সাতবাহনদের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অশোকের রাজত্বকালে মহীশূরের দক্ষিণের কিছু ক্ষুদ্র রাজ্য বাদ দিয়ে দক্ষিণ ভারতের এক বৃহৎ অংশ মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। অশোকের উত্তরাধিকারীগণের সঙ্গে দাক্ষিণাত্য তথ্য ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের সম্পর্ক কী ছিল সে-বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না। তবু অশোকের মৃত্যুর পর দাক্ষিণাত্যে মৌর্য সাম্রাজ্যের আধিপত্যের বাঁধন যে শিথিল হয়ে পড়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ খুবই কম।
স্থানীয় প্রধানরা মৌর্য কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে ঐ অঞ্চলে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হিসাবে কৃষ্ণা জেলার ভট্টপ্রলুতে প্রাপ্ত আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বের কিছু লেখর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই লেখমালা থেকে রাজন কুবেরকর নাম জানা যায়, যা পরবর্তী শাসকদের আমলে ঐ এলাকায় স্বাধীনভাবে তাঁর শাসনের ইঙ্গিত বহন করে। মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙনের যুগে ও তারও পরে—এক কথায় মৌর্যোত্তর আমলে উত্তর ভারত বৈদেশিক আক্রমণের শিকার হয় এবং উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁদের আধিপত্য। বিন্ধ্য পরবর্তী এলাকা ঐ বৈদেশিক আক্রমণ থেকে মুক্ত ছিল। এই অঞ্চলে কেন বৈদেশিক আক্রমণ ঘটেনি তার ব্যাখ্যা এখানে নিষ্প্রয়োজন।
সাতবাহনদের উৎপত্তির আগে কৃষি অর্থনীতি তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক থেকে ঐ অঞ্চল পিছিয়ে ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিশেষ সুবিধাজনক ছিল না। অর্থাৎ উত্তর ভারতের তুলনায় দাক্ষিণাত্য তখন অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল কিছুটা পশ্চাৎপর। সম্ভবত এই সমস্ত কারণেই দাক্ষিণাত্য তথা দক্ষিণ ভারতের প্রতি বৈদেশিক শক্তির আকর্ষণ ছিল কম। বিদেশীয় শক্তি ছাড়াও দেশীয় শুঙ্গ ও কামরাও বিন্ধ্য পরবর্তী এলাকায় আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হননি। এর ফলে মৌর্যোত্তর যুগে দাক্ষিণাত্যে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই অনুকূল পরিবেশে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর কোনো একসময়ে (যা পরবর্তী আলোচনা থেকে বোঝা সম্ভব হবে) দাক্ষিণাত্যে সাতবাহনরা একটি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটান।
সাতবাহনদের ইতিহাস জানার জন্য তথ্যের প্রাচুর্য না থাকলেও যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায় তা একেবারে অপ্রতুল নয়। দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের মধ্যে পুরাণগুলি, বিশেষ করে মৎস্য ও বায়ুপুরাণ সাতবাহন শাসকদের ক্রমপরম্পরা বুঝতে কিছুটা সাহায্য করে থাকে। তবে এই দুটি পুরাণের মধ্যে শাসকদের নামের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পার্থক্য আছে।
বলাবাহুল্য, ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে পুরাণে প্রদত্ত তথ্যগুলি সমস্ত ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। এক কথায় শিলালৈখিক ও মুদ্রাগত তথ্যের দ্বারা অবহিত হওয়ার পর তবেই পুরাণের তথ্যগুলি ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় হবে। সাতবাহন আমলে দাক্ষিণাত্যের আর্থ-সামাজিক ইতিহাস জানার জন্য উল্লেখযোগ্য উপাদান হল কুগুল শাখার সাতবাহন বংশীয় রাজা হালের গাথাসপ্তশতী। মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতে লেখা সাতশোটি গাথার সংকলন এটি।
বৈদেশিক উপাদানের মধ্যে টলেমির জিওগ্রাফিকে হফেগেসিস বা “ভূগোল” গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে কাজে লাগে। সাতবাহনদের আমলে রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক ইতিহাস বুঝতে অপরিহার্য উপাদান হল শিলালেখ। পূর্ব ও পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে মূলত এই বংশের শাসকদের শিলালেখগুলি পাওয়া গেছে। শিলালেখগুলির প্রাপ্তিস্থান হল নানাঘাট, নাসিক, কানহেরী, কার্লে, অমরাবতী প্রভৃতি। সাতবাহন শাসকদের মুদ্রা পাওয়া গেছে অপরাস্ত অর্থাৎ উত্তর কোম্বনের সোপারা, জোগালদেরী, বোম্বাইয়ের অন্তর্গত অকোলা এবং বেরারে।
সাতবাহনদের সমসাময়িক ও তাদের শত্রুপক্ষ পশ্চিমী শকদের কিছু শিলালেখও এই বাংশের বিপর্যয়ের ইতিহাস বুঝতে সাহায্য করে থাকে। এ-প্রসঙ্গে নাসিক ও সংলগ্ন এলাকায় প্রাপ্ত নহপানের জামাতা ঊষবদাত্তর কয়েকটি শিলালেখ এবং শক কাদমক বংশের শাসক রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালেখর কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও সাতবাহনদের আদি পর্বের ইতিহাস, বিশেষ করে ঐ সময়ের শাসকদের সময়কাল বুঝতে দরকার হয় কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাথিগুম্ফা শিলালেখ। আবার সাতবাহন সাম্রাজ্যের পরিণতি পর্বের ইতিহাস জানার জন্য কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে নাগাজুনিকোও-তে প্রাপ্ত ঈক্ষ্বাকু বংশের বেশ কিছু লেখর ওপর কিছুটা নির্ভর করতে হয়।
মূল্যায়ন:
মৌর্য পরবর্তী যুগে সাতবাহন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ধারণায় কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকলেও সাতবাহনদের উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ বিতর্কিত। অর্থাৎ তাদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায় না। এমনকি কতজন শাসক ঠিক কতদিন ধরে শাসন করেছিলেন সেবিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা শক্ত। তথ্যের অপ্রতুলতা এবং বিভিন্ন তথ্যসূত্রের মধ্যে অসামঞ্জস্য এ-বিষয়ে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।