StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

স্পেনীয় ক্ষত টীকা লেখ

স্পেনীয় ক্ষত টীকা লেখ ।

স্পেনীয় ক্ষত : (Spanish Ulcer)

মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য নেপোলিয়ানের পক্ষে ইউরোপের সমগ্র উপকূলভাগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে তিনি আইবেরিয়ান উপদ্বীপের উপর প্রাধান্য স্থাপনে অগ্রসর হন। কারণ তার মনে হয় এই উপদ্বীপের দুই রাষ্ট্র স্পেন ও পর্তুগাল তার ব্যবস্থাকে ঠিকমতো কার্যকর করছে না। এজন্য তিনি স্পেন ও পর্তুগাল জয় করার জন্য সৈন্য পাঠান। ফরাসী সৈন্যদল মার্শাল জুনোর নেতৃত্বে লিসবনে পৌঁছানোর আগেই পর্তুগালের রাজা ব্রাজিলে পালিয়ে যান। স্পেনের বিনা অনুমতিতে তিনি ঐ রাজ্যের উপর দিয়ে সৈন্য প্রেরণ করেন। পর্তুগালকে সহজে দখল করে ফ্রান্স, স্পেন আক্রমণ করেছিল। স্পেনের অপদার্থ রাজা চতুর্থ চার্লস ও তার পুত্র ফার্ডিনান্দ নেপোলিয়ানের আদেশে সিংহাসন ত্যাগ করেন। নেপোলিয়ান তার ভাই যোসেফকে স্পেনের সিংহাসনে বসান, এই ঘটনা স্পেনীয় ক্ষত নামে পরিচিত ছিল।

নেপোলিয়ানের এই কাজকে স্পেনের জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে। স্পেনের মানুষের দেশপ্রেমের অভাব ছিল না। গ্রান্ট ও টেম্পারলি মনে করেছেন ধর্ম ও জাতীয় দত্তই স্পেনীয়দের নেপোলিয়ানের বিরোধিতা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হয় (স্পেনীয় ক্ষত)। কৃষকরা এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। তারা পাহাড় পর্বতের আড়ালে লুকিয়ে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে। স্পেনের রাজনৈতিক নেতারা জুটা (Junta) বা রাষ্ট্রীয় মহাসভা গঠন করে স্থানীয় শাসনকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়। স্পেনীয়রা ইংল্যান্ডের সাহায্যের জন্য আবেদন জানায়। মাত্র এগারো দিন শাসন করার পর যোসেফ মাদ্রিদ থেকে বিতাড়িত হন।

ইংল্যান্ড বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে এলে পরিস্থিতি ফ্রান্সের প্রতিকূল হয়। সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলী (পরবর্তীকালের ডিউক অফ ওয়েলিংটন) একদল সৈন্য নিয়ে স্পেনে উপস্থিত হন। এইবার যে যুদ্ধ আরম্ভ হয় তার নাম পেনিনসুলার যুদ্ধ (Peninsular ইংরেজরা পর্তুগালের রাজধানী লিসবন দখল করে নেয়। অবস্থা উপলব্ধি করে স্বয়ং নেপোলিয়ান স্পেনের দিকে অগ্রসর হন। তিনি জার্মানি থেকে তাঁর গ্রান্ড আর্মির এক অংশকে স্পেনে নিয়ে আসেন।

নেপোলিয়ান পুনরায় মাদ্রিদ দখল করে স্পেনের সিংহাসনে পুনরায় যোসেফকে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে অস্ট্রিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাই নেপোলিয়ান স্পেন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তিনি ওয়াগ্রাম যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করেন এবং ভিয়েনা সন্ধি অনুযায়ী তিনি কঠোর শর্ত আরোপ করেন। কিন্তু স্পেনে পুনরায় তিনি সমস্যায় পড়েন। তার পক্ষে স্পেন দখলে রাখা সম্ভব হয়নি। ফরাসী সৈন্যবাহিনী ভিমিয়েরোর ও টলভেরার যুদ্ধে পরাজিত হয়। আর্থার ওয়েলেসলী ১৮১২ সালে সালামাঙ্কা এবং ১৮১৩ সালে ভিট্টারিয়ার যুদ্ধে ফরাসীদের পরাজিত করে স্পেন থেকে তাড়িয়ে দেন।

