হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার সম্পর্ক ।
হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য ।
ভূমিকা :
১৯২০-র দশকে হরপ্পা সভ্যতা (তৎকালীন সিন্ধু সভ্যতা) আবিষ্কারের পর থেকে এই সভ্যতার প্রাচীনত্ব, নগর-নির্মাণ কৌশল প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সমসাময়িক সভ্যতার সঙ্গে এর সম্পর্ক নির্ধারণের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পণ্ডিতমহলে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি সমস্যার সৃষ্টি করে তা হল হরপ্পা সভ্যতায় যে উন্নত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তার স্রষ্টা কারা? এদেশের মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই এত বড় একটি উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল, না সমসাময়িক অন্য কোনো সভ্যতা এর সৃষ্টি ও বিবর্ধনের পিছনে কাজ করেছিল?
• হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার সম্পর্ক
হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে সুমেরীয় বা মেসোপোটেমীয় সভ্যতার বেশ কিছু ব্যাপারে সাদৃশ্য দেখে একশ্রেণীর পণ্ডিত স্পষ্টতই ঘোষণা করেছিলেন যে, সিন্ধুনদের তীরে অবস্থিত উন্নত সংস্কৃতি হল সুমেরীয়দের দান। ড. এইচ. আর. হল এই মতবাদের অন্যতম প্রধান সমর্থক। এরকমও বলা হয়ে থাকে যে, সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতার ধারণা এসেছিল ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস থেকে এবং হরমীয়দের সভ্যতা গঠনের প্রারম্ভিক পরিকল্পনা এসেছিল ঐ অঞ্চল থেকেই।
এইচ. আর. হল ও তাঁর অনুগামীদের এই মতবাদের পিছনে অন্যতম প্রধান যুক্তি হল যে উভয় সভ্যতার মধ্যে বেশ কিছু ব্যাপারে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। এই সাদৃশ্যগুলি এক এক করে উল্লেখ করা যেতে পারে।
১. মেসোপোটেমিয়ার নগরগুলির মতো আমাদের দেশের হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলি ছিল নদীর তীরে অবস্থিত।
২. হরপ্পা সভ্যতার মানুষের ন্যায় সুমেরীয় নগরের অধিবাসীরাও মাতৃমূর্তির পূজা করত। মৃৎপাত্র তৈরিতে হরপ্পীয়দের ন্যায় কুমোরের চাকা ব্যবহারের রীতিও প্রচলিত ছিল মেসোপোটেমিয়ার নগরগুলিতে।
৩. লিখন প্রণালীর প্রচলন উভয় সভ্যতাতেই বিরাজমান ছিল।
৪. মেসোপোটেমিয়ার আদি পর্বের সাতটি প্রধান নগরের অভিভাবক হিসাবে যে সাতজন সাধুর উপাখ্যান প্রচলিত আছে হরপ্পা সভ্যতার দুটি সীলমোহরে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
উপরিউক্ত সাদৃশ্যগুলি ছাড়াও হরপ্পা সভ্যতার সৃষ্টিতে মেসোপোটেমীয় সভ্যতার আরো একটি ভূমিকাকে স্বীকার করা হয়ে থাকে। এরকম বলা হয় যে, মহেঞ্জোদারোয় খননকার্যের ফলে বোঝা গেছে যে এর সর্ব নিম্নস্তরের সভ্যতাও যথেষ্ট পরিণত। যাঁরা সিন্ধু সভ্যতার পিছনে সুমেরীয়দের দানকে স্বীকার করেন তাদের বক্তব্য হল যদি এই সভ্যতা প্রকৃতই দেশীয় মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হত তাহলে প্রারম্ভিক অবস্থা থেকেই তা এত পরিণত হত না। নিশ্চয়ই সুমেরীয়রা এই সভ্যতার পত্তন ঘটিয়েছিল। সুতরাং এঁদের মতে, হরপ্পা ও সুমেরীয় এই দুটি সভ্যতা কেবল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্তই নয়, একটির দ্বারা অপরটি প্রথম থেকেই প্রভাবিত।
পশ্চিম এশিয়ার সভ্যতার প্রভাবে সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এই ধারণা সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় থাকলেও উভয় সভ্যতার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল সে বিষয়ে অবশ্য কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে রোমিলা থাপারের বক্তব্য হল, হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার যোগাযোগ সুবিদিত। হরপ্পা সভ্যতার লক্ষণযুক্ত কয়েকটি বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে ওমান থেকে।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ধরনের সীলমোহর মেসোপোটেমিয়ার উর ও সংলগ্ন অঞ্চলে যে পাওয়া গেছে সে-কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। একথাও আলোচনা করা হয়েছে যে, উভয় সভ্যতার মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন নিশ্চয়ই বজায় ছিল এবং এই বাণিজ্য চলত মূলত সমুদ্রপথে। পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্যের সূত্র ধরে হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলি থেকে যে সমস্ত দ্রব্য আমদানি হত তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুতিবস্ত্র। বাণিজ্যের সূত্র ধরে যে সমস্ত দ্রব্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি ও রপ্তানি হত সে-সম্পর্কে এর আগে বহির্বাণিজ্য প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। মর্টিমার হইলার গর্ডন চাইল্ড প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ উভয় সভ্যতার মধ্যে এই সামুদ্রিক বাণিজ্যের গুরুত্ব স্বীকার করে থাকেন।
উভয় সভ্যতার মধ্যে নানা বিষয়ে সামঞ্জস্য থাকলেও বেশ কিছু বিষয়ে বৈসাদৃশ্য বর্তমান। আসলে হরপ্পা ও পশ্চিম এশিয়ার সভ্যতাগুলি নিজ নিজ দেশীয় প্রকৃতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। তাই উভয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মর্টিমার হইলার দেখিয়েছেন যে, হরপ্পা সভ্যতার টেরাকোটাগুলি মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। হরপ্পীয় সীলমোহরগুলির শিল্প-সুষমা মেসোপোটেমিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত নয়। হরপ্পা সভ্যতার লিপিগুলি অপঠিত হলেও বোঝা যায় যে এগুলি সুমারের লিপির অনুরূপ নয়।
মূল্যায়ন :
হুইলার বলেছেন যে, সিন্ধু (বর্তমান হরপ্পা) সভ্যতার বিশুদ্ধতা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব। এছাড়া সুমারের স্থাপত্য ভাস্কর্যের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার স্থাপত্যশৈলীর কোনো প্রকৃত মিল নেই। ইটগুলির মাপের ক্ষেত্রে সমতা বজায়, ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মান বজায় রাখা প্রভৃতি হরপ্পা সভ্যতার সুসংগঠিত ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়, যা সুমেরীয় সভ্যতায় বিরল। ডি. ডি. কোসাহী হরপ্পা ও মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার মধ্যে আর একটি পার্থক্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, হরপ্পা সভ্যতায় কৃষিক্ষেত্রে জল সরবরাহের জন্য নদীতে বাঁধ বেঁধে জলাধার সৃষ্টির সঙ্গে মেসোপোটেমিয়ার সেচখালের বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান।