সতী বিতর্ক সম্পর্কে যা জান লেখ । টীকা লেখ সতী বিতর্ক ।
ভূমিকা :
প্রাচীনকাল থেকে ভারতে সতীপ্রথা ছিল, স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্বামীর চিতায় আরোহণ করে প্রাণ বিসর্জন দিতেন। এর নাম হল সহমরণ। তাছাড়া ছিল অনুমরণ প্রথা। লতামণি লিখেছেন যে ১৭৮০-১৮৩৩ এই পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতবর্ষে সতী নিয়ে বিতর্ক চলেছিল। এই বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল তিন পক্ষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার, উদীয়মান শিক্ষিত ভদ্রলোক ও ইউরোপীয় মিশনারিরা। আঠারো শতকের শেষদিকে কোম্পানি ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে ব্যস্ত ছিল, এদেশের সামাজিক প্রথা, আচার-আচরণ নিয়ে কোম্পানি হস্তক্ষেপ করার কথা ভাবেনি। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার জন আনস্ট্থার কলকাতার মধ্যে সতীপ্রথা নিষিদ্ধ করে দেন। কলকাতার বাইরে ভারতীয় মেয়েরা সতী হতেন। মার্শম্যান লিখেছেন যে কলকাতায় সতী হতে ইচ্ছুক মহিলারা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গিয়ে সতী হত।
সতী বিতর্ক :
কলকাতার আশপাশের অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে সতী হবার ঘটনা ঘটত। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ও মাহিষ্যদের মধ্যে সতীর ঘটনা ছিল বেশি। শ্রীরামপুরের মিশনারিরা এই সতী হবার ঘটনাগুলিকে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। ওয়ার্ড লিখেছেন যে বছরে গড়ে ৩০০-৪০০ মেয়ে সতী হত, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও সতীর ঘটনা ঘটত কিন্তু সংখ্যাটা ছিল কম। ১৭৮৯-১৮২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সরকার সতী সম্পর্কে চারটি নির্দেশ জারি করেছিল। নিজামত আদালতের পণ্ডিত ঘনশ্যাম শর্মা প্রথম ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে সতী সম্পর্কে তাঁর মতামত দেন। এর ওপর ভিত্তি করে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সতী সম্পর্কিত নির্দেশ জারি করেছিল। কোম্পানি সতীকে শাস্ত্রসম্মত আচার বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। সতী হবে স্বেচ্ছায়, বয়স হবে ১৬ বছরের বেশি। গর্ভবতী সতী হতে পারবেন না, শিশুপুত্রের মাতা সতী হতে পারবেন না। সতী হতে হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন নিতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি বিস্তারিত তথ্যসহ সরকারকে জানাবেন। মাদক দ্রব্য সেবন করিয়ে কাউকে সতী করা যাবে না।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সতী সম্পর্কিত নির্দেশাবলিকে ভিত্তি করে সরকারি নীতি রচিত হয়। এই নীতি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতী উচ্ছেদ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে নিজামত আদালত আরও জানিয়েছিল তিন বছরের কম বয়স্ক শিশু থাকলে তার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করে তবেই সতী হওয়া যাবে। ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে সহমরণ, অন্যজাতির লোকদের ক্ষেত্রে অনুমরণ হতে পারে, ম্যাজিস্ট্রেট সদর নিজামত আদালতকে সতী সম্পর্কে সব তথ্য জানাবেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার যে ব্যবস্থা দেন তাতে বলা হয়েছিল সতী সম্পর্কে শাস্ত্রীয় সমর্থন যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। সতী সম্পর্কে আরও কয়েকটি সরকারি বিধিনিষেধ জারি করা হয়, ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সতীর সংখ্যা আকস্মিকভাবে বেড়ে যেতে থাকে। সতী নিয়ে সরকারি
মহলে যে বিতর্ক উঠেছিল তার কেন্দ্রস্থিত বিষয় হল সতী বাঞ্ছনীয় কিনা এবং এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ হলে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির ডিরেক্টর সভা জানিয়েছিল যে সতীপ্রণার উচ্ছেদ সমর্থনযোগ্য। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ম্যাজিস্ট্রেটরাও জানিয়েছিল যে সতীপ্রথার উচ্ছেদ হলে বড়ো ধরনের অশান্তির সম্ভাবনা নেই। নৈতিকতা ও যুক্তির বিচারে অমানবিক এ প্রথাকে সমর্থন করা যায় না। ইংল্যান্ডের জনমত সতীপ্রথার উচ্ছেদের পক্ষে ছিল। উপযোগবাদী দর্শনের অনুগামী গভর্নর-জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক সৈন্যবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর সতীপ্রথা নিষিদ্ধ করে ঘোষণা জারি করেন।
