StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পটভূমি কী ছিল

 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি বা প্রেক্ষাপট আলোচনা কর ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার পটভূমি বা প্রেক্ষাপট ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পটভূমি কী ছিল ? 


জেমস মিল ফিলিপ ফ্রান্সিসকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত সংগঠক বলে উল্লেখ করেছেন (Francis may with justice be decribed as the original promoter of the permanent settlement of Bengal)। আর. বি. র‍্যামসবোথাম মিলের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। তাঁর মতে, ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে কয়েকজন বণিক ও কোম্পানির কর্মচারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে মত প্রকাশ করেন।

১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে তাঁর পরিকল্পনা পেশ করেন। আলেকজান্ডার ডাও বাংলার ভূমি ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করার কথা বলেন। মার্কেন্টাইল মতবাদের অনুগামী ডাও মনে করেন রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত হলে কৃষির উন্নতি হবে, কৃষির সঙ্গে বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। ফিজিওক্র্যাট পাণ্ডুলো জমিকে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ধরে নিয়ে রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত চেয়েছিলেন। তিনি মনে, করেন এরফলে বাংলার কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগ বাড়বে, কৃষির সঙ্গে শিল্পের প্রসার ঘটবে। কোম্পানির প্রবীণ কর্মচারীদের মধ্যে পি. এম. ড্যাক্রিস, জি. জি. ডুকারেল ও টমাস ল ভূমি রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলেন।

কর্নওয়ালিশ টমাস ল-কে বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করেন। বিহারে কালেক্টর থাকাকালীন ল সেখানে কয়েকটি পরগনায় স্থায়ী মোকরারি বন্দোবস্ত করেছিলেন। একথা ঠিক ফ্রান্সিস ইংল্যান্ডে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে জোর প্রচার চালিয়েছিলেন। তাঁর প্রচারের ফলে এই বন্দোবস্তের পক্ষে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক মহলে অনুকূল মনোভাব গড়ে উঠেছিল। তার ভূমি রাজস্ব সম্পর্কিত প্রস্তাব রাষ্ট্রনেতাদের প্রভাবিত করেছিল। 

প্রধানমন্ত্রী পিট ও বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি হেনরি ডান্ডাস তাঁর “মিনিট’ দ্বারা প্রভাবিত হন, তবে  ফ্রান্সিসের সব প্রস্তাব কর্নওয়ালিশ পরিকল্পনায় স্থান  পায়নি। তাঁর দুটি প্রস্তাব — জমিদার জমির মালিক এবং তার সঙ্গে স্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়া উচিত, কর্নওয়ালিশ গ্রহণ করেন, আর সব প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়ে যায়। জেমস মিল লিখেছেন যে কর্নওয়ালিশের ‘অভিজাততান্ত্রিক সংস্কার’ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য দায়ী ছিল। হান্টার সাহেব জানিয়েছেন যে কর্নওয়ালিশ ভারতে পৌঁছনোর আগেই পিটের ভারত শাসন আইনে (১৭৮৪) ভূমি ও রাজস্বের ক্ষেত্রে স্থায়ী নিয়মরীতি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।

কোম্পানির ডিরেক্টর সভা ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিলের চিঠিতে ভূমিরাজস্ব স্থায়ীভাবে ধার্য করার নির্দেশ পাঠিয়ে ছিল। কর্নওয়ালিশ এসব সিদ্ধান্তকে কার্যকর করেন। ডিরেক্টর সভা তাদের চিঠিতে আরও জানিয়েছিল যে জমিতে জমিদারদের বংশানুক্রমিক অধিকার আছে। নরমপন্থায় সহনীয়ভাবে তারা রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলেছিল, জমিদারের নিরাপত্তা ও রায়তের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর দিতে বলা হয়। জমিদার বংশানুক্রমিকভাবে জমিদারি ভোগ করবেন, তাদের দেয় রাজস্বের পরিমাণ আর কখনও বাড়ানো হবে না ।

ডিরেক্টর সভার নির্দেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ১৭৮৬-৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিভিন্ন দিক নিয়ে কোম্পানির ওপরমহলে বিতর্ক চলেছিল। এই বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ, বোর্ড অব রেভেনুর সভাপতি জন শোর ও কোম্পানির প্রধান সেরিস্তাদার জেমস গ্রান্ট। এই বিতর্কের চারটি দিক ছিল — জমির মালিকানা, রাজস্বের ভিত্তি বছর ও পরিমাণ, বন্দোবস্তের মেয়াদ এবং কর সংগ্রাহক হিসেবে জমিদারদের উপযুক্ততা (Suitability of Zamindars as the agency of collection)। বাংলাদেশে জমির মালিক কে এই প্রশ্ন নিয়ে গ্রান্ট ও শোরের মধ্যে বিতর্ক চলেছিল।

শোরের মতে, জমিদার হলেন জমির মালিক, তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি ভোগ দখল করেন, দান, বিক্রি বা বন্ধক রাখার অধিকার তাদের আছে। গ্রান্ট শোরের মতের বিরোধিতা করে বলেন জমির মালিক হল রাষ্ট্র, জমিদার কর সংগ্রাহক মাত্র, এজন্য কমিশন পান। মালিকানা বিতর্কে কর্নওয়ালিশ শোরকে সমর্থন করেন। জমিদারকে মালিক বলে স্বীকৃতি দিলে প্রশাসনিক জটিলতা কমে যায়, শ্রেণিভিত্তিক সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। কর্নওয়ালিশ হুইগ রাষ্ট্রাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তি বছর এবং রাজস্বের পরিমাণ নিয়ে শোর ও গ্রান্টের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। গ্রান্ট ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের আসল জমার ভিত্তিতে দেওয়ানি জেলাগুলিতে এবং নতুন হস্তবুদের ভিত্তিতে ন্যস্ত জেলাগুলিতে (কলকাতা, চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর বর্ধমান ও ২৪ পরগনা) রাজস্ব ধার্য করার পরামর্শ দেন। শোর এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তাঁর যুক্তি হল মিরকাশিম ৭৪ লক্ষ টাকার বাড়তি রাজস্ব ধার্য করেছিলেন। মোগল আমলে আসল জমা ও আনারীকৃত রাজস্বের মধ্যে ফারাক থেকে যেত, নানা কারণে রাজস্ব মকুব করা হত। তিনি মনে করেন ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ভিত্তিতে রাজস্ব ধার্য হলে কৃষকদের ওপর অস্বাভাবিক চাপ পড়বে। তিনি ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের আদায়ীকৃত রাজস্বের ওপর ভিত্তি করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরামর্শ দেন।

কর্নওয়ালিশ শোরের মত গ্রহণ করে ১৭৮৮-৮৯ ও ১৭৮৯-৯০ খ্রিস্টাব্দের রাজস্বের ভিত্তিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন। বন্দোবস্তের মেয়াদ নিয়ে শোর ও কর্নওয়ালিশের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধী ছিলেন, শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এর বিরোধিতা করে যান। তিনি জমিদারদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত চেয়েছিলেন, কিন্তু স্থায়ী বন্দোবস্ত চাননি, শোরের যুক্তি হল ভবিষ্যতে লোকসংখ্যা ও চাষ বাড়লে সরকার বর্ধিত আয়ের ভাগ পাবে না। ভূমি ও রাজস্ব সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, জমিদারির সীমা, রায়তের অধিকার, নিষ্কর সম্পত্তি, গোচারণ ভূমি ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই। এরকম অবস্থায় স্থায়ী বন্দোবস্ত হলে নানারকম জটিলতার সম্ভাবনা রয়ে যায়। কর্নওয়ালিশ এক্ষেত্রে শোরের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। কর্নওয়ালিশ মনে করেন কোম্পানির হাতে যথেষ্ট তথ্য আছে, মন্বন্তরের পর কৃষির পুনরুজ্জীবনের জন্য স্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োজন, তা না হলে সামগ্রিকভাবে কোম্পানির ক্ষতি হবে।

ভূমি রাজস্বের সংগ্রাহক হিসেবে জমিদারদের উপযুক্ততা নিয়ে শোর ও কর্নওয়ালিশের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। নতুন ভূমি ব্যবস্থায় জমিদারদের ভূমিকা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্নওয়ালিশ মনে করেন জমির স্থায়ী স্বত্ব পেলে তারা কৃষির পুনর্গঠনে যত্নবান হবেন, বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটে যাবে। শোর জমিদারদের দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতেন। তিনি মনে করেন জমিদারি পরিচালনার জন্য যে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয় বাংলার জমিদারদের মধ্যে তার একান্ত অভাব রয়েছে। বাংলার জমিদারতন্ত্র সম্পর্কে শোরের অভিজ্ঞতা কর্নওয়ালিশের চেয়ে নিঃসন্দেহে বেশি ছিল।

কর্নওয়ালিশ মনে করেন এদেশের প্রচলিত কর ব্যবস্থার জন্য জমিদারদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতা তৈরি হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থা তাদের নাবালক করে রেখেছে, পরিশ্রম ও মিতব্যয়িতার ফলভোগ তারা করে না। জমিদারির প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করে কর্নওয়ালিশ তাদের যোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারের দায়িত্ব কমিয়ে দেন। তাঁর পরিকল্পনায় ছিল যে ব্যক্তি চাষবাস বাড়াবে, রায়তকে রক্ষা করবে, সময়মতো সরকারি রাজস্ব দেবে সেই হবে জমিদার। ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব, বিচারের অধিকার বা শুল্ক আদায়ের অধিকার জমিদারের থাকবে না। শোর মনে। করেন জমিদার মিতব্যয়ী হবেন না, সরকারি অর্থের অছিও হবেন না, কর্নওয়ালিশের ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। শোকের আপত্তি সত্ত্বেও কর্নওয়ালিশ জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন।

১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কর্নওয়ালিশ জেলার কালেক্টরদের রাজস্বের পরিমাণ জমিদার বা ইজারাদারদের নাম এবং রায়তের স্বার্থরক্ষামূলক কিছু সুপারিশ পাঠানোর নির্দেশ দেন। কালেক্টরদের পাঠানো তথ্য এবং বোর্ড অব রেভেনুর সুপারিশগুলি পরীক্ষা করে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি অস্থায়ীভাবে দশশালা বন্দোবস্ত চালু করেন। জমিদারদের তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, ডিরেক্টর সভার অনুমোদন পেলে তাদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করবেন (for a period of ten years with a view to permanency) | বাংলা ও বিহারের মোট ভূমি রাজস্ব ধার্য হল ২,৬৮,০০,৯৮৯ টাকা। এর দশ শতাংশ পাবে জমিদাররা, ৯০ শতাংশ সরকার। শোরের হিসেব অনুযায়ী উৎপাদনের ৪৫ শতাংশ পেয়েছিল রাষ্ট্র, ১৫ শতাংশ জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা আর বাকি ৪০ শতাংশ ছিল কৃষকের হাতে। জমিদারদের অন্তঃশুল্ক আদায়ের অধিকার বাতিল করা হয়।

পিট, ডান্ডাস ও ডিরেক্টর সভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। জমিদাররা পুরুষানুক্রমে জমির মালিক বলে স্বীকৃতি লাভ করেন, রাজস্ব স্থায়ীভাবে ধার্য করা হয়। কোনো কারণে রাজস্ব মকুব করা হবে না বলে জমিদারদের জানিয়ে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে জমিদারি নিলামে বিক্রি করে সরকারি প্রাপ্য আদায় করা হবে। প্রয়োজনবোধ করলে সরকার অধীনস্থ তালুকদার ও রায়তের স্বার্থরক্ষামূলক আইন তৈরি করতে পারবে। যেসব রায়ত দীর্ঘকাল ধরে স্থায়ীহারে রাজস্ব দিয়েছেন তাদের রাজস্ব বৃদ্ধি করা যাবে না, অন্যদের ক্ষেত্রে পরগনা হার অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য হবে। জমিদার কৃষকের অধিকার স্বীকার করে পাট্টা দেবেন, কৃষক জমিদারকে খাজনার প্রতিশ্রুতিসহ কবুলিয়ত দেবে, এতে কৃষকের নিরাপত্তা বাড়বে। জমিদার বিচারক, শাসক ও শুল্ক সংগ্রাহক হিসেবে কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। জমিদার ইচ্ছেমতো জমিদারি দান, বিক্রি বা বন্ধক দিতে পারবেন, সরকারি অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *