অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে টিকা লেখ।
বৌদ্ধ দর্শনের অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে টিকা/টীকা নিম্নে আলোচনা করা হলো –
দুঃখের নিবৃত্তি ও ‘মঝঝিম পন্থা’ অনুশীলনের জন্য গৌতম বুদ্ধ আটটি নীতি বা আদর্শ পালনের কথা বলেছেন। এগুলি হল – সৎবাক্য, সৎকর্ম,সৎচেষ্টা,সৎজীবিকা,সৎসংকল্প, সৎচিন্তা, সৎদৃষ্টি এবং সৎসমাধি। এই আটটি পথ বৌদ্ধধর্মে ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ‘ নামে পরিচিত।
এই সবগুলির সমন্বিত রূপ ‘মধ্যপন্থা‘ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। কারণ, এগুলিতে কঠোর কৃচ্ছসাধনের পথ পরিহার করা হয়েছে। আবার অস্বাভাবিক অসংযমতাও এখানে পরিত্যাজ্য। এই দুই কঠোরতর মধ্যবর্তী পথ অনুসরণের ইঙ্গিত এগুলিতে থাকায়, তা “মধ্যপন্থা” নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
![]() |
অষ্টাঙ্গিক মার্গ |
অষ্টাঙ্গিক মার্গের মধ্যে প্রথম তিনটি দৈহিক সংযম ও পরের তিনটি মানসিক সংযমকে রক্ষা করে। আর শেষের দুটির মাধ্যমে ঘটে বুদ্ধির বিকাশ। উল্লেখ্য, বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিরোধী মনোভাব এই মার্গগুলির মধ্যে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই পথগুলি অনুসরণের জন্য কোনো যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই পুরোহিতের সাহচর্য পরিত্যাজ্য হয়েছিল। অথচ সঠিকভাবে ঐ পথগুলি অনুসরণ করে চললে দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভ অর্থাৎ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে তিনটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলি হল যথাক্রমে ‘শীল’, ‘চিত্ত’ ও ‘প্রজ্ঞা’।
‘শীল’ বলতে নৈতিক শুদ্ধতাকে বোঝায়। বিনয় পিটকে এই ‘শীল’ শব্দটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ‘শীল’ বা নৈতিক শুদ্ধতা মেনে চললে সত্যিকারের ব্রহ্মচর্য লাভ করা সম্ভব হয়। ‘চিত্ত’ শব্দটি অভিধর্ম পিটকে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে। এর অর্থ হল এই যে, ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক সংযোগকে বজায় রাখা। ‘প্রজ্ঞা’ অর্থে বোঝায় পরম জ্ঞান। অর্থাৎ বুদ্ধির বিকাশের মাধ্যমে একজন মানুষ সত্য বা বাস্তবকে উপলব্ধি করতে পারেন। সুত্ত পিটকে এই প্রজ্ঞার কথা আলোচিত হয়েছে। বলাবাহুল্য, শীল, চিত্ত ও প্রজ্ঞা হল অষ্টাঙ্গিক মার্গের অপরিহার্য অঙ্গবিশেষ।
বৌদ্ধধর্মের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। যে আটটি মার্গ বা পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন বুদ্ধদেব, সেগুলির এক বিশেষ সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। এই আটটি মার্গ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে বাস্তববাদী বুদ্ধ তাঁর ধর্মানুরাগীদের এগুলি মেনে চলার কথা বলেছিলেন।
এই আটটি মার্গের প্রত্যেকটির পূর্বে ‘সৎ’ কথাটির সংযোজন। এর মূল উদ্দেশ্য হল সৎ পথে থেকে সত্যকে উপলব্ধি করা। এছাড়া, সমাজে ক্ষতিকর কোনো কাজ করা থেকে মানুষকে অপসারিত করে এক শান্তির বার্তাবরণ সৃষ্টি করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
সৎ কার্যের মাধ্যমে বুদ্ধদেব পরোক্ষভাবে হিংসাকে পরিহার করে অহিংসার পথ অনুসরণের কথা বলেছেন। অহিংসার পথ অনুসরণ করলে সমাজে ব্যভিচার দূরীভূত হয়ে সমাজের মঙ্গল সাধিত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। এককথায়, ‘সৎ কার্য’র দ্বারা তিনি বিভিন্ন অন্যায় কাজকর্ম থেকে সরে আসার নির্দেশ দিয়েছেন।
আবার ঠিক একইভাবে ‘সৎ জীবিকা’ শব্দ দুটি নিজের জীবনধারণের জন্য সৎ বা সত্য পথ অনুসরণের ধারণাকে স্পষ্ট করে তোলে। এই সৎ জীবিকার দ্বারা সমাজের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ না করাকেও বোঝায়। পশুহত্যা না করার বিষয়টিও এই সৎ জীবিকার অন্যতম অঙ্গ। উল্লেখ্য, প্রাচীনতম বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘সুত্তনিপাত’-এ গবাদিপশুকে খাদ্য এবং সৌন্দর্য ও সুখের উৎস হিসাবে বর্ণনা করে তা সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ‘সুত্তনিপাত’-এর এই বর্ণনার সঙ্গে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্ভুক্ত সৎ জীবিকার সাদৃশ্য আছে।
সমাজে লোভ, হিংসা ও অনৈতিকতার দরুন পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে বলে বুদ্ধ মনে করতেন। প্রকৃত শান্তি লাভ করতে গেলে ঐ সমস্ত বিষয়গুলিকে নিবৃত্ত করা প্রয়োজন এবং এই নিবৃত্তির জন্য সত্য ও অহিংসার পথ অনুসরণ করা একান্তভাবে কাম্য বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। এই পথকেই তিনি ‘সৎ দৃষ্টি’ বলে অভিহিত করেছেন।
বৌদ্ধ ধর্মের একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গ হল নির্বাণ লাভ। এই ধর্ম অনুযায়ী পরম শান্তি লাভ করতে গেলে নির্বাণ লাভ অবশ্যম্ভাবী। নির্বাণ’-এর এককথায় অর্থ হল চরম মুক্তি লাভ। মানুষের পুনর্জন্মের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তির চরম পরিণতি ঘটে নির্বাণ লাভের মাধ্যমে। কর্মফলের সূত্র ধরে এক জন্ম থেকে পরজন্মে মানুষ যে দুঃখের ভার বয়ে বেড়ায়, তা থেকে মুক্তিলাভই হল নির্বাণ। এই ধর্ম অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় যে মানুষের আত্মার মুক্তি ঘটে নির্বাণ লাভের দ্বারা।
‘অরিয় পরিয়েসন সুত্ত’-তে নির্বাণ লাভের জন্য যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা হল যা জরামুক্ত (‘অজর’) বা যার বিনাশ হয় না। যা ব্যাধিমুক্ত (‘অব্যাধি’) যার মৃত্যু হয় না (‘অমৃত’); যা শোক-দুঃখ থেকে মুক্ত (‘অশোক’), যা অপবিত্রতা থেকে মুক্ত (‘অসংক্লিষ্ট’), যা তুলনাহীন (‘অনুত্তর’) এবং যা হল মানুষের চরম লক্ষ্য (‘যোগক্ষেম’)। অবশ্য নিকায় গ্রন্থগুলিতে নির্বাণের কোনো সঠিক সংজ্ঞা নিরূপিত হয়নি। যাই হোক না কেন, নির্বাণ হল সমস্ত জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি-সবকিছুর সমাপ্তি এখানে। তাই পুনর্জন্ম ও দুঃখকষ্টকে এড়াতে হলে নির্বাণ লাভ অপরিহার্য।