শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ
বর্ধমান যুগে জ্ঞানের বিস্ফোরণ শিক্ষা সংস্কৃতিক গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। নিত্য নতুন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য ও জ্ঞান রাশি শিক্ষাক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। তাই সমাজ পরিবর্তনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ধারায় শিক্ষা এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম রূপে বিবেচিত হয় এবং শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
![]() |
Relationship between education and social change |
শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক
- শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে। অন্যের প্রতি সহানুভূতি, স্পর্শকাতরতা থেকে মুক্ত, পরিশ্রমী ও সক্রিয় সামাজিক মানুষে পরিণত করে তোলে শিক্ষা। সমাজ পরিবর্তনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সমাজস্থ ব্যক্তির বর্গের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বলা বাহুল্য আধুনিক শিক্ষা মানুষের মন ভঙ্গের পরিবর্তন সহায়তা করে আর এই পরিবর্তিত মনো ভঙ্গি সমাজের রীতি-বিধি আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও নৈতিকবোধে আনে পরিবর্তন। মানুষের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে অসপৃষ্ঠতার পাপাচার থেকে ভারতীয় সমাজ মুক্তি লাভ করেছে। একমাত্র শিক্ষাই পারে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে সমাজকে মুক্ত করতে।
- একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞতা, পশ্চাৎপরতা ইত্যাদি শিকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলা যায়। যেকোনো পরিবর্তনের পক্ষে এগুলি বাধা স্বরূপ। শিক্ষার মাধ্যমে এদের অপসারণ করে সামাজিক পরিবর্তন আনয়ন করা সম্ভব। তাই শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তন একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।
- সমাজ সংগঠনের যেকোনো পরিবর্তনের ভিত্তি হল মানব মনের বর্তমান সমাজ পরিস্থিতি সম্পর্কে অসন্তোষ বা অতৃপ্তি ও তা দূরীকরণের প্রচেষ্টা। একমাত্র শিক্ষাই পারে মানব মনে এই অসন্তোষ সৃষ্টি করতে। বহি বিশ্বে যে পরিবর্তনই হোক না কেন মানব মনে তার উপলব্ধি নিয়ে আসার জন্য শিক্ষার ভূমিকা অপরিহার্য। বর্ধমান পরিস্থিতির পরিবর্তন এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেই মানুষ সমাজ পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়।
- বর্ধমানের চাহিদা অনুযায়ী সমাজের পরিবর্তন সাধনের জন্য বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষার শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিবিদ্যার আত্তীকরণে শিক্ষার ভূমিকা অপরিহার্য। তাই শিক্ষা সামাজিক পরিবর্তনের কারণ।
- শিক্ষার প্রভাবে সামাজিক উৎযোজন ঘটে, যা সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে সাহায্য করে। সামাজিক উৎযোজন প্রক্রিয়ায় কয়েকজন ব্যক্তি গতানুগতিক সমাজের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্যের তীব্র সমালোচনা করেন ও পরিবর্তন দাবি করেন। এই ব্যক্তিদের নেতা বলা হয়। ক্রমশ অধিক সংখ্যক ব্যক্তি নেতাদের দাবির স্বপক্ষে সহমত প্রকাশ করেন ও তাকে কেন্দ্র করে একটি সামাজিক মতাদর্শ গড়ে ওঠে। এইভাবে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সামাজিক উৎযোজনের প্রক্রিয়া যখন চরমে পৌঁছায় তখনই সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে বলা যায়। তাই নেতৃত্বের পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনে অন্যতম শর্ত।
- শিক্ষাই বৃত্তির মধ্যে বিশ্লেষণায়ক চিন্তন ও সামাজিক পরিবর্তনের উপযোগী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। আর শিক্ষা সমাজস্থ নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটিয়ে সামাজিক পরিবর্তনের পটভূমি রচনা করতে পারে।
- শিক্ষা হল সামাজিক পরিবর্তনের অপরিহার্য কারণ এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ডুর্কহেইম এর মতে, শিক্ষা হলো নবীন প্রজন্মের সামাজিকীকরণ। সামাজিকীকরণ হলো আত্মশক্তিয়তা ও অভিযোজনের এক প্রক্রিয়া এই প্রক্রিয়ার অর্থ হলো সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, সমৃদ্ধীকরণ ও সঞ্চালন। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি মানসিকতা ও জীবন দর্শনের পরিবর্তন হয়, যার সাহায্যে সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
- সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষার অন্যতম অবদান হলো ব্যক্তির মূল্যবোধ পরিবর্তন আনা। আজ সামাজিক মানুষের জীবনযাত্রা ও জীবন পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে নতুন নতুন মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করছে শিক্ষা। আর এই মূল্যবোধই হল ব্যক্তির আচরণের প্রধান নির্ণায়ক। নতুন মূল্যবোধ ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন ঘটায় যা প্রতিফলিত হয় সামাজিক ক্ষেত্রে। উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ উন্নত মানের মূল্যবোধের অধিকারী হয় যা সামাজিক পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য।
উপসংহারঃ
শিক্ষা সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফলে, শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যক্তিকে সমাজ পরিবর্তন করতে হলে উপযুক্ত শিক্ষা প্রয়োজন, যা সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্তরিত করে।