গুপ্তোত্তর যুগে দক্ষিণ ভারতীয় উপদ্বীপ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান ।
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিন্ধ্য পর্বতমালার দক্ষিণাংশ তথা দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক অবস্থা-ব্যবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারার বিবর্তন ঘটেছিল। বস্তুত, আলোচ্য সময়কালে তথা আদি মধ্যযুগে ভারতবর্ষের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (যেগুলি কেবল বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ঘটনাই ছিল না, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ) ঘটেছিল বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণাংশে, যাকে সাধারণভাবে দক্ষিণ ভারতীয় উপদ্বীপ অঞ্চল বলা হয়ে থাকে। আলোচ্য সময়ে এই অঞ্চলের একটি উল্লেখ্যযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হল বাতাপি (বাদামি)-র চালুক্য বংশ।
দক্ষিণ ভারতীয় উপদ্বীপ অঞ্চল তথা এর ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা গড়ে তোলা যায়। কেননা দক্ষিণের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশ-পরিস্থিতির যোগ নিবিড়। উল্লেখ্য, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে দক্ষিণের উপদ্বীপ অঞ্চল ভারত মহাসাগরের তীরে গিয়ে পৌঁছেছে এবং প্রায় মুখের মতো একটা সরু অংশ কন্যাকুমারীতে গিয়ে পড়েছে।
আরো উল্লেখ করে বলা যায় যে , উত্তর ভারত থেকে এই অঞ্চলটি যেন পুরোপুরি আলাদা। এর প্রধান কারণ বিন্ধ্য সাতপুরা পর্বতমালার উপস্থিতি। দক্ষিণের এই অঞ্চলটি যেন একটি ত্রিভুজের মতো। এই অঞ্চলেই দীর্ঘসমান্তরাল পর্বতশ্রেণী পূর্বঘাট পর্বতমালায় বিভক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, উড়িষ্যায় পূর্বঘাট পর্বতমালার শুরু এবং ক্রমশ তা অন্ধ্র উপকূলের সমান্তরালে অগ্রসর হয়ে শেষপর্যন্ত নীলগিরিতে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান নদীগুলি হল কাবেরী, গোদাবরী, কৃষ্ণা এবং কৃষ্ণার শাখানদী তুঙ্গভদ্রা।
পর্বতশিখর থেকে বের হয়ে নদীগুলি বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলেছে। দক্ষিণ ভারতীয় উপদ্বীপ অঞ্চলের মধ্যে দুটি এলাকা গুপ্তোত্তর যুগে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। একটি হল পশ্চিম দক্ষিণাত্যের উপকূল অঞ্চলের পর্বতবেষ্টিত বৃহৎ মালভূমি অঞ্চল। অপরটি হল তামিলনাড়ুর উর্বরা বিস্তীর্ণ সমতলভূমি।
বস্তুতপক্ষে, ভৌগোলিক তাৎপর্যের দিকে লক্ষ রেখে স্থানীয় সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল দক্ষিণের রাজ্যগুলি পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হত। একদিকে ছিল মালভূমি অঞ্চলের রাজ্য। অপরদিকে উপস্থিত ছিল উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলের রাজ্য। মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যজাত অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। বিশেষত কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদী এবং নদী বিধৌত এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা। বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের বেঙ্গী ছিল কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
স্বাভাবিকভাবেই ঐ অঞ্চলের ওপর অধিকার স্থাপনের প্রশ্নে দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে প্রায়শই বিরোধ বাধত। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই এলাকায় যেসব রাজ্য গড়ে উঠেছিল সেগুলি হল কাঞ্চীপুরমের পল্লব রাজবংশ, বাতাপি (বাদামি)-র চালুক্যবংশ এবং মাদুরাইয়ের পাণ্ড্যবংশ। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল বাতাপির চালুক্যবংশ।