পাকিস্তান আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো । পাকিস্তান আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা কর। পাকিস্তান আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করুন ।
ভূমিকা :
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর মুসলমান সমাজ দীর্ঘকাল পশ্চিমি শিক্ষা, চিন্তাধারা ও বিজ্ঞানকে পরিহার করে চলেছিল। একারণে ভারতীয় মুসলমান সমাজ হিন্দু সমাজ অপেক্ষা অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছিল। শিক্ষা, আধুনিকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরি ও পেশাদারি বৃত্তিতে মুসলমানরা অনগ্রসর রয়ে যায়। ভারতের এই দুই প্রধান সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্যের সুযোগ নিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী বিভাজন ও শাসনের নীতি অনুসরণ করতে থাকে। মুসলমান সমাজে আধুনিক শিক্ষার প্রবর্তক ও মহান
পাকিস্তান আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ :
সমাজ সংস্কারক স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মুসলমানদের জাতীয় জীবনধারার সঙ্গে মিলিত হতে দেননি। শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়কে তিনি জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি হলেন আধুনিক ভারতে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রনীতির স্রষ্টা। তিনি মনে করেন হিন্দু ও মুসলমানের রাজনৈতিক স্বার্থ ভিন্ন, অনগ্রসর মুসলমান সম্প্রদায়কে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত থেকে অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করতে হবে। সৈয়দ আহমেদ খানের মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা আলিগড় সম্প্রদায় গঠন করে স্বতন্ত্র মুসলিম রাজনীতির ধারাটি অব্যাহত রেখেছিলেন। লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিলে মুসলমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তা সমর্থন করেছিল। স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের সময় ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ্র নেতৃত্ব এর বিরোধিতা করা হয়। পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জেলায় দুর্ভাগ্যজনক সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল, মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বঙ্গভঙ্গের অব্যবহিত পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতে শাসন সংস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মুসলমান সমাজের নেতারা ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আগা খানের নেতৃত্বে গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টোর সঙ্গে দেখা করে সিমলা বৈঠকে দুটি দাবি রেখেছিলেন। প্রথমটি হল পৃথক নির্বাচন, আর দ্বিতীয়টি হল জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাতের চেয়ে বেশি সংখ্যায় আসন সংরক্ষণ। মুসলমানদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং সাম্রাজ্য রক্ষায় তাদের অবদানের কথা মনে রেখে এই ওয়েটেজের (Weightage) বা বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়েছিল। মিন্টো মুসলমানদের দাবিগুলি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। ব্রিটিশ সরকার জাতীয় আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় মহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের অধিবেশন বসেছিল। বঙ্গ বিভাগ, স্বদেশি আন্দোলন এবং শাসন সংস্কারের সম্ভাবনা মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। মুসলমান নেতারা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়। জন্মলগ্নে লিগ তিনটি লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছিল : (১) ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমান সমাজের আনুগত্য বৃদ্ধি করা, (২) ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার রক্ষা করা এবং তার সম্প্রসারণ ঘটানো এবং (৩) অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি যাতে বিদ্বেষ তৈরি না। হয় সেদিকে লক্ষ রাখা।
লিগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত ছিল। এই সময়কালে কংগ্রেসের বিরোধিতা করা এবং সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে মুসলমানদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করা ছিল এর নীতি। ইংল্যান্ডে জনমত গঠনের জন্য সেখানে লিগের একটি শাখা স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল, এতে মুসলমান সমাজ অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়। তাছাড়া তুরস্কের বিরুদ্ধে বলকান যুদ্ধ (১৯১২) শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজ ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিরক্ত হয়েছিল। এসময় থেকে ভারতীয় মুসলমানরা ইসলামের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বে আস্থা স্থাপন করেছিল (Pan-Islamism)। বিশ্বজনীনতাকে সংখ্যালঘু মুসলমানরা তাদের অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে গণ্য করেছিল।
