ভারতীয় ভাষ্যকারেরা কীভাবে মহাবিদ্রোহের ব্যাখ্যা করেছেন?
ভারতীয় ভাষ্যকারদের মধ্যে বিনায়ক দামোদর সাভারকার মহাবিদ্রোহকে সর্বপ্রথম First war of Indian Independence (ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ) বলে অভিহিত করেন এবং 1909 খ্রিস্টাব্দে এই শিরোনামে তাঁর গ্রন্থটি কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত হয়। স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন গ্রন্থটির প্রকাশনা ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তরুণ বিপ্লবীগণ পাঁচ দশক পূর্বের এই ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা পান এবং দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে ব্রতী হয়ে আত্মবলিদান করেন।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকগণ 1857 খ্রিস্টাব্দের গণবিদ্রোহ নিয়ে নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুরেন্দ্রনাথ সেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার, এস বি চৌধুরী প্রমুখ। সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর গ্রন্থে (1857) আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজ ভাষাকার কে’র (Kaye) বিবরণী অনুসরণ করেছেন। অন্যদিকে অধ্যাপক চৌধুরী বিদ্রোহের প্রাদেশিক স্তরগুলি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর গ্রন্থ Civil Rebellion in the Indian Mutinies-এ তিনি বিদ্রোহের গণ চরিত্রের (Mass character) ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন: The uprising started merely as a sepoy mutiny soon engulfed the peasantry and other civilian population across the wide ares of India.
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার (The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857) এই বিদ্রোহকে জাতীয় চরিত্র প্রদান করতে অস্বীকার করেছেন। ভারতের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এতে অংশগ্রহণ করেননি। উপরন্তু দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিম অঞ্চল বিদ্রোহের সময় আপাতত শান্ত ছিল। তাই বিদ্রোহের কোনো ‘জাতীয় চরিত্র’ (National character) ছিল না।
কেমব্রিজ ঐতিহাসিক এরিক স্টোক্স (Eric Stokes) বিদ্রোহের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী হিসেবে মূলত উত্তর ভারতীয় কৃষক সম্প্রদায় (North Indian Peasantry)-কে প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘দ্য পেসেন্ট আর্মড’ (The Peasant Armed) গ্রন্থে স্টোক্স বিদ্রোহ সংঘটিত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিস্থিতির (Local Conditions) ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং সুকৌশলে বিদ্রোহের মূল কেন্দ্রগুলি থেকে স্থানীয় অভ্যুত্থান ( Local Uprisings) সমূহকে পৃথক করেছেন।
এরিক স্টোক্সের সমালোচনা করে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থ ‘Awadh in Revolt‘-এ দেখিয়েছেন যে মহাবিদ্রোহের ঝটিকা কেন্দ্রগুলির (Storm Centres) সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলগুলি আদপেই পৃথক ছিল না, বরং প্রত্যেকটি এলাকা কোনো-না-কোনোভাবে মূল কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল যদিও তাদের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিদ্যমান ছিল। মহাবিদ্রোহের নেপথ্যে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ (Ideology) কাজ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের মাটিতে বিদেশি হানাদারদের উৎখাত করা এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক শাসকদের পুনরায় পুনর্বাসিত করা। এ ছাড়া হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও সম্প্রীতির ওপর জোর দেওয়া হয়।
নিম্নবর্গীয় ইতিহাসের (Subaltern History) প্রবক্তা রণজিৎ গুহ (Ranjit Guha) তাঁর গ্রন্থ ‘Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India-তে বিদ্রোহীদের স্বতন্ত্র চেতনার (Autonomous Consciousness) ওপর গুরুত্ব আরোপ করে দেখিয়েছেন যে তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে (Spontaneous) বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই অর্থে বিদ্রোহীগণ ছিলেন Pre-Political Rebels । নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাবাদর্শ না-থাকা সত্ত্বেও তাঁরা শোষণ এবং অপশাসনের কু-প্রভাব সম্বন্ধে পূর্ণমাত্রায় সচেতন ছিলেন। সাম্প্রতিক ঐতিহাসিকগণ বিদ্রোহীদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নমুনা পেশ করেছেন।
ঐতিহাসিক সব্যসাচী ভট্টাচাৰ্য (Sabyasachi Bhattacharya) সম্পাদিত গ্রন্থ ‘Re Thinking 1857”-তে এর বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বিদ্রোহীগণ প্রচারের (Propaganda) অস্ত্র হিসেবে মুদ্রণযন্ত্র (Printing Press), ডাক-তার (Telegraph) এবং পুস্তিকা (Pamphlet) ইত্যাদির গুরুত্ব উপলখি করেছিলেন এবং তা যথার্থভাবে কার্যকরী করেছিলেন।
- মূল্যায়ন :
- 1857 খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ অতিবাহিত হওয়ার পর বহুকাল যাবৎ জনমানসে তার প্রভাব ছিল। বুন্দেলখন্ড অঞ্চলের চারণ কবিগণ তাঁদের বীরত্বের কাহিনি প্রচার করে এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে অমরত্ব প্রদান করেছেন। এই বীরগাথাসমূহ ওখানকার লোকসংস্কৃতির (Folklore) প্রধান আশা এবং মৌখিক ইতিহাসের (Oral History) গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।