আধুনিক যুগে মধ্যকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রটি সংক্ষেপে আলোচনা করো ।
মধ্যকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চা :
উত্তর ভারতের তুলনায় পূর্ব ভারতে তুর্কি শাসনের চরিত্র ছিল ভিন্ন, যদিও সব মুসলিম শাসক তুর্কি বংশোদ্ভূত ছিলেন না। আবহাওয়ার আর্দ্রতা ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এর একটি কারণ বিশেষ। খাল-বিল বেষ্টিত নদীমাতৃক বাংলাদেশ এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। এই ‘বোল ফ্রন্টিয়ার‘ (Bengal Frontier) এলাকায় বসতি স্থাপন, নগরায়ণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলবৎ করা ছিল নবাগত ইসলামি শাসকদের কাছে একটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ। গৌড়বঙ্গে যদিও বা তা সম্ভবপর হয়েছিল, পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গে (বঙ্গ-সমতট অঞ্চল) ঘন জঙ্গল এবং হিংস্র বন্য প্রাণীর অস্তিত্বের দরুন এই কাজ অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। এই প্রতিবন্ধকতার কারণে বসতি স্থাপন, কৃষিকাজ ও নগরায়ণের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ছিল। বিশেষত সুন্দরবন। অঞ্চলের নোনা আবহাওয়া ও বিপৎসংকুল প্রাকৃতিক পরিবেশ যে-কোনো গঠনমূলক কার্যক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও উদ্যমের কাছে প্রকৃতি হার মানে। মুষ্টিমেয় সুফির দল এবং তাঁদের অনুগামীরা এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করেন ও বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিকে বাসযোগ্য করে তুলতে সাহায্য করেন। বাংলার দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই গঠনমূলক কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তা ছাড়া সুফিগণ সাধারণ হিন্দু জনসাধারণের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করেন এবং ইসলামের সঙ্গে স্থানীয় রীতিনীতির মেলবন্ধনের প্রয়াস করেন। সুফি সাধকদের এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে নদীমাতৃক বাংলায় এক সমন্বয়বাদী সংস্কৃতি (Syncretic Culture) জন্ম নেয়।
সৈয়দ ও লোদী বংশের শাসনকালে সুলতানি শাসনব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে এবং 1526 খ্রিস্টাব্দে (1526 CE) সংঘটিত পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (First Battle of Panipat) সুলতানি শাসনের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। অতঃপর বাবরের (Babar) নেতৃত্বে ভারতবর্ষে মুঘল (Mughal) শাসনের পথ প্রশস্ত হয়। মুঘলগণ মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি (Central Asian Steppes) অঞ্চল থেকে এসেছিলেন এবং তাঁরা তুর্কি ও মোঙ্গল, উভয় যাযাবর গোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও বংশপরম্পরার ধারক ও বাহক ছিলেন। সুন্নি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও মুঘল শাসকরা ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে অনেকাংশে মুক্ত ছিলেন। তাঁদের ভাষা, সাহিত্য ও সরকারি আদানপ্রদানের (Official Correspondence) মাধ্যম ছিল ফারসি।
মহামতি আকবর ব্যতীত, এদের মধ্যে সবাই শিক্ষিত ছিলেন। মুঘল যুগে সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তার পরাকাষ্ঠা লাভ করে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মুঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস রচনা একটি শিল্পের আকার ধারণ করে। এটি ছিল একটি ‘distinctive Indian historical tradition / মূলত মোঙ্গল ও তুর্কি গোষ্ঠীর ইতিহাস ও বংশাবলি রচনার পরম্পরাতে সিক্ত ও অনুপ্রাণিত, মুঘল শাসকগণ ও তাঁদের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত ঐতিহাসিকবৃন্দ (Historians under Mughal patronage) অনুৰূপ ইতিহাস শিল্পের স্রষ্টা ছিলেন। চাঘতাই তুর্কি (Chaghtai Turki) ভাষায় রচিত তৈমুর লঙের আত্মচরিত, ‘তুজুক-ই-তৈমুরী’ (Tuzuki-Timuri), বাবরের ‘ভুজুক-ই-বাবরী’ (Tuzuki-Babari) এবং জাহাঙ্গীরের ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি‘ (Tuzuk-i-Jahangiri) রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়।
তুর্কি, ফারসি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী বাবর তাঁর আত্মচরিতে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বিশদ বিবরণ দেন। তিনি নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করেন যে, ভারতবর্ষের সম্পদ ও তার প্রাচুর্য তাঁকে এই দেশ আক্রমণ করতে প্রলুদ্ধ করে। বাবরের কন্যা গুলবদন বেগম (Gulbadan Begum) ‘হুমায়ুন নামার‘ (Humayun namah) রচয়িতা ছিলেন। এটা উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, মুঘল রাজপরিবারে পুত্রসন্তানদের সঙ্গে কন্যাসন্তানদের শিক্ষা দীক্ষার ওপর সমদৃষ্টি দেওয়া হত। সম্রাট হুমায়ুনের ভৃত্য জওহর আফতাবচি (Jauhar Aftabchi) ‘তাজকিরত-উল-ওয়াকিয়ত‘ (Tazkirat-ul-Waqiat) রচনা করেন। তৎকালীন তুর্কি ও মুসলিম সমাজব্যবস্থায় গৃহ-ভৃত্য ও দাসদের যোগ্যতা অনুসারে মর্যাদা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বাবরের নিকট-আত্মীয় মিরজা হায়দর দুঘলত (Mirza Haider Dughlat) 1551 খ্রিস্টাব্দে ‘তারিখ-ই-রশিদি‘ (‘Tarikh-i-Rashidi) রচনা করেন। এটি 1510 খ্রিস্টাব্দে (1510 CE) বাবরের আফগানিস্তানের মার্ভ (Merv) অঞ্চলে সামরিক অভিযানের উল্লেখ করে
1539 এবং 1540 খ্রিস্টাব্দে বিল্পগ্রাম ও চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন ভারতবর্ষ থেকে পলায়ন করেন এবং বিজেতা শেরশাহ মুঘলদের অবর্তমানে কিছুকাল যাবৎ (1540-1546 খ্রিস্টাব্দ) ভারতবর্ষ শাসন করেন। তাঁর শাসনকালের ইতিবৃত্ত জানা যায় আব্বাস শেরওয়ানী (Abbas Sherwani) রচিত গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-শেরশাহী’ (Tarikh i-Shershahi)-র মাধ্যমে। পরবর্তীকালে আকবরনামা রচনার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের কাজ করে।
দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে (খ্রিস্টাব্দ 1555) আফগানরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং বৈরম খানের তত্ত্বাবধানে আকবর রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর শাসনকালে ইতিহাস রচনা বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং তার মাধ্যমে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নথিভুক্তকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও আকবর নিজেকে ভারতীয় হিসেবে দেখতে অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন এবং সেই সুবাদে তাঁর নেতৃত্বে মুঘল সাম্রাজ্য একটি সর্বভারতীয় আকার ধারণ করে। তিনি অধিকাংশ রাজপুত রাজ্যগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তাদের বেশভূষা কিছু অংশে গ্রহণ করেন। আকবরের আমলে রাজপুতদের পরিহিত পাগড়ি সর্বস্তরে গৃহীত হয় এবং মুঘল প্রতিষ্ঠানের (Mughal Establishment) ভারতীয়করণ (Indianisation) সম্পন্ন হয়। এর ফলে, তৈমুর ও চেঙ্গিস বংশীয় মুঘলগণ প্রকৃত অর্থে ভারতীয় হয়ে ওঠেন।
1591-92-খ্রিস্টাব্দে আকবরের একান্ত অনুগ্রহ ও তত্ত্বাবধানে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি সম্পাদক মণ্ডলী (Editorial Board) ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ও প্রচারের এক সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হওয়া উপলক্ষে ‘তারিখ-ই-আলফি‘ (Tarikh-i-Alf) নামে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটি আকবরকে ইসলামের একজন প্রধান শাসক ( Padshah of Islam) হিসেবে তুলে ধরে এবং যোগ্যতা অনুযায়ী যে-কোনো ব্যক্তিকে (বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও) তার ন্যায্য প্রাপ্য উপলব্ধ করানোর ক্ষেত্রে সম্রাটের এই বিশেষ গুণটির মর্যাদা দেওয়া হয়। আকবরের বিপরীতে তুর্কির সুলতান স্থানীয় প্রতিভা (local talent)-কে প্রাধান্য দেওয়াই শ্রেয় মনে করতেন ।
আকবরের রাজসভার দুই অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবুল ফজল (Abul Fazal) ও তাঁর ভ্রাতা ফৈজী (Faizi)। আবুল ফজল তাঁর গ্রন্থদ্বয় ‘আইন-ই-আকবরী‘ (Ain-i-Akbari) এবং ‘আকবরনামা‘ (Akbarnamah) এর জন্য খ্যাত। ড. জগদীশ নারায়ণ সরকারের মতানুসারে, আবুল ফজল ছিলেন “The first historiographer of Akbar” ২ ‘আইন-ই-আকবরী’ ও ‘আকবরনামা” গ্রন্থ দুটি মুঘল ভারতের সম্পূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আইন-ই-আকবরী আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের কথাও বলে।
পূর্বোল্লিখিত ঐতিহাসিকরা ছাড়া অন্যান্য যে-সমস্ত ঐতিহাসিক ছিলেন তাঁরা হলেন নিজামউদ্দিন আহমদ বক্সি (গ্রন্থ তাকত্-ই-আকবরী), আব্দুল কাদের বদাউনি (গ্রন্থ— মুগ্ধখাব-উত-তওয়ারি (Muntkhabut-Tawarikh) এবং হাজি মোহম্মদ আরিফ কন্ডাহারী (গ্রন্থ-তারিখ-ই-আকবরশাহী)। আকবরের সমসাময়িক গোস্বামী তুলসীদাস ‘রামচরিতমানস’ রচনা করেন।
আকবরের পুত্র জাহালীর তাঁর আত্মচরিত তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি রচনা করেন। তাঁর সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা হলেন যথাক্রমে মহম্মদ শরিফ মুস্তামন খান বকসী (গ্রন্থ ইকবালনামা-ই-জাহাঙ্গীরি), নওয়াজা কামগর থৈর খান (গ্রন্থ – মজির-ই-জাহাঙ্গীরি) প্রমুখ। শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘল ইতিহাসচর্চা প্রসারতা লাভ করে। মোহম্মদ সাদিক খান (Muhammad Sadiq Khan) শাহজাহাননামা‘ (Shahjahan namah) রচনা করেন। ‘বাদশাহনামার‘ (Badshah namah) রচয়িতা ছিলেন শাহজাহানের রাজকীয় গ্রন্থাগারিক মোহম্মদ তাহির (Muhammad Tahir)। ভগবানদাস রচিত ‘শাহজাহাননামা’ এবং মোহম্মদ জাহিদ (Muhammad Zahid) রচিত ইস্তখান-ই-ওয়াকায়াত-ই শাহজাহানী’ (Intkhabi waqaat-i-Shah Jahani) দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ ।
সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে রাজনৈতিক অস্থিরতা (মারাঠা, শিখ, জাঠ বিদ্রোহ) ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থার (মনসবদারি বিপর্যয়) কারণে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ স্তিমিত হয়ে আসে। কথিত আছে যে, গোঁড়া সুন্নি মুসলিম (Orthodox Sunni Muslim) হওয়ার সুবাদে ঔরঙ্গজেব আমোদ-প্রমোদ ও শিল্পকলার ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং কোনো প্রকার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁর সম্মতি বা উৎসাহ ছিল না। আরবি, ফারসি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় সিদ্ধহস্ত হওয়া সত্ত্বেও পূর্বসুরিদের ন্যায় কোনো আত্মচরিত তিনি রচনা করেননি। তাই কৃষ্টিগত দিক থেকে ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল নিতান্তই নির্জলা। তৎসত্ত্বেও তাঁর অগোচরে সম্রাটের গুণমুগ্ধরা তৎকালীন সময়ের কিছু ঐতিহাসিক উপাদান রেখে গিয়েছেন যার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