মুসলিম লিগের মধ্যে ইয়ং পার্টি নামে একটি উপদলের উদ্ভব হয়, এরা মুসলিম লিগকে ধীরে ধীরে ব্রিটিশ বিরোধী করে তুলেছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে এই গোষ্ঠীর সহযোগিতা করার ইচ্ছা ছিল। এই তরুণ গোষ্ঠীর চাপে মুসলিম লিগ শান্তিপূর্ণভাবে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন তার রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে মুসলিম লিগের ব্রিটিশবিরোধিতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা এবং খলিফার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে এক যোগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে রাজি হয়েছিল। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে লখনউতে মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে যৌথভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ১৯২০-২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কংগ্রেস ও খিলাফৎ নেতারা যৌথভাবে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতা দখল করে খলিফার পদটি তুলে দিলে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। এরপর উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আবার অনৈক্য ও বিভেদের সৃষ্টি হয়, কয়েকটি স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ভারতে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের সম্ভাবনা পর্যালোচনা করার জন্য সাইমন কমিশন গঠন করেছিল। হিন্দু ও মুসলমান নেতারা এই কমিশন বর্জন করেছিল, সারাদেশে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। এই কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য ছিল না। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল নেহরু কমিটি ভারতের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা করলে মুসলিম লিগ তাতে আপত্তি জানিয়েছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে সর্বদলীয় মুসলিম সম্মেলনে মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ তাঁর বিখ্যাত ‘চোদ্দ দফা দাবি পেশ করেন। এই চোদ্দ দফা দাবির মধ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, পৃথক নির্বাচন, পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মুসলমান সমাজের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা। জিন্নাহ্ মুসলমান সমাজের স্বাতন্ত্র্যরক্ষার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। এসময় থেকে হিন্দু ও মুসলমান নেতারা পরস্পরের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকেন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের এলাহাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে কবি ও দার্শনিক মহম্মদ ইকবাল মুসলমান সমাজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ওপর জোর দেন। তিনি মন্তব্য করেন যে ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক নয়, একই সত্তার দুই দিক, ধর্মের বাইরে ইসলামের কোনো পৃথক সত্তা নেই। ভারতে মুসলমানদের পৃথক সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে হলে তাদের জন্য পৃথক আবাস বা হোমল্যান্ড গঠন করা দরকার। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তিনি মুসলমানদের জন্য নিজস্ব আবাস বা হোমল্যান্ড গঠনের পরামর্শ দেন। ইকবাল মুসলমানদের জন্য হোমল্যান্ডের কথা বললেও তিনি কখনও স্বাধীন হোমল্যান্ডের কথা বলেননি।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ঘোষণা করলে কংগ্রেস তার বিরোধিতা করেছিল কিন্তু মুসলিম লিগ তা গ্রহণ করে। আধুনিক পাকিস্তান আন্দোলনের স্রষ্টা হলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত পাঞ্জাবি মুসলমান ছাত্ররা, এদের নেতা ছিলেন চৌধুরি রহমত আলি। লন্ডনে গোলটেবিলে বৈঠক চলার সময় রহমত আলি মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র স্বাধীন বাসভূমি গঠনের প্রস্তাব দেন। পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর, বালুচিস্তান ও সিন্ধুপ্রদেশ নিয়ে তিনি পাকিস্তান গঠন করতে বলেন। পরে তিনি হায়দ্রাবাদ ও বাংলায় আরো দুটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। তিনি ইকবাল প্রস্তাবিত হোমল্যান্ড ও স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে দেন। ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে মুসলিম লিগের নেতারা স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে আগ্রহী ছিলেন না। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থেকে মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুযোগসুবিধা আদায়ের দিকে তাঁরা নজর দিয়েছিলেন।