ঐতিহাসিক হরবংস মুখিয়া ও দীনেশচন্দ্র সরকার কীভাবে ভারতীয় আর্থসামাজিক অবস্থার স্থবিরতার তত্ত্বকে খণ্ডন করেছেন?
তাঁদের স্বপক্ষে যুক্তিগুলি উল্লেখ করো ।
- ভূমিকা :
- একদিকে যেমন শর্মা, ঝা এবং যাদব আদি-মধ্যকালীন ভারতবর্ষে ইউরোপীয় ধরনের সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব এবং বিকাশের কথা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন এবং একটি হতাশাব্যক চিত্রাঙ্কন করেছেন, অন্যদিকে আবার হরবংস মুখিয়া (Harbans Mukhia), দীনেশচন্দ্র সরকার (Dinesh Chandra Sarkar), ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় (Brajadulal Chattopadhyay) প্রমুখ ঐতিহাসিক পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন এবং বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক ‘মডেল‘ ভারতীয় প্রেক্ষাপটে আদৌ প্রযোজ্য নয়। আদি-মধ্যযুগে ভারতীয় অর্থনীতি আদৌ স্থবির হয়ে যায়নি।
হরবংস মুখিয়া ও দীনেশচন্দ্র সরকারের ভারতীয় আর্থসামাজিক অবস্থার স্থবিরতার তত্ত্বের খণ্ডীকরণ
গুপ্তযুগের শেষ পর্যায়ে ভারত-রোম বাণিজ্য বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের পথটি উন্মোচিত হয়। ঢোল আমলে এই অঞ্চলের শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য রাজেন্দ্র চোলের বশ্যতা স্বীকার করে এবং সেই সুবাদে চোল দেশীয় বণিকরা জাভা ( Java), সুমাত্রা (Sumatra) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জে (Malay Archipelago) স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন এবং দক্ষিণ ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র (Commercial and Cultural Links) গড়ে তোলেন। নবম শতকে চিনের সুঙ (Sung) বংশীয় শাসকদের সঙ্গে চোলদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
একাদশ শতকে ইউরোপীয় অভিযাত্রী মার্কোপোলো ভারত ভ্রমণে আসেন এবং মালাবার উপকূলে ঘোড়া বাণিজ্যের উল্লেখ করেন। বলাবাহুল্য যে, পূর্ব এবং পশ্চিম, উভয় দেশগুলির সঙ্গে ভারতবর্ষের বাণিজ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল। দূর-বাণিজ্য ছাড়া আন্তদেশীয় বাণিজ্যের প্রাধান্য ছিল, যা বিভিন্ন ক্রয় ও বিক্রয় কেন্দ্রগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়, যেমন— হট্ট/হট্টিকা/হাট, মণ্ডপিকা/মণ্ডপম ইত্যাদি। এখানে নানাবিধ পণ্যসামগ্রী কেনাবেচা হত। বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে নানাদেশী (Nanadesi), স্কন্ধক ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়।
একদিকে যেমন শর্মা তাঁর গ্রন্থ ‘আরবান ডিকে ইন ইন্ডিয়া’ (Urban Decay in India)-তে ভারতীয় নগরগুলির বাণিজ্যের অভাবে ‘রক্তশূন্যতা’র উল্লেখ করেছেন, অন্যদিকে ইতিহাসবিদ ব্রজলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য মেকিং অব আর্লি মেডিয়াভেল ইন্ডিয়া’ (The Making Early Medieval India)-তে এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, ভারতের আদি মধ্যযুগ ছিল তৃতীয় নগরায়ণের পর্যায় (Phase of Third Urbanisation), যা ভারতীয় of নগরের চরিত্রকে বহুমাত্রিকতা (Multi-dimensionality) প্রদান করে।
বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের দৃষ্টান্ত উত্থাপন করে ড. চট্টোপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ভারতের নগরায়ণের প্রক্রিয়া আদি-মধ্যযুগে বিকেন্দ্রীভূত (Decentralised) আকার ধারণ করে এবং প্রাচীনকালের মুখ্য বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলি ব্যতীত আরও একাধিক নগরের সন্ধান পাওয়া যায়। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, নগরায়ণের প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে যায়নি, বরং নতুন অবস্থায় তা আরও ব্যাপ্তি লাভ করে।
হরবংস মুখিয়া ও দীনেশচন্দ্র সরকার, শর্মা ও যাদবের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন যে, অগ্রহার ব্যবস্থায় দানগ্রহিতা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না। এর প্রধান কারণ হল এই যে, সমস্ত ভূসম্পত্তির মালিকানা ছিল রাজার এবং তিনি তাঁর ইচ্ছানুসারে বা কৌশলগত কারণে (Strategic Reasons) তার অধস্তন কর্মচারীবৃন্দকে জমিদান করতেন।
ইউরোপীয় ভূমিদাসদের ন্যায় ভারতীয় কৃষকগণ তাঁদের উৎপাদিত ফসল থেকে বঞ্চিত হতেন না বা সামন্তপ্রভুর সঙ্গে কোনোপ্রকার চুক্তিতে আবদ্ধ থাকতেন না। কৃষিজীবীদের তাঁদের শাসকদের সঙ্গে ইউরোপের মতো কোনো প্রকার Contractual obligation ছিল না। তাই ইউরোপীয় ধাঁচে কোনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা এখানে গড়ে ওঠেনি। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। মধ্যযুগীয় ইউরোপের Dark Age থেকে ভারতবর্ষ ছিল শতসহস্র যোজন দূরে। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।