মিরজা মোহম্মদ কাসিম (Mirza Md Qasim) গোপনে ঔরঙ্গজেবের জীবনী ‘আলমগীরনামা‘ (Alamgirnamah) রচনা করেন। তাঁর এক সতীর্থ কাফি খান (Khafi Khan) ‘মুস্তখাব-উল-লুবাব’ (Muntakhab ul-Lubab)-এর রচয়িতা ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল হাশিম আলি খান। এ ছাড়া ডিমসেন বুরহানপুরি (Bhimsen Burhanpuri) রচিত ‘নুসখা-ই-দিলখুশা’ (Nuskha-i-Dilkhusa) এবং ঈশ্বরদাস নাগরের (Ishwardas Nagar) ‘ফতুহাৎ-ই-আলমগিরি’ (Fatuhati Alamgiri) বিশেষ দ্রষ্টব্য।
ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা কাবুল থেকে আরাকান এবং কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। কিন্তু সাম্রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়ায় ঔরলাজেবকে বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। তাঁর প্রান্ত রাজনীতি ও ধর্মীয় অসহিঞ্চুতার ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর বিরাগভাজন হন ও বিরুদ্ধাচারণ করেন। ঔরঙ্গজেবকে কার্যত সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয় ছত্রপতি শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতির কাছে।
সন্ত তুকারাম, একনাথ ও রামদাসের অনুপ্রেরণায় শিবাজী কষ্টসহিয়ু এবং যুদ্ধে পারদর্শী মারাঠা জাতিকে সংঘবদ্ধ করেন এবং প্রথমে বিজাপুর ও পরবর্তীকালে মুঘল শাসকদের বিরুদ্ধে অবিরাম গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। শিবাজীর সামরিক কার্যকলাপ এবং তাঁর প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার প্রধান উৎস হল মারাঠি রাখার (Bakhar)। সর্বসাকুল্যে শিবাজীর রাজত্বকালে মোট নয়টি বাখার রচিত হয়েছিল। মারাঠি ভাষায় প্রথম বাখারটি রচনা করেন শিবাজীর সভাসদ দত্তাজি (Dattaji), যার রচনাকালের সময় আনুমানিক 1685 খ্রিস্টাব্দ।” দ্বিতীয় এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রামাণ্য বাখার হল সভাসদ রাখার (Sabhasad Bakhar ) যার রচয়িতা ছিলেন কৃয়জি অনন্ত সভাসদ । সভাসদ বাখারের আখ্যান অনুযায়ী শিবাজী তাঁর রাজত্বকালে সমস্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলির দুর্গ ধ্বংস করেছিলেন, সামস্তদের ভূমিদান প্রথার বিলোপসাধন ঘটিয়েছিলেন এবং গ্রামপ্রধানদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজস্ব সংগ্রহের বন্দোবস্ত করেছিলেন।
বাখার বৃত্তান্ত ব্যতীত কিছু সংস্কৃত নথির মাধ্যমে শিবাজীর রাজত্বকাল সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়। উদাহরুণস্বরূপ তাঁর সভাকবি পরমানন্দ দ্বারা রচিত প্রশস্তি ‘শিবা ভারত’ ছাড়া চিঠিপত্র ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ শিবাজীর প্রশাসন সম্বন্ধে আলোকপাত করে। উদাহরণস্বরূপ শিবাকালিন পত্রসার সংগ্রহ ( Sivakalin Patrasar Samgraha), শিবা চরিত্র সাহিত্য (Siva Charitra] Sahitya ) এবং শিবা চরিত্র প্রদীপ (Siva Charitra Pradipa) Ph মুঘল ও মারাঠা ঐতিহাসিক উপাদান ব্যতীত রাজপুত ও শিখ ইতিহাসের উপাদানগুলি সমান গুরুত্ব রাখে। যুদ্ধ ও কলহপ্রিয় রাজপুত গোষ্ঠী তাঁদের শৌর্য এবং বীর্যের জন্য সুবিদিত।
800-1200 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজপুতদের প্রাধান্য থাকায়, এই যুগকে রাজপুত যুগ (Age of Rajputs) বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি মুঘল সাম্রাজ্যে রাজপুত্রগণের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব ছিল। এই গোষ্ঠীর ইতিহাসের প্রধান উপাদান হল রাসো (Raso) অর্থাৎ, চারুণ কবিদের দ্বারা রচিত বিভিন্ন বীরগাথা সংগ্রহ’ (ballads)। এগুলির মধ্যে প্রধান হল ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’ (Prithviraj Raso), হম্মীর রাসো (Hammir Raso), খুমান রাসো (Khuman Raso) প্রভৃতি। কর্নেল জেমস্ টড (Col. James Todd) তাঁর গ্রন্থ Annals and Antiquities of Rajasthan 4 রাজপুত গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন।
