টীকা লেখ- ইলবার্ট বিল বিতর্ক (১৮৮৩) । ইলবার্ট বিল বিতর্ক টিকা ।
ভূমিকা :
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ইলবার্ট বিল বিতর্ক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ৷ ভারতে ব্রিটিশ প্রজারা বিচারের ক্ষেত্রে কতকগুলি সুবিধা ভোগ করত। প্রথমে সুপ্রিমকোর্টে তাদের বিচার হত, কোম্পানির অন্য আদালতে ব্রিটিশ প্রজাদের বিচার হত না। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড মেকলে এবং ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের শাসন পরিষদের আইন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য বেথুন ব্রিটিশ প্রজাদের কোম্পানির আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত করার প্রস্তাব করলে ইউরোপীয়রা প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। এদের প্রস্তাবিত আইনকে Black Acts নাম দিয়ে আন্দোলন করেছিল। ফলে সংস্কারের প্রস্তাবগুলি বাতিল হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে সচেতন বাঙালিরা এই প্রস্তাবগুলি সমর্থন করেছিল। এজন্য ইংরেজ ও বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়।
ইলবার্ট বিল বিতর্ক :
কলকাতার হাইকোর্ট স্থাপিত হলে সুপ্রিমকোর্টের এক্তিয়ার তার হাতে স্থানান্তরিত হয়। হাইকোর্টের অরিজিনাল সাইডে (original side) ইউরোপীয়দের বিচারের ব্যবস্থা হয়েছিল। পরে ইউরোপীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও জে. পি. -রা (Justice of Peace) ইউরোপীয়দের বিচারের অধিকার পেয়েছিল। প্রেসিডেন্সি শহরগুলির বাইরে ভারতীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের এই অধিকার ছিল না।
১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ভারতীয় সদস্য বি. এল. গুপ্ত ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের (১৮৮২) বৈষম্যমূলক দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি দেখিয়েছিলেন ঐ কোড অনুযায়ী একজন ভারতীয় ম্যাজিস্ট্রেট ইউরোপীয়দের বিচার করতে পারবেন না অথচ তার অধঃস্তন ইউরোপীয় অফিসার তা পারবেন। এই ব্যবস্থা নানাধরনের প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। গুপ্ত ভারতীয় ও ইউরোপীয় অফিসারদের মধ্যে সমতা দাবি করেছিলেন। বাংলার ছোটোলাট অ্যাশলি ইডেন বি. এল. গুপ্তর বক্তব্য সমর্থন করে অভিমত দেন। ভারত সরকার এই বিষয়টি বিবেচনা করে ভারতসচিবের মতামত চেয়ে পাঠান। ভারতসচিব তাঁর কাউন্সিলের সঙ্গে পরামর্শ করে ইউরোপীয় ও ভারতীয় অফিসারদের ইউরোপীয়দের বিচারের অধিকার দিতে বলেন।
এই পটভূমিকায় বড়োলাটের শাসন পরিষদের আইন সদস্য কোর্টনে ইলবার্ট ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোর্ড সংশোধন করে জাতিগত সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিল প্রস্তুত করেন। এই বিলটি ইলবার্ট বিল নামে খ্যাত। সমস্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও জে. পি. দের ইউরোপীয়দের বিচারের অধিকার দেওয়া হয়। এই সহজ প্রশাসনিক ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় সমাজ একটি প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কলকাতায় ইউরোপীয়দের ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হয়, সারাদেশে এর শাখা গঠন করা হয়। সবশ্রেণির ইউরোপীয়—আমলা, বণিক, শিল্পপতি, চা-বাগিচার মালিক, আইনজীবী এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। কলকাতার টাউন হলে সভা করে তারা ইলবার্ট বিলের বিরোধিতা করেছিল। শুধু তাই নয়, তাঁরা বড়োলাট রিপনকে অসম্মান করে, এমনকি তাঁকে জোর করে বিলেতে পাঠানোর ষড়যন্ত্রও করেছিল।
হেনরি কটন এই আন্দোলন সম্পর্কে যে বর্ণনা রেখে গেছেন তাতে দেখা যায়। ইউরোপীয়রা সব রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে অত্যন্ত কুৎসিৎভাবে ভারতীয়দের আক্রমণ করেছিল। ব্যারিস্টার ব্রানসন (Branson) ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কুৎসিৎ, কুরুচিকর ভাষা ব্যবহার করেন। কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবং বোম্বে অ্যাসোসিয়েশন ইলবার্ট বিলের সমর্থনে আন্দোলন করেছিল। লালমোহন ঘোষ ব্রানসনের আক্রমণের সমুচিত জবাব দেন। টাইমস পত্রিকা ইউরোপীয়দের পক্ষ সমর্থন করে সম্পাদকীয় লিখেছিল (The universal opinion of the European Community cannot be lightly disposed of)। হেনরি কটন আরও জানিয়েছেন যে সমস্ত ইউরোপীয় আই. সি. এস., হাইকোর্টের জজরা (রমেশচন্দ্র মিত্র বাদে) এবং ছোটোলাট রিভার্স টমসন এই বিলের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনটি কারণে বড়োলাট লর্ড রিপন নতিস্বীকার করে বিলের সংশোধন করতে বাধ্য হন। ইউরোপীয়রা ঐক্যবদ্ধভাবে বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল।
বড়োলাটের শাসন পরিষদের অধিকাংশ সদস্য তাঁকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেননি। ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সরকার এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বিলটি সংশোধিত অবস্থায় পাশ হয়। সংশোধনীতে ছিল কোনো ইউরোপীয় বিচারের সময় জুরি বিচার দাবি করতে পারবেন। জুরির বিচারকদের অর্ধেকের বেশি হবেন শ্বেতকায় ইংরেজ বা আমেরিকান। ইউরোপীয়দের বিচারের ক্ষেত্রে জাতিগত বৈষম্য রয়ে যায়, তাদের সুবিধা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি। স্যার জন স্টাচি জানিয়েছেন যে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের তিন আইনের ফলে কোনো পরিবর্তন হয়নি, বস্তুত আইন আগের মতো রয়ে যায়।
ভারত সরকার ইউরোপীয়দের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে নীতিগতভাবে পরাস্ত হন। মূল বিলটি সংশোধনীসহ যেভাবে পাশ হয় তাতে বিলের আসল উদ্দেশ্য পরাস্ত হয়। এই বিল নিয়ে যে আন্দোলন হয় তাতে ভারতীয়দের প্রতি ইউরোপীয় বিদ্বেষ নিঃসন্দেহে বেড়েছিল। শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার সম্পর্কে অবনতি ঘটে। এই আন্দোলনের ফলে সারাদেশে প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। ভারতীয়রা অপমানিত ও পরাস্ত হয়। ভারতীয়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতির কুৎসা করা হয়। ভারতীয়দের যোগ্যতা নিয়েও ইংরেজ আমলারা প্রশ্ন তুলেছিল। কটনের মতে, ইলবার্ট বিল নিয়ে বিতর্ক ও জাতিবিদ্বেষ ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রসারে সহায়ক হয়।
ইলবার্ট বিল আন্দোলনের আরও বৈশিষ্ট্য ছিল। এই আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা যুক্ত হয়েছিল। ছাত্ররা সভা-সমিতির আয়োজন করে বক্তৃতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তরা এই আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিল। ঐ বছর আদালত অবমাননার দায়ে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির দুমাস জেল হলে গণ আন্দোলন বিপুল আকারে দেখা দিয়েছিল। এই আন্দোলনে ছাত্র, বণিক, পেশাদারি মানুষ, মধ্যবিত্ত সকলে শামিল হয়েছিল। এই আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল, বিভিন্ন শহরে ব্রিটিশবিরোধী সভা হয়। সমগ্র ভারতে একাত্মবোধ দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। এসব হল ইলবার্ট বিল আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ফল। সামান্য প্রশাসনিক সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে জাতিবৈরিতা তৈরি হয় তাতে ভারতের জাতীয় আন্দোলন লাভবান হয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সম্মেলন ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রথম অধিবেশন বসেছিল। ইউরোপীয়দের জাতিবিদ্বেষ ও ঔদ্ধত্য সারা ভারতে রাজনৈতিক জাগরণ ঘটিয়ে দেয়। ইলবার্ট বিলের এই ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
উপসংহার :
এ. সি. মজুমদার এই বিতর্কের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় ভারতীয়রা এই আন্দোলন থেকে দুটি শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। একটি হল ঐক্য ও সমন্বয়ের শিক্ষা। ভারতীয়রা এই শিক্ষা পেয়েছিল যে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে না পারলে তারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। বিতর্ক চলাকালীন ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে বলেছিল। এই আন্দোলন থেকে ভারতীয়রা দ্বিতীয় যে শিক্ষা পেয়েছিল তা হল জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে ভারত সরকারকে নতিস্বীকারে বাধ্য করা যায়। ইলবার্ট বিল আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই আন্দোলন প্রধানত বাংলা ও বোম্বে প্রদেশে সীমাবদ্ধ ছিল, মাদ্রাজে এর সামান্য প্রভাব পড়েছিল। উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ও পাঞ্জাবে এর প্রভাব পড়েনি, এই দুই অঞ্চল শান্ত ছিল।