নেপোলিয়ানের কৃতিত্বের মূল্যায়ন কর। নেপোলিয়নের সংস্কার সমূহ মূল্যায়ন।
ভূমিকা:
১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ পর্যন্ত সময়কাল হল ফ্রান্সের ইতিহাসে ‘নেপোলিয়ানের যুগ’। নেপোলিয়ান যে একজন ঐতিহাসিক পুরুষ এতে সন্দেহ নেই। স্বাভাবিক ভাবে নেপোলিয়ানের কৃতিত্বের মূল্যায়ন নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্কেরও শেষ নেই।
নেপোলিয়ানের কৃতিত্বের মূল্যায়ন:
ঐতিহাসিক সোতারিয়া ছিলেন তার সমসাময়িক। তিনি নেপোলিয়ানের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন এই কর্সিয়ান যুবক কোনদিনই ফরাসিদের ভালোবাসেননি। তিনি ফরাসিদের বাধ্য করেন রক্ত ঝরাতে, কর দিতে এবং স্বৈরশাসনকে মেনে নিতে। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক। পরবর্তীকালের লেখক জ্বলেশ মিশেলও নেপোলিয়ানকে বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতক বলেছেন।
অন্যদিকে থিয়ার্স, আলবেয়ার সোরেল প্রমুখ পণ্ডিত দেখিয়েছেন নেপোলিয়ান ছিলেন বিপ্লবের জীবন্ত প্রতীক। তিনি বিপ্লবকে প্রসারিত করেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবের সন্তান। নেপোলিয়ান তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমি বিপ্লব”। আবার তিনি উল্লেখ করেছিলেন ‘আমি বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি। তথ্যের বিচারে তার এই দুই বক্তব্যই যথার্থ।
নেপোলিয়ানের মূল্যায়ন নিয়ে যতই বিতর্ক হোক না কেন ভুললে চলবে না ফ্রান্সের ইতিহাসে তার অমূল্য অবদানকে। তিনি ফ্রান্সকে বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন। তিনি শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করে ফ্রান্সকে অরাজকতার হাত থেকে বাঁচান। তিনি জনকল্যাণ কর্মসূচী গ্রহণ করেন। তিনি তার সাম্রাজ্যের সর্বত্র তাঁর আইনবিধির প্রয়োগ করেন এবং একই ধরনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার প্রচলন করেন। তিনি আইনবিধির দ্বারা আইনের ক্ষেত্রে সমতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, বিশেষ সুবিধার অবসান, সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা লোপ করেন। পিতার সম্পত্তিতে সকল পুত্রের অধিকারকে মেনে নিয়েছিলেন।
পোপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে ধর্মমীমাংসার সমাধান করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি সংস্কার করেন। চার্চের হাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি কোন ক্ষমতা দেননি। তিনি জন্ম থেকে কর্মকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যোগ্য মানুষদের তিনি ‘লিজিয়ন অফ অনার’ প্রদান করে সম্মানিত করতেন। ফ্রান্সের আর্থিক সংস্কার করে তিনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটান।
সমালোচকরা বলেন তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক। এই বক্তব্যকে অস্বীকার করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে তিনি হিটলারের মত কখনই উগ্র শাসক ছিলেন না। তার শাসন সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছিল। ডেভিড টমসন চমৎকারভাবে তার মূল্যায়ন করেছেন। তার মতে নেপোলিয়ানের একনায়কতন্ত্র ছিল জনহিতকর, উপযোগবাদী, লক্ষ, পরিশ্রমী, বুদ্ধিপূর্ণ। (The dicratorship of Napolean in France was a utilitar “ian, efficient, industrious, hand-headed goverment.)। ফ্রান্সের বাইরেও তিনি বিপ্লবের আদর্শকে প্রচার করেন। নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্য বিপ্লবের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল।
মানুষ হিসাবেও নেপোলিয়ান ছিলেন আকর্ষণীয়। কর্সিকার প্রাকৃতিক প্রভাব তার চরিত্রে পড়েছিল। অনমনীয়তা, ভাবপ্রবণতা, নির্ভিকতার এক চমৎকার সমাবেশ তার চরিত্রে ছিল। সমরবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন কিন্তু চরিত্রের সুকুমার প্রবৃত্তিকে তিনি নষ্ট করেননি। চমৎকার কথা বলতেন এবং চমৎকার লিখতেন।
উপসংহার:
তাহলে কি নেপোলিয়ানের কোন ত্রুটি ছিল না? উত্তরে বলা যায় তার প্রশাসনে বহু গলদ ছিল। জনগণকে তিনি স্বাধীনতা দেননি। কঠোর স্বৈরশাসন চালু করেন। ডেভিড টমসনের মতে নেপোলিয়ানের শাসনে পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল ফ্রান্স। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও ছিল না। তিনি নারীশিক্ষার দিকে নজর দেননি। তার শাসনে কোন উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তার সাম্রাজ্যে এমন পরিবেশ তৈরি হয়নি যেখানে স্বাধীন চিন্তার স্ফুরণ হতে পারে। তবুও তার রাজত্বকাল ফ্রান্সের ইতিহাসে এক প্রাণবন্ত অধ্যায়।