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতশাসন আইন গৃহীত হলে মুসলিম লিগ তার নিন্দা করেছিল কারণ এতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অনেক ক্ষমতা রাখা হয়েছিল। এই সময় থেকে মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার করতে থাকেন। তাঁর মতে, ধর্ম, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি কোনো দিক দিয়েই হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মিল দেখা যায় না। সুতরাং এরা দুটি পৃথক জাতি। কংগ্রেস একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান এবং হিন্দুদের স্বার্থরক্ষা করে থাকে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের পর তিনি দাবি করেছিলেন যে কংগ্রেস নিজেকে হিন্দু প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করবে, আর মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লিগকে মেনে নেবে। নির্বাচনের আগে জিন্নাহ্ দাবি করেন ভারতীয় মুসলমানদের বিশেষ অধিকার রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজন হলে মুসলিম লিগ ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থরক্ষা করবে। আসন্ন নির্বাচনকে মনে রেখে জিন্নাহ তাঁর সাম্প্রদায়িক প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের পর কংগ্রেস আটটি প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল। ঐ সময় থেকে লিগের কংগ্রেস বিরোধিতা আরও বেড়ে যায়। লিগ কংগ্রেসি মন্ত্রীসভাগুলির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে ব্যর্থতা, ঈদের সময় গোহত্যা বন্ধ, হিন্দুঘেঁষা বন্দেমাতরম্ সংগীত প্রচার এবং উর্দুর ক্ষতি করে হিন্দি প্রচার ইত্যাদি অভিযোগ এনেছিল। বলা বাহুল্য এর বেশিরভাগ ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভিত্তিহীন অভিযোগ। এসময়ে লিগের কোনো সর্বভারতীয় কর্মসূচি ছিল না, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন পরিচালনা না করে লিগ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচারকার্যে নেমে পড়েছিল।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি পদত্যাগ করলে লিগ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দান ও মুক্তি দিবস’ পালন করেছিল। গান্ধিজি ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করলে মুসলিম লিগ আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকার নীতি অনুসরণ করেছিল। একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় ভারতে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদের উত্তরোত্তর উন্নতি ও প্রসারের জন্য হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রদায়িক দলগুলি অনেকখানি দায়ী ছিল। হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রভৃতি হিন্দুত্ববাদী দলগুলি প্রচার করত ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ, মুসলমানরা বিদেশি ও সংখ্যালঘু। এসব প্রচারের ফলে শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে এক আত্মপরিচয়ের সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অখণ্ড ভারত ও হিন্দু রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা লিগের বিচ্ছিন্নতাবাদকে পুষ্ট করেছিল। সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সম্পর্কে অবিশ্বাস ও সন্দেহের মনোভাব থাকে।
জাতীয় কংগ্রেস সংখ্যালঘুদের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার আশ্বাস দিলেও সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কার্যকলাপের জন্য মুসলমান সমাজে তা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মুসলমান মৌলবি ও মোল্লারা মুসলমানদের কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলেছিল। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধিতা করে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটি ছিল না, কিন্তু সভার মধ্যে পাকিস্তান স্লোগান উঠেছিল। এই লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব শেষঅবধি ভারত বিভাজনের দাবিতে পরিণতি লাভ করে।
গান্ধিজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মুসলিম লিগ দাবি তুলেছিল ভারত ভাগ করো, ভারত ছাড়ো’। এই সময় কংগ্রেসের সব প্রথম সারির নেতা বন্দি হলে মুসলিম লিগ বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে লিগের শক্তি বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত তিরিশটি আসনের সব কটি লিগ দখল করেছিল। প্রদেশগুলিতে ৫০৯টি আসনের মধ্যে ৪৪২টি আসনে লিগ জয়ী হয়। সাধারণ নির্বাচনের এই ফলাফলে লিগের সর্বভারতীয় চরিত্র এবং মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছিল কংগ্রেস ও লিগ প্রথমে তা গ্রহণ করলেও পরে ভুল বোঝাবুঝির জন্য তা বাতিল হয়ে যায়। লিগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করলেও সংবিধান সভা বয়কট করে চলেছিল। পাকিস্তান দাবি আদায়ের জন্য লিগ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের (direct action) ডাক দিয়েছিল। সারা দেশে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করা হয়, ঐদিন