জেমস মিল কীভাবে ভারতবর্ষের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন?
ইংরেজগণ যদিও ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করেন, তথাপি তাঁদের মনে শাসনব্যবস্থার পদ্ধতি ও ভারতীয় উপমহাদেশে তার কার্যকারিতা নিয়ে একাধিক সংশয় দেখা দেয়। ভারতের বিশালতা, তার বৈচিত্র্য ও প্রাচীন সভ্যতা গতানুগতিক ঔপনিবেশিকরণের (Colonisation) পদ্ধতিকে কার্যত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। পশ্চিম ইউরোপীয় জাতি তত্ত্বের (Theory of Race) আধার ভারতীয় প্রেক্ষাপটে অকিঞ্চিৎকর মনে হয়, বিশেষত যখন স্যার উইলিয়াম জোন্স’ সংস্কৃতকে অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। ঔপনিবেশিকরণের বিবরণমূলক প্রক্রিয়া (Colonial Narrative) এই ক্ষেত্রে নিষ্ফলা প্রতীত হয়।
ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে ভারতীয় সংস্কৃতির জ্ঞান-গম্ভীর চর্চা এবং গবেষণা সদ্যবিজিত দেশকে জানার ও বোঝার আগ্রহ বহুমাত্রায় বৃদ্ধি করে। সেই সুবাদে কিছুটা রোমান্টিক চেতনার তাগিদে এবং কিছুটা ঔপনিবেশিক ও বাস্তবিক পরিস্থিতির প্রয়োজনে ভারতচর্চা অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং ভারতবর্ষ সম্বন্ধে একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়।
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি (Writer) ও ভারতে কর্মরত প্রশাসনিক আধিকারিকদের সুবিধার্থে জেমস মিল ( James Mill) সর্বপ্রথম তিন খণ্ডে ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনা করেন। উক্ত গ্রন্থটির নাম হল হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া (History of British India, 1817)। এই বহুচর্চিত এবং বিতর্কিত গ্রন্থটি বিপুল সাড়া ফেলে এবং এর অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মিল কার্যত উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতবর্ষে কোনোকালে না আসা সত্ত্বেও এই দেশের সামগ্রিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ধৃষ্টতা দেখান।
জেমস মিল ভারতের ইতিহাস কে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন, – এগুলি হল যথাক্রমে
- (ক) হিন্দু যুগ (Hindu Period )
- (খ) মুসলিম যুগ (Muslim Period) এবং
- (গ) ব্রিটিশ যুগ (British Period) ।
হিন্দু যুগকে আলোকপ্রাপ্ত যুগ্ম (Enlightened Period) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু আর্যদের সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয়দের সাদৃশ্য তুলে ধরার প্রয়াস করা হয়েছে।
মুসলিম যুগকে অপশাসন, বিশৃঙ্খলা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের (Dark Age) সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মিলের মতানুসারে মুসলিম শাসন প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে এবং ভারতবর্ষের সার্বিক বিপর্যয় ডেকে আনে। একদা গৌরবজনক আর্য সংস্কৃতি ও সভ্যতা ধূলিসাৎ হয়। এই বিপর্যয়ের ফলে হিন্দুগণ তাদের অতীত গৌরব হারিয়ে হীনবল হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ভারতবর্ষে ইংরেজ শক্তির আবির্ভাব এবং তার সার্বিক প্রতিষ্ঠা, মিলের মতানুসারে, সর্বাধিক প্রশংসার দাবি রাখে। ইংরেজ শাসনের বদান্যতায় এবং তার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ভারতীয় হিন্দুগণ তাঁদের হৃত গৌরব ফিরে পান।
মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং শিক্ষা, আইনের শাসন ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রভূত প্রসার হয়। বলাবাহুল্য যে জেমস মিল ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠাকে ত্রাতা (Saviour) হিসেবে দেখিয়েছেন এবং অন্ধকারে নিমজ্জিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয়গণকে তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে “সচেতন” করেছেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চারণ কবি (Bard of the British Empire) রুডইয়ার্ড কিপলিং ও (Rudyard Kipling)-এর কাব্য, সাহিত্য এবং ভাষায় এই উন্মাসিক মানসিকতা প্রতিধ্বনিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে কিপলিঙ White Man’s Burden তত্ত্বের মুখ্য প্রবক্তা ( Sole Spokesman) ছিলেন। নিঃসন্দেহে মিলের গ্রন্থ ইংল্যান্ডের শিক্ষিত মহলে গভীর রেখাপাত করেছিল এবং হেইলিবেরি কলেজে ( Haileybury College) এটি অবশ্যপাঠ্য ছিল।
- মূল্যায়ন :
- মিলের প্রশ্ন বহুকাল যাবৎ (1818-1857 খ্রি.) ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের বৈধতা ও তার আদর্শগত ভিত্তি (Ideological Foundation) গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডালহৌসি (Dalhousie)-র ন্যায় অতি সক্রিয় প্রশাসকগণ ভারতীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তার, ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতিস্থাপন ও ধর্মান্তরকরণের নীতিকে প্রোৎসাহ দেন। এর ফলে “সূত্র-শিখাধারি ব্রাক্ষ্মণ”-দের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।