১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলকাতার শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মধ্যে সতী নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। রামমোহনের আত্মীয়সভা সতীপ্রণার বিরোধী ছিল কারণ এই প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। সতী নিয়ে রামমোহন যে পুস্তিকা লিখেছিলেন তাতে তিনি দেখিয়েছিলেন যে সতীপ্রথা মনুস্মৃতি ও বেদে উল্লিখিত হলেও বিধবার শুদ্ধ জীবনই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। রক্ষণশীলদের সংস্থা ধর্মসভা এবং তাদের পত্রিকা সমাচারচন্দ্রিকা সতীর ওপর স্থাপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে দেবার দাবি জানিয়েছিল। এদের বক্তব্য হল সতীপ্রথা হিন্দু শাস্ত্রসম্মত পালনীয় বিধি, সরকার ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মিশনারিদের পত্রিকা সমাচার দর্পণ এবং রামমোহনের পত্রিকা সম্বাদকৌমুদী ধর্মসভার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছিল। রামমোহন অন্যান্য স্মৃতিকারদেরা উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছিলেন সতী আদৌ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়, অনেকক্ষেত্রে আত্মহত্যা অথবা হত্যার ঘটনা। রামমোহন লিখছেন : ‘কোনো সতী স্বেচ্ছায় কখনও চিতায় আরোহণ করেননি’ (No widow ever voluntarily ascended on and entered into the flames)। তিনি সতীকে ধর্মের নামে এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড বলে ঘোষণা করেন।
ধর্মসভার সদস্যরা ধর্মত্যাগী রামমোহনের যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁদের মতে, একমাত্র পণ্ডিত ব্রাহ্মণেরা শাস্ত্রের যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে পারেন। শাস্ত্রে আচার-আচরণকে (usage) যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। রামমোহন রক্ষণশীলদের যুক্তিকে নস্যাৎ করে দিয়ে ঈশ্বরচিন্তার ওপর বেশি জোর দেন। কাশীনাথ তর্কবাগীশের মতো রক্ষণশীলরা মনে করেন সতীপ্রথার উচ্ছেদ হলে সমাজে অনাচার বাড়বে। সতীপ্রথা মন্দের ভালো (lesser of the two evils)।
রামমোহন তাঁর সতী সম্পর্কিত দ্বিতীয় পুস্তিকায় বেদ, স্মৃতি, পুরাণ ও ইতিহাস থেকে অজস্র উদ্ধৃতি দিয়ে সতী সমর্থকদের যুক্তিতর্ককে খণ্ডন করেন। মনু, যাজ্ঞবস্থা, বশিষ্ঠ ও অন্যান্যরা বিধবাদের শুদ্ধ সন্ন্যাসিনীর জীবনযাপন করতে বলেছেন। মহিলাদের দুর্বল সামাজিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করে রামমোহন রক্ষণশীলদের অবস্থানকে আক্রমণ করেছিলো। রক্ষণশীলদের আবেদনের বিরুদ্ধে রামমোহন পক্ষীয়রা ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে যে আবেদন পেশ করেছিল তাতে এর আইনি দিকটি তুলে ধরা হয়। বাংলার দায়ভাগ আইনের জন্য মহিলারা বঞ্চিত হয়েছে। এদের বক্তব্য হল যেটুকু সম্পত্তির অধিকার তাদের দেওয়া হয়েছে তা থেকে বঞ্চিত করার জন্য আত্মীয়রা সতীপ্রথায় উৎসাহ দিয়ে থাকে।
সতী বিতর্কে তৃতীয় পক্ষটি ছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা। উনিশ শতকের গোড়া থেকে ইউরোপে মিশনারি কাজকর্ম বৃদ্ধি পেয়েছিল, তারা ভারতে ধর্ম প্রচারের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। কেরির নেতৃত্বে শ্রীরামপুরে একটি মিশন স্থাপিত হয় (১৮০০)। কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড এদেশের ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন। এদেশের ভাষায় যেমন বাইবেল অনূদিত হয় তেমনি এদেশের ধর্ম ও সামাজিক আচার-আচরণ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছিল।
মিশনারিদের লক্ষ্য ছিল এদেশের অধঃপতিত অবস্থার কথা তুলে ধরে ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এদেশের মানুষকে বোঝানো হয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতে খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও মিশনারিদের কাজকর্ম অধঃপতিত জাতির মুক্তির জন্য একান্ত প্রয়োজন। ইংল্যান্ডে প্রকাশিত মিশনারি রেজিস্টারে ভারতের কুসংস্কার ও নরবলি প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা করা হত। ওয়ার্ড হিন্দুস (Hindoos) নামে যে গ্রন্থখানি লেখেন তাতে সতীপ্রথা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ছিল। শ্রীরামপুরের মিশনারিরা সতী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। এ প্রথা যে অশাস্ত্রীয় তাও দেখিয়েছিলেন। সতীপ্রথার বিরুদ্ধে তারা ইংল্যান্ডে জনমত গঠনের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। ক্লড বুকানন ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে সতী বিষয়ে একখানি পুস্তিকা মিশনারিদের নেতা উইলবারফোর্সকে দেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার বিতর্কের সময় তিনি তা ব্যবহার করেছিলেন।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর ভারতে মিশনারিদের কাজকর্মের অধিকার দেওয়া হয়। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে জোন্স ইংল্যান্ডে সতীবিষয়ক একখানি পুস্তিকা ছাপিয়ে এর বীভৎসতা তুলে ধরেন। শ্রীরামপুরের মিশনারিদের পত্রিকা সমাচার দর্পণ এবং ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়ায় সতীপ্রথাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করা হয়। ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়ায় সতী বিরোধী লেখা পড়ে সরকার পক্ষের কেউ কেউ বিচলিত বোধ করেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ভ্রমণকালে উইলিয়াম ওয়ার্ড বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অবিলম্বে এ প্রথা বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিতে বলেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং সৈন্যবাহিনীর মতামত নিয়ে সতীপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কলকাতায় ধর্মসভা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলের কাছে আপিল করেছিল, প্রিভি কাউন্সিল ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে এই আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল। রামমোহন তখন ইংল্যান্ডে ছিলেন, তিনি প্রিভি কাউন্সিলের কাছে এই আইনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
দীর্ঘ সতী বিতর্কের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিকটি হল বিধবা মহিলাদের ভূমিকা ছিল গৌণ। তাদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ ও নৈতিকতার আলোকে মহিলাদের সামাজিক অবস্থানের বিচার হয়নি। সরকার হিন্দু আইনের সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করেছিল। সতীপ্রথা তুলে দিলে সরকারের কোনো অসুবিধা হতে পারে কিনা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিল। সরকার জেনেছিল এই প্রথা শাস্ত্র অনুমোদিত নয়, তবুও হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করেছিল। শিক্ষিত ভদ্রলোকদের বিতর্কে শাস্ত্র, পরকাল ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছিল। হিন্দুধর্মে আচারের ভূমিকা নিয়ে তারা চুলচেরা বিশ্লেষণে মেতে উঠেছিল। নারী জাতির সামাজিক অবস্থান, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর ওপর উৎপীড়ন ও শোষণ এদের আলোচনায় প্রাধান্য পায়নি। মিশনারিরা বিধবাদের দুঃখে কাতর হয়েছেন, এই বীভৎস প্রথার নানাদিক তাঁরা তুলে ধরেছেন, দেখিয়েছেন নারীকে হিন্দু সমাজ মর্যাদা দেয় না। মহিলাদের অবস্থান মনুষ্যেতর প্রাণীর মতো।
মূল্যায়ন :
নারীর প্রতি সামাজিক অবিচার তুলে ধরে এদেশে খ্রিস্টানধর্ম প্রচারের যৌক্তিকতা তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তিন পক্ষের কোনো পক্ষই নারীর প্রতি হিংসাকে, তাদের অধঃপতিত সামাজিক অবস্থানকে কেন্দ্রীয় বক্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করেননি। সতী বিরোধী ও সমর্থক উভয় গোষ্ঠীর লেখায় দ্বিধাগ্রস্ততা লক্ষ করা যায়। সরকারি ও মিশনারিদের লেখায় পাওয়া যায় সতীপ্রথার আদর্শের প্রতিফলন, স্বামী-স্ত্রীর স্বর্গীয় প্রেমের নিদর্শন, দেশীয় সাহিত্যে এর উল্লেখ নেই। দুর্ভাগা বিধবার ব্যক্তিত্ব, অধিকার, স্বাধীনতা ইত্যাদি এই বিতর্কে খুঁজে পাওয়া যায় না। সতী বিতর্কে কেন্দ্রস্থিত চরিত্র হল বিধবা। তার সামাজিক অবস্থানের বিচার-বিশ্লেষণ না করে সতীপ্রণা তুলে দেবার ভালোমন্দ দিক নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক চলেছিল। সতী বিতর্কের এটি হল দুর্বলতম দিক।