ইলিয়াস শাহী ও হুসেন শাহী বংশের শাসকগণ কীভাবে সাহিত্য ও ইতিহাসের পৃষ্ঠপোষকতা করেন?
ইলিয়াস শাহী ও হুসেন শাহী বংশের সুলতানরা এই সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের কলা, কৃষ্টি ও সাহিত্য সমৃদ্ধি লাভ করে। দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের নাগপাশ থেকে কার্যত স্বাধীন হওয়ার সুবাদে এই বংশের শাসকেরা ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উলেমাদের নজরদারি থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিলেন এবং তাই সাধারণ অমুসলমান প্রজা ও রাজকর্মচারীদের সঙ্গে নিকট সম্বন্ধ গড়ে তোলেন। অনেক উচ্চপদস্থ হিন্দু রাজকর্মচারী ‘খান’ উপাধি লাভ করেন।
বাংলার সুলতানগণ হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিগুলি শুনতে ভালোবাসতেন এবং সেই সুবাদে হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদের ক্ষেত্রে লেখকগণ তৎকালীন শাসকদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। মালাধর বসু রচনা করেন ‘শ্রীকৃষ্মবিজয়‘। এ ছাড়া বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ ও শ্রীধরের ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রাজসভায় সমাদর পায়।
সুলতান নুসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় রামায়ণ ও মহাভারত বাংলা ভাষায় রচিত হয়। এ ব্যতীত কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত‘, বিপ্রদাস পিপিলাই রচিত ‘মনসামঙ্গল‘, জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল‘ ইত্যাদি সমাদৃত হয়। মধ্যযুগে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য রচনা করা হয় যা ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে। এই ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পাঞ্জাবি, মারাঠি, তেলেগু, মালয়ালম, হিন্দি ও উর্দু।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসক কৃয়দেব রায় শুধুমাত্র একজন সফল যোদ্ধা ছিলেন না, তদুপরি উনি একজন সাহিত্যোৎসাহী ব্যক্তি ও বিদগ্ধ কবি ছিলেন। ‘অমুক্তমলয়াদা‘ (Amuktamalayada) ছিল তাঁর বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থ। মীরাবাইয়ের ভজন ব্রজভাষায় রচিত হয় এবং তা সমগ্র ভারতবর্ষে খ্যাতি অর্জন করে। রাজপুতদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তিনি নিজের স্থান তৈরি করে নেন। হিন্দি, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতের সংমিশ্রণে একটি নতুন ভাষার উদ্ভব হয় যা উর্দু নামে পরিচিতি লাভ করে।
- ভাষাতত্ত্ববিদ ড. সুকুমার সেন উর্দুকে পৃথক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ওনার মতানুসারে এটি ছিল এক ধরনের Muslim version of Hindi যা দিল্লি ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে দ্রুত প্রসার লাভ করে। মুসলিম কবি ও সাহিত্যিকগণ ভারতীয় উপাদান (Theme)-কে ব্যবহার করে নিজেদের কাব্যকুশলতা ও সাহিত্যপটুতার পরিচয় দেন। এদের মধ্যে বিশিষ্টজনেরা হলেন মালিক মোহম্মদ জায়সি (পদ্মাবত, অথরাবট, আখিরী কলাম- Padmavat, Akhravat, Akhiri Kalam), মঋন ( Manjhan), কুতুবন ( Qutuban) ইত্যাদি। সুলতান জেন উল-আবিদিন (Zainul Abidin) যিনি কাশ্মীরের আকবর (Akbar of Kashmir) নামে খ্যাত, মহাভারত ও রাজতরঙ্গিনী নামক দুটি আকর গ্রন্থ অনুবাদের ব্যবস্থা করেন।