১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের পটভূমি বা প্রেক্ষাপট আলোচনা কর ।
ভূমিকা :
ব্রিটিশ শাসনকালে সাম্প্রদায়িকতা, বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলমানের সম্পর্ক, ভারতের সাংবিধানিক ক্রমবিকাশের ধারাকে বিশেষভাবে ব্যাহত করেছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ভারত সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য পরিকল্পিতভাবে ‘বিভাজন ও শাসনের নীতি’ (divide and rule) অনুসরণ করতে থাকে। বিদ্রোহের পর সৈন্যবাহিনীর পুনর্গঠনে এই নীতির প্রতিফলন ঘটেছিল। উইলিয়াম হান্টার তাঁর ইন্ডিয়ান মুসলমানস গ্রন্থে মুসলিমদের প্রতি ব্রিটিশ শাসননীতির পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। মুসলমানদের সুযোগসুবিধা দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করার প্রয়াস শুরু হয়। ১৮৫৮ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের এই দ্বিধাগ্রস্ত মুসলিম তোষণ নীতি চলেছিল। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী পুরোপুরি মুসলিমদের জাতীয় কংগ্রেসের ‘প্রতিষেধক শক্তি’ (counterpoise) হিসেবে খাড়া করার চেষ্টা চালিয়েছিল।
স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের পটভূমি / প্রেক্ষাপট
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বে পরিচালিত আলিগড় আন্দোলন কংগ্রেস বিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল। সৈয়দ আহম্মদ মুসলিমদের কংগ্রেস আন্দোলন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। মুসলমানদের জন্য তিনি ‘মহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’ (১৮৮৬) ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান পেট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮৮৮) এবং ‘মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮৯৩) গঠন করেন। স্যার সৈয়দের চিন্তাভাবনা ভারতীয় রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসে। তিনি প্রচার করেছিলেন ভারতে ঐক্যবদ্ধ একজাতি নেই, আছে দুই জাতি। প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান বা নির্বাচন ভারতের পক্ষে সুবিধাজনক নয় কারণ এতে অগ্রসর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর আধিপত্য করবে। রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় মুসলিম স্বার্থরক্ষার জন্য মুসলমানদের ইংরেজদের ওপর নির্ভর করতে হবে। মুসলমানদের উচিত ব্রিটিশ শাসন সুরক্ষিত করার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করা। সৈয়দ আহমদ খান দুই জাতিতত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। আলিগড় কলেজের প্রিন্সিপাল থিয়োডর বেক এই বিচ্ছিন্নতাবাদকে পুষ্ট করেন।
সৈয়দ আহমদ ও বেক যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির অনুকূল পরিবেশ গঠন করছেন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাতে মদত দিয়ে যান। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতসচিব লর্ড ক্রস বড়োলাট ডাফরিনকে লিখছেন : “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য ইংরেজদের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক (This division of religious feeling is to our advantage)। কুপল্যান্ড (Coupland) জানিয়েছেন যে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে এবং সরকার কংগ্রেসকে আনুকূল্য দেখাতে শুরু করলে মুসলিমদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই প্রতিক্রিয়া থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্ম। এই দ্বিজাতি তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করার জন্য আলিগড় আন্দোলনের সৃষ্টি। আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উর্বরক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। এই উর্বরক্ষেত্রে বীজ বপন করেন আলিগড় কলেজের তিন ব্রিটিশ অধ্যক্ষ বেক, মরিসন ও আর্চবোল্ড। বেক মুসলিমদের বুঝিয়েছিলেন যে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান মুসলিম স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে। তাঁরই উদ্যোগে মুসলমান স্বার্থ রক্ষার জন্য ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান পেট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়।
আলিগড় আন্দোলন এবং আলিগড় সম্প্রদায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। উনিশ শতকের শেষদিকে দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ ও ক্রমবর্ধমান ব্যবধান ভারতসচিব হ্যামিলটনকে খুশি করেছিল। ভারতীয় মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে শুধু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী পুষ্ট করেননি, প্যান-ইসলামপন্থীরা একে মদত দিয়ে যায়। ভারতীয় মুসলমানদের কাছে প্রচার করা হয় যে তারা হল বিশ্বজনীন মুসলিম সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আশির দশকে ভারতে এসে জামালউদ্দিন আল আফগানি এই ধারণা প্রচার করেন। বিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের ঘনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়। লর্ড কার্জন এই মনোভাবকে মদত দিয়ে যান। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আলিগড় কলেজের সেক্রেটারি নবাব মহসিন-উল-মুল্ক মহামেডান পলিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের পর ভারতীয় মুসলমানদের পৃথক সত্তাবোধ স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কার্জন এই পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে ঐক্যবদ্ধ ভারতের ধারণা নস্যাৎ করা। অন্য লক্ষ্য ছিল জাতীয়তাবাদকে বিভক্ত করে দুর্বল করে দেওয়া। ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা বাঙালিরা কার্জনের এই অভিসন্ধিকে বাধা দিয়েছিল। শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রবল স্বদেশি আন্দোলন। এই আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য কার্জন মুসলিমদের তোষণ করেন। মুসলমানদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের স্বপ্ন দেখানো হয়।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে কার্জনের স্থলাভিষিক্ত হন লর্ড মিন্টো। তিনিও কার্জনের মতো মুসলমানদের তোষণ করে চলার নীতি অনুসরণ করেন। পাঞ্জাবে কলোনি স্থাপন নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিলে মিন্টো তা বাতিল করে দেন। ঠিক এইসময়ে ভারতসচিব মর্গে নরমপন্থীদের কাছে টানার জন্য শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা ভাবেন। ভারতীয় রাজনীতিতে চরমপন্থার আবির্ভাব ব্রিটিশ সরকারকে চিন্তিত করে তুলেছিল। মুসলমানদের বিরোধিতা বা কংগ্রেসের সঙ্গে মিলন সরকারের একেবারেই কাম্য ছিল না। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতের মুসলিম নেতাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল।
তরুণ নেতারা আন্দোলনের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। শাসন সংস্কার হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা লাভবান হবে এমন সম্ভাবনা ছিল। আলিগড় কলেজের প্রিন্সিপাল আর্টবোল্ডের পরামর্শে আলিগড় সম্প্রদায়ের নেতা মহসিন-উল-মুল্ক বড়োলাটের কাছে মুসলিম প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আর্চবোল্ড উদ্যোগী হয়ে বড়োলাটের প্রাইভেট সেক্রেটারি ডানলপ স্মিথের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ৩৫ জন সদস্যের এক মুসলিম প্রতিনিধিদল বড়োলাটের সঙ্গে সিমলায় সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিল। এটি রচনা করেছিলেন আর্চবোল্ড। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মৌলানা মহম্মদ আলি সহ সকলে এব্যাপারে একমত যে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছানুযায়ী এই প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় (The deputation was engineered)। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের ছোটোলাট হেয়ার নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা বলেন (all political agitation must be engineered) |
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর লন্ডন টাইমস পত্রিকা ভারতীয় মুসলমানদের অনুকূলে বক্তব্য রেখেছিল। উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের পৃথক সত্তার কথাটি ইংল্যান্ডের মানুষের কাছে তুলে ধরে জনমত গঠন করা। সিমলাতে যাঁরা বড়োলাটের সঙ্গে দেখা করেন তাদের ৩৫ জনের মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন জমিদার। এরা বড়োলাটকে যে স্মারকলিপি দেন তাতে তিনটি বিষয় স্থান পেয়েছিল : (১) মুসলমানরা ভারতের জনসংখ্যার ২০-২৫ শতাংশ, রাশিয়া বাদে ইউরোপের যে-কোনো দেশের জনসংখ্যার বেশি। (২) শুধু সংখ্যার ভিত্তিতে ভারতীয় রাজনীতিতে তাদের স্থান নির্দিষ্ট করলে ভুল হবে। মুসলমানদের রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষায় তাদের অবদান মনে রেখে তাদের গুরুত্ব দিতে হবে (weightage)।
(৩) একশো বছর আগে এদেশের রাজনীতিতে তাদের যে অবস্থান ছিল তাও মনে রাখতে হবে। মিন্টো মুসলিমদের আশ্বাস দেন যে পরবর্তী শাসনসংস্কার প্রবর্তনের সময় তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হবে। লোকাল বোর্ড, মিউনিসিপ্যালিটি ও আইনসভায় তাদের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হবে। সংখ্যানুপাত ছাড়াও তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সাম্রাজ্যের সেবায় তাদের অবদানের কথা মনে রাখা হবে।
লর্ড মিন্টো তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের শাসনসংস্কারে মুসলমানদের শুধু প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হয়নি, তাদের জন্য সংখ্যানুপাতের অধিক আসন সংরক্ষণ এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের ব্যবস্থা হয়েছিল। মুসলমানদের স্মারকলিপিতে বর্ণ হিন্দু, তপশিলি হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কথা ছিল। এর ফলে পরবর্তীকালে এসব গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আসন সংরক্ষণের দাবি উঠেছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ঐতিহাসিক ভূমিকা বা সামরিক ব্যবস্থায় সেবামূলক কাজ গুরুত্ব পায় না। এতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি জটিল হয়ে পড়ে।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মলে-মিন্টো সংস্কার আইনে কেন্দ্র, বোম্বে, মাদ্রাজ ও বাংলায় মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। এদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করা হয়। মুসলমানরা ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের সংস্কারে তাদের দাবিমতো ওয়েটেজ পেয়েছিলেন। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন যে আমলারা এমনভাবে নির্বাচন আইন-কানুন তৈরি করলেন যে মুসলমানরা বেশি ওয়েটেজ পেয়ে যান। গোখলের মতো নরমপন্থী নেতা দুঃখ করে বলেছিলেন যে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব শুধু অন্যায্য হয়নি, ভয়াবহভাবে অন্যায্য হয়েছে। কেন্দ্রীয় আইনসভায় ২৭টি নির্বাচিত আসনের মধ্যে দশটি মুসলমানদের দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা তাদের সংখ্যানুপাতের চেয়ে ছিল অনেক বেশি। আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে জাতীয় কংগ্রেস এসময় তার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেনি। কংগ্রেসের উচিত ছিল ঔদার্য না দেখিয়ে মিন্টো, আগা খান ও আমির আলিদের দাবির বিরোধিতা করা। এই সংরক্ষণ ও পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ছিদ্রপথেই দেশ বিভাগের শনি প্রবেশ করেছিল। মতিলাল নেহরুর মতো ঝানু রাজনীতিকের মতে, তৃতীয় পক্ষ ইংরেজ জিতে গেল।