বিন্দুসারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যুর পর মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তাঁর পুত্র বিন্দুসার। স্ট্রাবো লিখেছেন যে স্যান্ড্রোকোউসের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন এ্যালিক্যাডেস যাকে যারা বলত ‘অমিত্রঘাত’। ‘অমিত্রঘাত’ কথার অর্থ হল শত্রু নিধনকারী। জৈন গ্রন্থ ‘রাজাবলীকথা’-তে চন্দ্রগুপ্তের পুত্রকে বলা হয়েছে সিংহসেন। কিন্তু পুরাণে স্পষ্টতই তিনি বিন্দুসার বলে পরিচিত।
বিন্দুসারের কৃতিত্বঃ
বিন্দুসার কতদিন শাসন করেছিলেন সে সম্পর্কে পুরাণ ও বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। পুরাণে বলা হয়েছে, বিন্দুসার শাসন করেছিলেন পঁচিশ বছর, কিন্তু বৌদ্ধ ঐতিহ্যে দাবি করা হয়েছে সাতাশ বছর। সাধারণত বৌদ্ধ ঐতিহ্যের ওপরেই ঐতিহাসিকরা নির্ভর করে থাকেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যেহেতু ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন, সেহেতু বিন্দুসারের শাসনকালকে ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৭৩ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ধরে নেওয়া হয়।
পরবর্তীকালের সাহিত্যিক উপাদানের সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় যে বিন্দুসারের রাজত্বকালের প্রথম কয়েক বছর চাণক্য মন্ত্রিত্বের কাজ চালিয়ে ছিলেন। অনেক পরবর্তীকালের তিরতীয় ঐতিহাসিক ভারনাথ লিখেছেন, মন্ত্রী থাকাকালীন চাণক্য ১৬টি শহরের অভিজাত ও রাজাদের ধ্বংসসাধন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, পূর্ব থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চলের প্রভু হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে চাণক্য তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। তিব্বতীয় ঐতিহাসিকের ঐ বিবরণ থেকে ভিনসেন্ট স্মিথ এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বিন্দুসার দাক্ষিণাত্য জয় করেছিলেন। কিন্তু এই মতের সমর্থনে বিশ্বাসযোগ্য কোনো সাক্ষ্য নেই।
তারনাথের প্রদত্ত বিবরণের প্রথম অংশের অর্থ হল সম্ভবত, ১৬টি বিদ্রোহী রাজার সাধারণ অভ্যুত্থানকে দমন করে বিন্দুসার সাম্রাজ্যের অক্ষুণ্ণতা বজায় রেখেছিলেন। এই বিদ্রোহের কথা বৌদ্ধগ্রন্থ দিব্যবদান থেকেও কিছুটা সমর্থিত হয়। এর থেকে আনা যায় যে তাঁর সময় তক্ষশিলায় একটি বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল এবং ঐ বিদ্রোহ দমনকল্পে বিন্দুসার তাঁর পুত্র অশোককে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। দিব্যবদান-এ আরো বলা হয়েছে যে তক্ষশিলায় সৈন্যসহ পৌঁছানোর পর সেখানের মানুষ জানিয়েছিল তারা বিদ্রোহ করেছে দুষ্ট সামস্তদের বিরুদ্ধে, বিন্দুসারের বিরুদ্ধে নয়।
তবে তারনাথের উল্লেখিত দ্বিতীয় অংশটির বক্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, তাঁর আমলেই বঙ্গোপসাগর থেকে সুরাষ্ট্র পর্যন্ত অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিমে সমুদ্র পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। সুতরাং কিছুসারের পক্ষে নতুন করে ঐ এলাকা জয় করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। ড. এইচ. সি. রায়চৌধুরী এই মতবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি জোরের সঙ্গেই বলেছেন যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলেই দাক্ষিণাত্য মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এছাড়া মহীশূর ও কলিঙ্গে অশোকের যে শিলালেখ পাওয়া গেছে তাতে বিন্দুসারের কোনো নাম নেই, অথচ চন্দ্রগুপ্তের নামোল্লেখ আছে। সর্বোপরি বহু পরবর্তীকালের রচনা তারনাথের বিবরণের ঐতিহাসিক মূল্য সন্দেহাতীত নয়।
বিন্দুসারের কৃতিত্ব হল এই যে, তিনি তাঁর পিতা চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশাল সাম্রাজ্য যা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন তা আমৃত্যু বজায় রাখেন। এছাড়া বৈদেশিক শক্তিগুলির সঙ্গে তিনি মৈত্রী সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। গ্রিক দূত ডাইমাকোস, সিরিয়ার রাজা অ্যান্টিওকাস কর্তৃক বিন্দুসারের রাজদরবারে এসেছিলেন। প্লিনির বিবরণ থেকে জানা যায় যে মিশরের শাসক টলেমি ফিলাডেলফাস খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে ডায়োনিসাস নামে এক দূতকে ভারতীয় রাজদরবারে পাঠিয়েছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন যে প্লিনি কর্তৃক উল্লেখিত এই দূতের আগমনের সময় মগধের শাসক ছিলেন বিন্দুসার।
মূল্যায়নঃ
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বৈদেশিক সুসম্পর্ক বজায় রেখেও কলিঙ্গ ছাড়া ভারতের এক বিশাল অংশে বিন্দুসার তাঁর কৃতিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র বিন্দুসার তার পিতার সাম্রাজ্য পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাই বলা চলে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বিন্দুসারের কৃতিত্ব অসামান্য।