শিখ ঐতিহাসিক উপাদানগুলি মূলত গুৰুমুখি ( Gurumukhi) ভাষায় রচিত। এগুলির মধ্যে প্রধান গ্রন্থগুলি হল ‘আদি-গ্রন্থ’ (Adi Grantha), ‘দসম পাদশাহ কা গ্রন্থ (Dasam Padshah Ka Granth), ‘বচিত্র নাটক’ (Bachitra Natak) ইত্যাদি। এ ছাড়া ফারসি ভাষায় কিছু গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়, যেমন ‘জাফরনামা‘ (Zafarnamah ) ferta (Zindaginamah) ।
ইউরোপীয় বণিক ও পর্যটকদের বিবরণ মুঘল এবং তাদের পরবর্তী সময়ের ওপর আলোকপাত করতে বিশেষ সহায়ক হয়। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন র্যাফ ফিচ (Ralph Fitch), পেনসার্ট (Paclsert), পিটার মান্ডি (Peter Mundy) মানুচি (Manucci), বারনিয়ের ও টাভেরনিয়ের (Bernier and Tavernier), সেবাস্টিয়ান মানরিক (Sebastien Manrique) প্রমুখ। এরা বহিরাগত হওয়ার দরুন অনেকটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে সক্ষম হয়েছেন।
ঔপনিবেশিক ও স্বাধীনোত্তর যুগে মধ্যকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনেক বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন ইলিয়ট ও ডাউসন (Elliot and Dowson – The History of India as told by its own historians, 1867-1877), Stanley Lanepod Medieval India under Muhammadan Rule, 1903, W. H. Moreland: The Agrarian System of Moslem India, 1929, A. H. Beveridge (Transl) : Babur namah, Humayun namah, Ain-i- Akbari, Sir Wolseley Haig (Transl) : Tarikh i-Badauni, The history of the Nizamshahi King of Ahmednagar, The Cambridge History of India, Vol. IV, The Mughal Period। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন Sir Jadunath Sircar (India of Aurangzib, Studies in Mughal India)।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে যারা মধ্যকালীন ভারতের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক চিত্রের বর্ণনা করেছেন, তাঁরা হলেন A B M Habibullah (The Foundation of Muslim Rule in India), Muhammad Habib and K. A. Nizami ( The Delhi Sultanate, Vol. V), Anil Chandra Bannerjee (History of Medieval India), Jagadish Narayan Sarkar (History of History Writing in Medieval India, Islam in Bengal), Tapan Roychowdhury and Irfan Habib (The Cambridge Economic History of India, Vol. I), Shireen Moosvi (Economy of the Mughal Empire), Irfan Habib (Atlas of the Mughal Empire) এবং Gautam Bhadra।
- ইরফান হাবিব (The Agrarian System of Mughal India, 1963), সতীশ চন্দ্র (Essays on Medieval Indian History, 2003) এবং আথার আলি (The Mughal Nobility Under Aurangzeb, 1966) মুঘল সাম্রাজ্যের বিপর্যয়ের জন্য ঔরঙ্গজেবের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। অর্থনৈতিক দৈন্য, আমির-ওমরাহদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং শেষপর্যন্ত নাদির শাহের আক্রমণ সাম্রাজ্যের কাঠামোগত দুর্বলতা (Structural weakness)-কে জনসমক্ষে তুলে ধরে। মধ্যকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চা অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময় ভারতবর্ষ এক যুগসন্ধিক্ষণ (Transition) প্রবেশ করে।