‘নেপোলিয়ান অপরাজেয়’ এই কল্পকাহিনীর সমাধি হয় স্পেনে। এই প্রথম তিনি জাতীয়তাবাদের দ্বারা পরিচালিত শক্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং ব্যর্থ হয়েছিলেন। নেপোলিয়ানের জীবন ইতিহাসে তাই পেনিনসুলার যুদ্ধের গুরুত্ব অসীম ।

তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন স্পেনীয় ক্ষত তার সর্বনাশ করেছে। এই আত্মউপলব্ধি ভীষণ সত্য। নেপোলিয়ানের পতনে স্পেনীয় ক্ষত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তার সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা এই যুদ্ধে প্রকাশ পায়। প্রচুর অর্থ ও লোক ক্ষয় হয়। নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধ শক্তিগুলি অনুপ্রাণিত হয়। ইংল্যান্ড তাদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। স্পেনের সাফল্যে প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি ইউরোপের দেশগুলিতে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। ফিশারের মতে ফরাসী সাম্রাজ্যের সংগঠনে নেপোলিয়ানের স্পেনীয় অভিযান প্রথম ফাটল সৃষ্টি করেছিল।

নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে স্পেনীয়দের এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। মূলতঃ এই বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যাবে কি না এই নিয়েই বিতর্ক। ডেভিড টমসনের মতে স্পেনীয়দের গভীর আঞ্চলিক ও স্থানীয় স্বাধীনতাবোধ ছিল। তারা তাদের ইতিহাস নিয়ে গর্ব বোধ করত। স্পেন কখনই অস্ট্রিয়ার মতো বিভিন্ন জাতির দেশ ছিল না। স্পেন ছিল ঐক্যবদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশ। রাজতন্ত্রের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল। তাই নেপোলিয়ান যখন অন্যায়ভাবে তাদের রাজাকে পদচ্যূত করে নিজের ভাইকে স্পেনের সিংহাসনে বসান তখন স্পেনবাসী তাকে মেনে নিতে পারেনি। সুতরাং স্পেনীয়দের এই সংগ্রামকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যাবে।

ডেভিড টমসন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, “এতদিন নেপোলিয়ান বেতনভোগী সেনাদলকে পরাজিত করেন, এখন তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রতিরোধের সম্মুখীন হন।” ডেভিড টমসনের এই বিশ্লেষণকে রুডে সহ অনেকে মেনে নিতে পারেননি। তাদের মতে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব নিয়েছিলেন তারা হলেন যাজক ও সামন্ত শ্রেণী। তারা ছিলেন রক্ষণশীল, তাদের স্বার্থ ছিল সংকীর্ণ। তারা ফরাসী বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন না, বরং বিপ্লবী আদর্শকে ভয় পেতেন। তাই এই সংগ্রামকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যাবে না। এ ছাড়াও তারা মনে করেন স্পেনীয় সংগ্রামে উদারনৈতিক ভাবধারার প্রভাব ছিল সীমাবদ্ধ। তাদের প্রতিরোধ ছিল মূলতঃ ধর্মীয়।

মূল্যায়ন:

স্পেনীয়দের এই সংগ্রামের (যা স্পেনীয় ক্ষত নামে পরিচিত ছিল )প্রকৃতি বিশ্লেষণে যতই বিতর্কের অবতারণা হোক না কেন এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে স্পেনীয়রা নেপোলিয়ানের শাসনকে মেনে নিতে রাজী ছিল না। বলেই স্পেনীয় বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহ নেপোলিয়ানের পতনের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *