চালুক্য স্থাপত্য ভাস্কর্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে আলোচনা কর । বাদামির চালুক্য রাজাদের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলা।
ভূমিকা:
বাদামির চালুক্য রাজাদের খ্যাতি কেবল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না সাংস্কৃতিক দিক বিশেষ করে স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে চালুক্য রাজাদের অবদান অনস্বীকার্য। স্থাপত্যকে সাধারণত দুটি পর্ব যথা— গুহা স্থাপত্য ও মন্দির স্থাপত্যে ভাগ করা হয়ে থাকে। তবে গুহা স্থাপত্যের নিদর্শন আলোচ্য পর্বে খুব বেশি নেই। চালুক্যগণ এবং দাক্ষিণাত্যে তাদের উত্তরসূরি রাষ্ট্রকূটদের আমলে ইলোরায় বিখ্যাত ব্রাহ্মণ্য গুহার সমৃদ্ধি লক্ষ করা যায়।
৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে এই পর্যায়ের ষোলোটি গুহা স্থাপত্যের নিদর্শন মিলেছে ইলোরায়। এই ষোলোটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল দশাবতার (গুহা নং ১৫), রাফা-কা-খাই (গুহা নং ১৪), রামেশ্বর (গুহা নং ২১) এবং ধুমর লেন (গুহা নং ২৯)। এই চারটির মধ্যে রাবণ-কা-খাই ও রামেশ্বরের দেওয়ালে প্রচুর পরিমাণে খোদাই করার নিদর্শন মেলে, যা এর অপরূপ ভাস্কর্যের পরিচয় দেয়। এছাড়া দুটি জৈন গুহা স্থাপত্যের নিদর্শন মিলেছে বাদামি ও আইহোলে।
স্থাপত্য :
মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে চালুক্যদের অবদান কম নয়। বস্তুত, দাক্ষিণাত্যে প্রথম দিকে মন্দির স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন পশ্চিমী চালুক্য বা বাদামির চালুক্যরা প্রধানত ৫৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। আলোচ্য সময়কালে কতকগুলি অঞ্চল মন্দির স্থাপত্য নিদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এই অঞ্চলগুলি হল আইহোল, পত্তদকল, মহাকুট, বাদামি ও আলমপুর। এগুলি মন্দিরের গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কর্ণাটকের বিজাপুর জেলার বাদামি ভালুকের অন্তর্গত আইহোল গ্রামে পাথরের তৈরি প্রায় ১০০টি মন্দির চালুক্যদের প্রথম সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে।
আইহোলের মন্দিরগুলি তাদের পুরনো কাঠামো এবং সুদৃঢ় পৌরুষোচিত শৌর্যের জন্য খ্যাত। সাধারণত আইহোলের মন্দিরগুলির মধ্যে লাদখানের মন্দিরকেই সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ অবশ্য আইহোলের কোন্টিগুড়ি গ্রুপের মন্দিরগুলির ভিতের পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের ধরন দেখে মনে করেন যে লাদখানের মন্দিরগুলির তুলনায় এগুলি ছিল পুরনো। কোন্টিগুড়ি গ্রুপ বা পর্যায়ের মন্দিরগুলি সাধারণত পূর্বমুখী এবং কখনো কখনো পশ্চিমমুখী। এই মন্দিরগুলি ‘মুখমণ্ডল’, সভামণ্ডপ ও অন্তরালহীন, যা এর স্থাপত্য শিল্পের প্রারম্ভিক পর্যায়ের ইঙ্গিত দেয়।
বস্তুতপক্ষে আইহোলের আদি পর্বের মন্দিরগুলির মধ্যে লাদখানের মন্দির সর্বাপেক্ষা পূর্ণতা প্রাপ্ত। এই মন্দির পরিকল্পনাগত দিক থেকে যদিও সাদামাটা তথাপি কোন্টিগুড়ি গ্রুপের তুলনায় এর প্রকাশভঙ্গিমা অনেক ভালো। এখানের মন্দিরে মুখমণ্ডপ ও সভামণ্ডপও রয়েছে। আকারগত দিক থেকে মন্দিরটি নীচু ও চতুর্ভুজ সমতল ছাদ সম্পন্ন। মন্দিরটি পূর্বমুখী। বাকি তিনটি দিক দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। এর মধ্যে দুটি দিকে ছিদ্র করা পাথরের গ্রিল লক্ষ করা যায়। মন্দিরটির অভ্যন্তরে রয়েছে একটি হলঘর। বেশ স্তম্ভ বা থাম সম্পন্ন এই হলঘরটি। এখানে পাথরের তৈরি একটি বৃহৎ বৃষ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বস্তুত, লাদখানের মন্দিরের পরিকল্পনার মধ্যে একটা স্বচ্ছ শৃঙ্খলাবোধ চোখে পড়ে। পার্সি ব্রাউনের ভাষায় বলা যায়, “এই মন্দিরটি অনমনীয়, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী।””
চালুক্য আমলে নির্মিত আইহোলে লাদখানের মন্দির ছাড়াও আরো কয়েকটি মন্দিরের কথা এখানে উল্লেখ ও আলোচনা করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে উল্লেখিত আইহোলের বিখ্যাত দুর্গা মন্দিরটির কথা পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন। এটি নির্মিত হয়েছিল চালুক্য রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে। এটির দৈর্ঘ্য সর্বমোট ৮৪ ফুট এবং প্রস্থ ৩৬ ফুট। ভূমি থেকে একটির ওপর একটি করে স্তরে এটি বিন্যস্ত। শেষ স্তর পর্যন্ত এর উচ্চতা ৩০ ফুট এবং তার ওপর রয়েছে একটি ছোট পিরামিড আকারের গম্বুজ। বহু কারুকার্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ স্তম্ভের ওপর মন্দিরটি দণ্ডায়মান। একটি সুন্দর ও শোভাময় বারান্দা আছে। এছাড়া, পূর্বপ্রান্তে গম্বুজাকৃতি ছাদওয়ালা অর্ধবৃত্তাকার একটি স্থানে গর্ভগৃহের ওপর থেকে একটি শিখর উঠে গেছে। বস্তুতপক্ষে, ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের বিবর্তনের ক্ষেত্রে আইহোলের এই দুর্গা মন্দিরটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।
দুর্গা মন্দিরের প্রায় অনুরূপ আইহোলের আর একটি মন্দির হল হুচ্চিমল্লিগুড়ি মন্দির। দুর্গা মন্দিরের ক্ষুদ্র সংস্করণ হল এটি। দুর্গা মন্দিরটির ন্যায় এই মন্দিরে গম্বুজাকৃতি ছাদওয়ালা অর্ধবৃত্তাকার কোনো স্থান বা মন্দিরের চতুষ্পার্শ্বস্থ কোনো স্তম্ভ শ্রেণী নেই। এই ধরনের সাধারণ মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্য তা হল অন্তরাল বা প্রকোষ্ঠ ও উপপ্রকোষ্ঠের উপস্থিতি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই গর্ভগৃহ এবং মণ্ডপ বা প্রধান হলঘরের মধ্যে একটা বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। আইহোলে মন্দির স্থাপত্যের বিবর্তন লক্ষ করা যায় আরো কয়েকটি মন্দির যথা—তারবসপ্পা, নারায়ণ, হুচ্চপ্পয়া-গুড়ি মন্দির গঠন ও নির্মাণের ক্ষেত্রে।
আইহোলে মন্দিরের কাঠামো নির্মাণের বিবর্তনে চূড়ান্ত পর্যায় লক্ষ করা যায় মেগুটি মন্দিরের ক্ষেত্রে। আগেই বলা হয়েছে যে এটি হল একটি জৈন মন্দির। দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে রবিকীর্তি কর্তৃক এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, আইহোল গ্রামের অনতিদূরে মেগুটি পর্বতে সুন্দর শোভাবর্ধনকারী এই মন্দিরটির অবস্থান। এই মন্দিরটির নির্মাণ উন্নত কৌশল ও পরিকল্পনার যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এটি একটি লম্বা আয়তক্ষেত্রাকার অট্টালিকা বিশেষ। এর দুটি অংশ। একটিতে আছে বেষ্টিত অবস্থায় মন্দির। আর একটি অংশে আছে ‘মুখমণ্ডপ’ বা স্তম্ভবিশিষ্ট বৃহৎ হলঘর। এই দুটির মাঝখানে আছে ‘অন্তরাল’ বা সরু প্রকোষ্ঠ, যা ঐ দুটি অংশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। এখানে আরো উল্লেখ করা যায় যে পূর্বে উল্লেখিত মুখমণ্ডলের ছাদে ওঠার জন্য সিঁড়ি আছে এবং নীচের মন্দিরের সোজাসুজি ছাদের ওপরেও জৈন মূর্তি সহ আর একটি মন্দির আছে। মেগুটি মন্দিরের বিশেষ গুরুত্ব হল এই যে, দক্ষিণের পরবর্তী মন্দির স্থাপত্যের ইতিহাসে এর প্রভাব পড়েছিল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আইহোলের মন্দিরগুলির পরিকল্পনা ও মন্দির স্থাপনে বিভিন্নতা ছিল। এতদসত্ত্বেও চালুক্যদের এই আদি পর্বের মন্দিরগুলির মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে এক বিবর্তনের ইতিহাস লক্ষ করা যায়। উল্লেখ্য কোনো কোনো পণ্ডিত আইহোলের এই আদি পর্বের মন্দিরগুলির সঙ্গে গুপ্ত যুগ থেকে চলে আসা প্রায় সমগ্র দেশে মন্দির স্থাপত্য ধারার সংযোগ খুঁজতে প্রয়াসী হয়েছেন।
চালুক্যদের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে দেখা গেছে যে পল্লব শাসক প্রথম নরসিংহবর্মণের কাছে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে শ্রেষ্ঠ চালুক্য শাসক দ্বিতীয় পুলকেশীর চূড়ান্ত পরাজয়ের সাথে সাথে চালুক্যদের চরম বিপর্যয় ঘটেছিল। এই বিপর্যয়ের ফলে আইহোলের স্থাপত্য সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই অবস্থা বজায় ছিল ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রথম বিক্রমাদিত্য কর্তৃক চালুক্যদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত। এরপর থেকে স্থাপত্য-ভাস্কর্যের কর্মকাণ্ডে নতুন উদ্যম শুরু হয়। তবে স্থাপত্যের কেন্দ্রস্থলের পরিবর্তন ঘটে আইহোল থেকে পত্তদকলে। এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে দ্বিতীয় পুলকেশীর পরবর্তীকালের চালুক্য শাসকরা ছিলেন শিবের উপাসক এবং পদেকল ছিল শৈবধর্মের প্রধান কেন্দ্র। যাই হোক না কেন, পত্তদকলের দশটি মন্দির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলির নির্মাণকাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে পরবর্তী একশো বছর। দশটি মন্দিরের মধ্যে পাঁচটিতে ‘নাগর’ বা উত্তর ভারতীয় শিল্প রীতি প্রতিফলিত, আর বাকি পাঁচটি দক্ষিণ ভারতীয় বা দ্রাবিড় শিল্প রীতি দ্বারা প্রভাবিত।
উত্তর ভারতীর বা নাগর রীতি প্রতিফলিত হয়েছে এমন মন্দিরগুলি হল পাপনাথ, জঙ্গুলিঙ্গ, গলগনাথ, কাশী বিশ্বেশ্বর এবং কাদসিদ্ধেশ্বর। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাপনাথ মন্দির, যা নির্মিত হয়েছিল আনুমানিক ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে। সামগ্রিকভাবে মন্দিরটি প্রায় ৯০ ফুট লম্বা। মন্দিরটির দীর্ঘানুপাতে উচ্চতা খুব বেশি নয়। উত্তর ভারতীয় নাগর রীতির ন্যায় গম্বুজটিও বেশ ছোট আকারের। এছাড়া ‘অন্তরাল’ও বেশ-বড় যেন পার্শ্ববর্তী একটি হলঘর। কিন্তু এর সার্বিক গঠন প্রণালী নিশ্চিতভাবে দ্রাবিড় রীতির দ্বারা প্রভাবিত এবং অনেকটাই পার্শ্ববর্তী বিরূপাক্ষ মন্দিরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
নীলকান্ত শাস্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে মন্দির নির্মাণে উত্তর ভারতীয় (নাগর) ও দক্ষিণ ভারতীয় (দ্রাবিড়) রীতির মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রথম সক্রিয় প্রয়াস লক্ষ করা যায় পাপনাথ মন্দিরের ক্ষেত্রে। অশোক কুমার ভট্টাচার্যও প্রায় অনুরূপভাবে মন্তব্য করেছেন যে, বাহ্যিক দিক থেকে বিচার করলে মনে হয় যে এই মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে নাগর ও দ্রাবিড় রীতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল।” পদকলের অন্যান্য মন্দিরগুলির মধ্যে কাশী বিশ্বেশ্বর ও গলগনাথের মন্দির দুটির গম্বুজ উত্তর ভারতীয় ধাঁচে তৈরি। এগুলির নির্মাণের তারিখ আনুমানিক খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক।
পশুসকলে পাপনাথ মন্দিরে প্রধান দুই ভারতীয় মন্দির স্থাপত্য রীতির যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, কর্ণাটকের রায়পুর জেলার তুঙ্গভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত আলমপুর গ্রামের বেশ কিছু মন্দিরে ঐ একই ধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আলমপুরের মন্দিরের সংখ্যা ছয়। পরিকল্পনা ও গঠনশৈলীর দিক থেকে এই ছয়টি মন্দির পদকলের পাপনাথ মন্দিরের সঙ্গে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আলমপুরের ছয়টি মন্দিরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল বিশ্ব ব্রহ্মার মন্দির, যা পাপনাথ মন্দিরের সঙ্গে অভিন্ন। এখানের মন্দিরগুলির সময়কাল পাপনাথ মন্দিরের মতোই খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শেষদিকে অথবা এর কিছুটা পরে হলেও হতে পারে। উল্লেখ্য, প্রধান প্রধান কেন্দ্র যথা আইহোল, পত্তদকল এবং কিছুটা হলেও বাদামিতে মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে যে আলোড়ন শুরু হয়েছিল, তার উন্মেষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল আলমপুরের মন্দিরগুলি।
এখন আসা যাক পন্ডদকলে দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় রীতির দ্বারা প্রভাবিত মন্দিরগুলির আলোচনায়। এই মন্দিরগুলি হল যথাক্রমে সঙ্গমেশ্বর, মল্লিকার্জুন, চন্দ্রশেখর এবং সর্বোপরি লোকেশ্বর (বিরূপাক্ষ মন্দির নামেই সবিশেষ পরিচিত)। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন যে চালুক্যদের শাসনাধীন এলাকায় মন্দিরে দ্রাবিড় নীতির প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস ছিল নিশ্চিতভাবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিরূপাক্ষ মন্দিরের অতি উন্নতমানের পরিকল্পনা ও নকশার পিছনে কাজীপুরমের কৈলাসনাথ মন্দিরের স্থপতিদের প্রেরণা ও প্রভাব কাজ করেছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বিরূপাক্ষ মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন চালুক্যরাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের প্রথমা মহিষী লোকমহাদেবী।
পতদকল ও কাঞ্চীপুরম—উভয় স্থানেরই শিলালৈখিক বর্ণনা থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে বিজেতা হিসাবে পল্লবদের রাজধানীতে প্রবেশ করার পর কৈলাসনাথ মন্দিরের স্থাপত্য শিল্পকলার প্রতি তিনি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে এরই পরিপ্রেক্ষিতে কাজীপুরমের মন্দিরের নির্মাতাদের তিনি নিজ সাম্রাজ্যে এনেছিলেন। এই কারণেই সম্ভবত তাঁর সময়ের লোকেশ্বর (বিরূপাক্ষ মন্দিরের সঙ্গে কাঞ্চীপুরমের কৈলাসনাথ মন্দিরের পরিকল্পনা ও ছকে বেশ মিল লক্ষ করা যায়। আয়তনের দিক থেকে এই মন্দিরটি বিশালাকার। বারান্দার সামনে থেকে মন্দিরের পিছন দিক পর্যন্ত এর আয়তন ১২০ ফুট লম্বা। এর দেওয়ালের বহিরঙ্গে প্লাস্টিক (ছাঁচ অনুযায়ী ভাস্কর্য সংস্কৃতি) কারুকার্য পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ও প্রখ্যাত পণ্ডিত পার্সি ব্রাউন মন্তব্য করেছেন যে, বিরূপাক্ষ মন্দিরের প্রকাশভঙ্গিমা বা বাহ্যিকতায় এক অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। একথা বলা আযৌক্তিক হবে না যে, মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে দ্রাবিড় রীতির বিবর্তনের চূড়ান্ত রূপ প্রতিফলিত হয়েছে বিরুপাক্ষ মন্দিরে।
এতক্ষণ চালুক্য আমলের স্থাপত্য সংক্রান্ত আলোচনা হল, এবার আসা যাক ভাস্কর্য সম্পর্কে।
ভাস্কর্য :
পশ্চিমী চালুক্যদের আমলে দক্ষিণাত্যে ভাস্কর্যের অগ্রগতি ঘটেছিল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে। ভাস্কর্যের প্রধান কেন্দ্রগুলি হল আইহোল, বাদামি ও পদকল, যেগুলির উল্লেখ ইতিপূর্বে মন্দির স্থাপত্য প্রসঙ্গে করা হয়েছে। আইহোলে স্থাপত্য ভাস্কর্যের বিবর্তন ধারাবাহিকভাবে লক্ষ করা যায় প্রথম পুলকেশী (৫৫০ ৫৬৭ খ্রিঃ), প্রথম কীর্তিকর্মণ (৫৬৭-৫৯৭ খ্রিঃ), মঙ্গলেশ (৫৯৭-৬০৯ খ্রিঃ) এবং দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালে (৬১০-৪২ খ্রিঃ) ও তার পরেও কিছুকাল ধরে।
মন্দির স্থাপত্যের ন্যায় ভাস্কর্য শিল্পকলার বিবর্তনের ক্ষেত্রে আইহোলে কতকগুলি স্তর পরিলক্ষিত হয়। প্রথম স্তর হিসাবে পূর্বে উল্লেখিত কোন্টিওড়ির মন্দিরগুলিতে রিলিফ বা উপরিতল থেকে অভিক্ষিপ্তভাবে নির্মিত ভাস্কর্যকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এখানের মন্দিরগুলির অভ্যন্তরে এবং সদরের বহির্ভাগে দৈব ও মহিমময় ব্যক্তিদের বেশ কিছু মূর্তি খোদিত অবস্থায় দেখা যায়। তবে দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ মূর্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এগুলির রচনাশৈলী সংক্রান্ত ধারণা সম্পর্কে খুব বেশি অবহিত হওয়া সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোন্টিগুড়ির মন্দিরগুলিতে বারান্দার ন্যায় মণ্ডপে সিলিং (ছাদের নীচের অংশ)-এর পাথরের বড় বড় তিনটি ফলকে বাম থেকে ডানদিকে যথাক্রমে ব্রহ্মা, উমা-মহেশ্বর ও বিষ্ণুর চিত্তাকর্ষক ভাস্কর্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আরো উল্লেখ করা যায় যে এই সমস্ত দেব-দেবীর প্রতিমা সংক্রান্ত ধারণা যথেষ্ট উন্নত।
দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরে যথাক্রমে আইহোলের লান খান, ছচিমল্লিগুড়ি ও হুচ্চপ্রয় মঠ এবং রবন-ফদির কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথম তিনটি মন্দিরে যথাক্রমে যমুনার মূর্তি, ময়ূরের ওপর উপস্থাপিত কার্তিকের মূর্তি এবং অনন্ত (সাপ)-র ওপরে উপবিষ্ট নারায়ণের মূর্তি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আবার রকন-ফাদিরে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় যেমন—দ্বারপাল, নৃত্যরত, হরিহর ও অর্ধনারীশ্বর রূপে শিবের মূর্তি খোদিত হয়েছে। রকন-ফদির মন্দিরের ভাস্কর্যের সঙ্গে পরব ভাস্কর্যের কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। এমন মনে করা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না যে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হবার পর আইহোলে পল্লব শাসনকালীন সময়ে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, আইহোলে বিভিন্ন স্তরে ভাস্কর্যের রচনাশৈলী সংক্রান্ত বিবর্তন ধারাবাহিকভাবে চলেছিল।
পশ্চিমী বা বাতাপির চালুক্যদের আমলে ভাস্কর্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হল বাদামি। প্রসঙ্গত বলা যায়, প্রথম পুলকেশীর আমলে চালুক্যদের রাজধানী আইহোল থেকে বাদামিতে স্থানান্তরিত হয় এবং ভাস্কর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বললে বলা যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। বাদামি গুহায় পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণের কয়েকটি নিদর্শন মিলেছে। এর মধ্যে তিনটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এগুলি হল গুহা নং ১, ২ ও ৩। ১নং গুহা মন্দিরটি হল সবচেয়ে পুরনো এবং এটি হল একটি শৈব মন্দির। এটির আনুমানিক সময়কাল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ।
২নং ও ৩নং গুহা মন্দির প্রায় ১নং-এর অনুরূপ। তবে এই দুটির সময়কাল কিছুটা পরের— খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে। এই ধারণার পিছনে প্রধান যুক্তি হল এই যে, ৩নং গুহামন্দিরের একটি স্তম্ভে চালুক্যরাজ মঙ্গলেশের একটি লেখ পাওয়া গেছে, যার তারিখ ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দ। বস্তুতপক্ষে বাদামির গুহাগুলিতে রিলিফ-এর যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলি চালুক্য আমলের ভাস্কর্যের মধ্যে সর্বোত্তম বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ রাখা যেতে পারে। ১নং গুহায় শিবকে বাহু তুলে নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়। গুহা নং ২-এ দ্বারপালকে চিত্তবিনোদনরত অবস্থায় দেখা যায়। এছাড়া ৩নং গুহায় ত্রিবিক্রম, হরিহর ও নরসিংহের মূর্তি উচ্চমানের ভাস্কর্যের ইঙ্গিত বহন করে।
চালুকা আমলের মন্দির স্থাপত্য-ভাস্কর্যের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হল মন ভা নদীর বাম তীরে এবং বাদামির অনতিদূরে অবস্থিত পত্তদকল। এরকম বলা হয়ে থাকে যে ভাষ্কর্যের ক্ষেত্রে বাদামির যথার্থ উত্তরসূরি ছিল পতাকল। এখানে দশটি মন্দির (আঃ খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতক)-এর কথা ইতিপূর্বে মন্দির স্থাপত্য প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মন্দিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা হল পাপনাথ, বিরূপাক্ষ (লোকেশ্বর) ও মল্লিকার্জুন (ত্রৈলোকেশ্বর)। নির্মাণ শৈলীর বিচারে পাপনাথ শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। এই মন্দির গাত্রে শিবকে পার্বতীর সঙ্গে নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়।
সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হল মহাভারত, রামায়ণ ও পুরাণের কিছু কাহিনী উৎকীর্ণ রয়েছে এই মন্দিরের দেওয়ালগুলিতে। পাপনাথ মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ ঐ সব কাহিনির ধারা কিছুটা পরবর্তীকালে (অষ্টম শতকের মধ্যভাগ) নির্মিত বিরূপাক্ষ ও মল্লিকার্জুন মন্দিরের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, পদকলের মন্দিরগুলির মধ্যে বিরুপাক্ষ মন্দিরের ভাষ্কর্য সর্বোত্তম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মন্দিরের ষোলোটি চতুষ্কোণ বিশিষ্ট স্তম্ভের নিম্নাংশে প্রণয়নশীল দম্পতির যে মূর্তি খোদিত রয়েছে, তা প্রায় জীবন্ত। এই বিষয়টি নিশ্চিতভাবে শিল্পীর সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার ইঙ্গিত দেয়। এরকম বলা হয়ে থাকে যে এর অল্পকাল পরে ইলোরা, ঔরঙ্গাবাদ ও এলিফ্যান্টায় (আঃ ৬৫০-১৮৫ খ্রিঃ) ভাস্কর্যের যে বিকাশ ঘটেছিল তার অগ্রদূত ছিল আইহোল, বাদামি ও পদেকলের ভাস্কর্য।
চিত্রকলা :
পশ্চিমী চালুক্য শাসকেরা স্থাপত্য-ভাস্কর্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তাই নয়, তাঁরা চিত্রশিল্পেরও অনুরাগী ছিলেন। অজন্তা ও বাদামির গুহায় এর কিছু নিদর্শন মেলে। প্রধানত বাকাটক এবং অংশত চালুক্য শাসকদের আমলে খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে অজন্তার অপূর্ব সুন্দর চিত্রগুলি আঁকা হয়েছিল। উল্লেখ্য, শুকনো জমির ওপর প্রথমে ছবিটি আঁকা হত। পাথরের গুঁড়ো, কাদা অথবা গোবরের সঙ্গে ভূষি অথবা গুড় মিশ্রিত করে দেওয়ালে লাগিয়ে দেওয়া হত। তারপর দেওয়ালটি চুনের জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হত।
দেওয়াল শুকনো হলে রং লাগানো হত এবং তারপর ছবির ওপরে বার্নিশ করা হত।১° সর্বাপেক্ষা প্রথম ব্রাহ্মণ্য চিত্রকলার পরিচয় মেলে বাদামির ৩নং গুহাচিত্রে। এটি চালুক্যরাজ মঙ্গলেশের আমলের এবং এর সময়কাল ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দ। কেননা, এই গুহায় মঙ্গলেশের ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালেখ উৎকীর্ণ আছে, যা ইতিপূর্বে উল্লেখও করা হয়েছে। এই ৩নং গুহাটি একটি বৈষ্ণব গুহা। চিত্রশিল্পীর আশ্চর্যজনক কর্মদক্ষতা এই চিত্রকলার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। গুহা চিত্রে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে নাচের রাজকীয় একটি দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে। উপস্থাপিত করা হয়েছে কোনো এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ও তাঁর সহকারীদের। এছাড়া, রাজপরিবারের সদস্যরা এই দৃশ্য দেখছেন, এমন চিত্র বর্ণিত হয়েছে। স্টেলা
ক্র্যামরিশ যথার্থই বলেছেন যে অজন্তার ২নং গুহা ছাড়া আর কোথাও বাদামির এই বৈষ্ণব (৩নং) গুহার ন্যায় ভাস্কর্য ও চিত্রকলার মধ্যে অন্তসংযোগ প্রতিফলিত হয়ে ওঠেনি। এছাড়া অজন্তা গুহার একটি চিত্রে পারসিক সম্রাট দ্বিতীয় খসরু কর্তৃক প্রেরিত পুত্রের পুলকেশীর দরবারে আগমনের দৃশ্য উপস্থাপিত হয়েছে।
উপসংহার :
ওপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে বাদামির চালুক্যদের শাসনকাল কেবল পল্লবদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘর্ষে ব্যয়িত হয়নি। প্রশাসনিক রীতি-নীতি, ধর্ম, স্থাপত্য-ভাষ্কর্য এবং কতকাংশে চিত্রকলার ক্ষেত্রেও চালুক্য শাসকরা ইতিবাচক অবদান রেখে গেছেন।