায়ের ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন এস. কে. আয়াঙ্গার। তিনি মনে করেন পল্লবরা ছিলেন সাতবাহনদের সামন্ত এবং সাতবাহন সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে প্রাদেশিক শাসক বা সরকারি কর্মচারী পদে হয়তো তাঁরা অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি আরো মনে করেন ‘তোণ্ডাইয়ার’ ও পল্লব শব্দ দুটি এক ও অভিন্ন। কেননা, তোণ্ডাইয়ার শব্দটির সংস্কৃত অর্থ হল পল্লব।
অপর পণ্ডিত এম. রসনায়কমও মনে করেন যে পল্লবরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতের তামিল এছাড়া ঢোল ও নাগ বংশের সঙ্গে উৎপত্তিগতভাবে তাঁদের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক ছিল। এইভাবে পল্লবদের তামিল উৎপত্তির বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই মত গ্রহণের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দ্বিধা ও সংশয় আছে। জিজ্ঞাসু পাঠকের মনে এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই জাগবে যে যদি পল্লবরা আদিতে তামিল ও তোওাইমগুলমের অধিবাসী হন, তাহলে তাদের প্রথমদিকের লেখমালায় স্থানীয় তামিল ভাষার ব্যবহার না ঘটে কেন প্রাকৃত ও তামিল ভাষার ব্যবহার ঘটিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক আর. সথিয়ানথিয়েরও মনে করেন তোণ্ডমণ্ডলম পল্লবদের উৎপত্তির প্রধান কেন্দ্রস্থল। তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একটু ভিন্ন। আর. সি. মজুমদার (সম্পাদিত) দ্য ক্লাসিক্যাল এজ গ্রন্থে “দ্য পল্লবস” নামে একটি প্রবন্ধে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে ‘পুলিন্দ’ থেকে পল্লব শব্দটি এসেছে। অশোকের কয়েকটি লেখতে ‘পুলিন্দ’ শব্দের উল্লেখ আছে। তিনি আরো মনে করেন যে, তোণ্ডমণ্ডলম অশোকের সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ ছিল এবং দীর্ঘপ্রায় পঞ্চাশ বছর তা মৌর্য শাসনের আওতায় ছিল। এরপর তোণ্ডমণ্ডলমে সাতবাহনদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পল্লবরা প্রথমে সাতবাহনদের অধীনে সামন্ত ছিলেন। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের প্রথম দিকে সাতবাহনদের পতন ঘটলে স্বাধীন শক্তি হিসাবে পল্লবদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই তত্ত্ব উপস্থাপনের মাধ্যমে সথিয়ানথিয়ের দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে যেহেতু পল্লবরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৌর্য ও সাতবাহনদের সঙ্গে আদিতে যুক্ত ছিলেন সেহেতু তাদের প্রথম নিকের লেখতে তামিলের পরিবর্তে প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার অস্বাভাবিক নয়। ঐ একই ধারায় সাতবাহনদের সঙ্গে পল্লবদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার মিলও খুঁজে পাওয়া যায়।
সথিয়ানগিয়েরের তত্ত্বের কিছু ইতিবাচক দিক আছে। তবে তোওমণ্ডলম পল্লবদের আদি বাসস্থান ছিল তাঁর এই মত সর্বজনগ্রাহ্য নয়। কারণ ‘পল্লব’ শব্দের সঙ্গে অশোকের লেখায় উল্লেখিত ‘পুলিন্দ’ শব্দের শনাক্তকরণ সঠিক নয়। সথিয়ানখিয়েরের ঐ বক্তব্যের বিরোধিতা করে টি. ভি. মহালিজম এ ব্যাপারে নতুন যুক্তি উত্থাপন করেছেন।
পল্লবদের উৎপত্তির ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি দক্ষিণ ভারতের আর একটি শক্তি সালঙ্কায়নদের সঙ্গে পল্লবদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন নাম, গোত্র, লেখর ভাষার ব্যবহার প্রভৃতি সাদৃশ্যের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে এই দুটি শক্তিই কেবল দক্ষিণ ভারতে ভরদ্বাজ গোত্রীয় ছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন, পল্লবরা একেবারে প্রথম দিকে সাতবাহনদের শাসনাধীন নেল্লোরে সামন্ত শাসক হিসাবে শাসন করতেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে, সাতবাহনদের একটি প্রধান শাখা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকায় এঁদের নাম হয়েছিল পল্লব। এরপর ধীরে ধীরে পল্লবদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নাগবংশের সঙ্গে তাঁরা বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। পরে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দক্ষিণে কাঞ্চীকে কেন্দ্র করে একটি স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ঘটান।
পল্লব রাজাদের সাধারণভাবে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে — আদি পল্লব এবং মহান পল্লব। আদি পল্লবরা আবার দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের অন্তর্ভুক্ত সেই সমস্ত শাসক, যাঁরা তাঁদের লেখ বা তাম্রশাসনে প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করতেন। এই পর্বের শাসকদের সময়কাল ২৫০-৩৫০ খ্রিস্টাব্দ, যা তাম্রশাসনগুলির ভিত্তিতে বোঝা সম্ভব হয়। দ্বিতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত হলেন সেই সমস্ত পল্লব শাসক, যারা তাদের লেখ বা তাম্রশাসনে সংস্কৃত ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। এই দ্বিতীয় পর্বের শাসকদের শাসনকাল আনুমানিক ৩৫০ খ্রিঃ-৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ।
আদি পল্লবদের প্রথম পর্বের (অর্থাৎ প্রাকৃত ভাষা ব্যবহারকারী) চারজন শাসকের নাম জানা যায়। এঁরা হলেন যথাক্রমে— সিংহবর্মন, শিবন্ধন্দবর্মণ, স্কন্দবর্মণ এবং বিষগোপ। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শিবস্কন্দবর্মণ। তাঁর শাসনাধিকার কৃষ্ণা নদী থেকে দক্ষিণে পেন্নার নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। এই পর্বের শেষ শাসক বিদুৎগাপ ছিলেন গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সমসাময়িক। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উল্লেখিত সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক দক্ষিণাপথের পরাজিত বারো জন রাজার মধ্যে কাঞ্চীর বিষ্ণুগোপ ছিলেন একজন। অর্থাৎ খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের প্রথমার্ধে কোনো এক সময় তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন।
সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারকারী আদি পর্বের পল্লব শাসকরা হলেন যথাক্রমে প্রথম কুমারবিষ্ণু, বুদ্ধবর্মণ, দ্বিতীয় কুমারবিষ্ণু, দ্বিতীয় স্কন্দবর্মণ, সিংহবর্মণ (৪০৬-৫৮ খ্রিঃ), তৃতীয় স্তন্দবর্মণ, প্রথম নন্দিবর্মণ, শান্তিবর্মণ (আঃ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের গোড়া) ও দ্বিতীয় সিংহবর্মণ (আনুঃ ৫৫০-৫৭৫ খ্রিঃ)। দ্বিতীয় কুমারবিষ্ণুর চেনদালুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে তিনি ছিলেন স্তন্দবর্মণের প্রপৌত্র, প্রথম কুমারবিষ্ণুর পৌত্র এবং বুদ্ধবর্মণের পুত্র। আবার প্রথম নন্দিবর্মণের উদয়েদিরাম তাম্রশাসন থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে তিনি ছিলেন তৃতীয় স্বন্দবর্মণের পুত্র এবং প্রথম সিংহবর্মণের পৌত্র। এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আদি পল্লবরা শাসন করেছিলেন।
মূল্যায়ন:
দীর্ঘ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে, পল্লবদের উৎপত্তি ও আদি বাসস্থান এর ইতিহাস অনেকটাই অন্ধকারে ঢাকা। এই বিষয়ে খ্যাতনামা পণ্ডিতদের নানা মতামত উত্থাপিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনো একটি বিশেষ মত সর্বজনগ্রাহ্য নয়। অনেকাংশেই অনুমানমাত্র। এমনকি সবশেষে আলোচিত টি. ভি. মহালিঙ্গমের তত্ত্ব যে সঠিক তাও জোর করে বলা যাবে না। আসলে এ ব্যাপারে উপযুক্ত তথ্যের অভাব নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিস্তৃত আলোচনার দরুন যে বিষয়টি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে তা হল পল্লবদের সঙ্গে পহ্লব বা পার্থিয়ানদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পল্লবদের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিদেশীয় তত্ত্ব গ্রহণীয় নয়। পল্লবরা দক্ষিণ ভারতেরই কোনো অংশের স্থানীয় অধিবাসী ছিলেন—এই ধারণাই বোধ হয় বেশি যুক্তিসম্মত।