কলকাতায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছিল। পরে এই হাঙ্গামা বিহার, দিল্লি, বোম্বে, নোয়াখালি, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বহুলোক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় আহত ও নিহত হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ পরিচালিত অন্তবর্তী সরকারের মধ্যে প্রবল বিরোধ দেখা দিয়েছিল, দেশের উন্নয়নমূলক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশ বিভাগের সিদ্ধান্ত নেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিল এবং তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স আইনটি পাশ করেছিল। ঐ আইন অনুযায়ী ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করেছিল।
সাম্প্রতিককালে অনিতা ইন্দার সিং, ডেভিড পেজ, মুশিরুল হাসান, আয়েযা জালাল প্রমুখ গবেষকরা ভারত বিভাজনের পটভূমি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আয়েষা জালাল বলেছেন জিন্নাহ্ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভারত বিভাজনের কথা ভাবেননি। তিনি ভারত বিভাজন চাননি, পাকিস্তান দাবিকে কূটনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করে তিনি মুসলমানদের জন্য আরও সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিলেন। তিনি সৈন্যবাহিনী, আমলাতন্ত্র, কোষাগার কোনো কিছুই ভাগ করতে চাননি। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী ও অন্যান্যরা এই মতের বিরোধিতা করে লিখেছেন। ভারত বিভাজনের অনিবার্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সাধারণভাবে বলা যায় সারা দেশে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিকায় কংগ্রেস নেতারা ভারত বিভাজনকে অনিবার্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে তারা অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে পাননি। অধ্যাপক বিপান চন্দ্র এই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ভারত বিভাজনের কট্টর বিরোধী গান্ধিজি শেষঅবধি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চরম বেদনার সঙ্গে তা মেনে নিয়েছিলেন। ভারত বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত তিন পক্ষ ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ বিভাজন চেয়েছিল। এই উপমহাদেশে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিভাজন চেয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যন্ত ইংল্যান্ড সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ইংল্যান্ডের সৈন্যবাহিনী ও জনমত সাম্রাজ্যের বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। গান্ধিজি ও আবুল কালাম আজাদ ছাড়া আর কোনো কংগ্রেস নেতা বিভাজনের বিকল্প খুঁজে পাননি। শ্রান্ত, অবসন্ন কংগ্রেস নেতারা আর লড়াই করতে চাননি বলে বিভাজন মেনে নিয়েছিলেন, এই মিথটিও ভিত্তিহীন। আজাদ হিন্দ বন্দিদের বিচারকে কেন্দ্র করে অল্পকালের জন্য হিন্দু-মুসলিম বিরোধিতা কমেছিল, সারাদেশে বিক্ষোভ ও হরতাল পালিত হয়। কলকাতায় রশিদ আলি দিবসে জনতা ও পুলিশে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেই স্বল্পকালস্থায়ী হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভারত বিভাজন এড়াতে পারেনি। নৌবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাও স্থায়ী হয়নি। মুসলিম লিগের ধনী অভিজাত ও জমিদার নেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ পেতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও ভারত বিভাজনের অর্থনৈতিক কারণ ছিল।
ভারতের অগ্রসর হিন্দুরা ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরি ও পেশাদারি বৃত্তিতে মুসলমান বণিক ও শিক্ষিত শ্রেণির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। তারা আশা করেছিল স্বাধীন মুসলমান রাষ্ট্র মুসলিম বণিক ও পেশাদারি মানুষদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বাঁচাতে পারবে। পাঞ্জাব ও বাংলায় মুসলমান কৃষক হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে এমন আশার কথা শোনানো হয়েছিল।
মূল্যায়ন :
মুসলিম লিগের নেতারা এই অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বের দিকটি প্রচার করতে ভুল করেননি। বলা যায় ভারত বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত তিনপক্ষই বিভাজন চেয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কংগ্রেস নেতাদের দুর্বলতা, লিগ নেতাদের ক্ষমতালিপ্সা, মুসলমান সমাজের বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনা এবং ব্রিটিশ স্বার্থ ভারত বিভাগ অনিবার্য করে তুলেছিল। সুমিত সরকার ও অন্যান্য বামপন্থী লেখকরা মনে করেন কৃষক ও শ্রমিকের দীর্ঘ অর্থনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করে শুধু ভারত বিভাজন এড়ানো যেত। অর্থনৈতিক কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন শুধু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন এড়ানোর একমাত্র পথ ছিল।