গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
ভারতবর্ষে তুর্কো আফগান সাম্রাজ্যের অন্যতম স্থপতি হিসেবে সুখ্যাত গিয়াসউদ্দিন বলবনের ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাস দিনতম অবস্থা থেকে সর্বোচ্চ ও অপ্রতিদন্ধি ক্ষমতা অর্জনের কাহিনী তার একাধিক পূর্বসূরীর মত বলবন ও ছিলেন তুর্কিস্তানের প্রসিদ্ধ ইলবারি উপজাতি উদ্ভূত। ভারতবর্ষে উপনীত হবার পর তাকে সুলতান ইলতুৎমিসের অধীনস্থ ‘চাহেল গান’ বা চল্লিশ নামে পরিচিত ক্রীতদল দলের অন্যতম হিসেবে দেখা গিয়েছিল। এরপর তিনি ইলতুৎমিসের খৎদার এবং রাজিয়ার আমলে ‘আমির ই শিকার’ পদ লাভ করেন। 1245 এ তাকে মোঙ্গল আক্রমণের বিরুদ্ধে সফল সেনানায়ক এবং এক বছরের পর সুলতান নাসির উদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। 1265 সালে দিল্লির সিংহাসন লাভ করার আগে প্রায় দু দশক ধরে বলবন যথেষ্ট সামরিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে দিল্লির রাজনীতিতে অসামান্য প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং শেষ পর্যন্ত নাসিরউদ্দিন এর মৃত্যুর পর অনায়াসে সিংহাসন দখল করেন।
![]() |
গিয়াসউদ্দিন বলবন |
অবশ্য শাসন ক্ষমতা লাভের সময় বলবনের অবস্থা ইষনীয় ছিলনা। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরবর্তী তিন দশকে সুলতানের মহিমার বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। রাজ কোষের শূন্যতা থেকে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল তুর্কি অভিজাতনের পরাক্রম ও মোঙ্গল আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি। নিজের অভিজ্ঞতা বাস্তব রাজনৈতিক জ্ঞান ও সূক্ষ্ম বুদ্ধির সাহায্যে বলবন সমস্ত প্রতিকূলতা জয়ে আত্মনিয়োগ করেন। শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনী যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভিত্তি তা উপলব্ধি করে তিনি সামরিক বাহিনীর সমস্ত বিভাগেই সংস্কার করতে থাকেন। অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত সেনা নায়কদের অধীনে তিনি অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী ন্যাস্থ করেন। পুনঃ গঠিত এই সেনাবাহিনীর সাহায্যেই বলবন রাজ্যে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
প্রথমে দিল্লির সন্নিহিত দোয়াব অঞ্চলকে মেওয়াটি রাজপুত এবং দস্যু দলের অভিশ্রান্ত উৎপত্তি থেকে মুক্ত করেন। উপদবে যাতে পুনরাবৃত্ত না হয় সে উদ্দেশ্যে গোপালগীরে নির্মিত হয় একটা দুর্গ এবং দিল্লির কাছাকাছি বহু সৈন্য শিধির এগুলি সুরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় আফগান সৈন্যদের ওপর। 1267 তে দোয়াব এলাকায় দস্যুদের নির্মূল করার অভিযানে সুলতান অংশ নেন। কম্পিল, পাতিয়ালা, খোজপুর, প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্গ তৈরির ফলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুর্গ তৈরি হয় ফলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিগত 30 বছরের অরাজকতার অবসান ঘটে এবং সুলতানের পরাক্রমের ওপর প্রজাদের আস্থা ফিরে আসে। অভিজাতরাও বোঝেন যে সুলতানের শক্তি সমর্থকে তুচ্ছ করার অর্থ নিজেদের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করা। সুতরাং বলবনের সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে মাথা নত করতে আর কেউ দ্বিধা করেনি।
তবে বিশৃঙ্খলা দূর করলেই যে সাম্রাজ্যের সংহতি বজায় থাকবে তা ভাবতেন না বলবন। দোয়াব অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা সময়ই তিনি জায়গীর প্রথার কুফল গুলির সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। ইলতুৎমিসের সময় থেকেই সুলতানকে সামরিক সাহায্য দানের বিনিময়ে 2000 শাযসী অশ্বারোহী সেনা জাগির ভোগ করে আসছিল। বলবনের সময়ে এদের অনেকের মৃত্যু হয়েছিল। বাকিরা ছিল অর্থব ও মৃত জায়গীরদের উত্তরাধিকারীরা কর্তব্য পালনে অনিচ্ছুক। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য সুলতান সচেষ্ট হন। এবং জায়গীর দাদা দেয় না সামান্য ভাতা দিয়ে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ করেন। কিন্তু শেষোক্তদের আবেদন বিনোদনে এবং দিল্লির কোতয়ালের অনুরোধে সুলতান মত পাল্টায়নি। বলাবাহুল্য এর ফলে সংস্কারযোগ্য একটা প্রথা আরো কিছুকালের জন্য টিকে যায়।
দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে বলবন এক দৃঢ় ও আপোসহীন নীতি অনুসরণ করেন। সামরিক ও বেসামরিক বিভাগে নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করে তার মধ্যে দক্ষতা ও দৃঢ়তার সমন্বয় ঘটান। মধ্যযুগে একনায়কতন্ত্রই ছিল শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অসামান্য একাগ্রতার সাহায্যে বলবন তার মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চারিত করেছেন। তার অধিনস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও প্রাদেশিক শাসকদের সুলতান অনুমোদিত কোন নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণে অধিকার ছিল না। রাজ শক্তির সবিনয় অস্তিত্ব সকলে অনুভব করতেন।
বলবন এ বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে সুলতান পৃথিবীতে খোদার প্রতিনিধি এবং এজাতীয় মর্যাদার যোগ্য হবার জন্য তিনি কতগুলি কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে নিরলস ছিলেন। ইসলামের মাহাত্ম্য অখুন্ন রাখা শরীয়াতের অনুজ্ঞা যথাযথ অনুসরণ করা। পুন্যাত্মাকে সম্মান করা এবং পক্ষপাতহীন বিচার ব্যবস্থা প্রচলন ইত্যাদি আদর্শ অনুসরণে অত্যন্ত ছিলেন সদা কর্মব্যস্ত এই সুলতান। রাজ্যের সর্বত্র ন্যায় বিচারের এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল যে দিনতম প্রজা দরিদ্র ভৃত্যদের উপরেও কেউ অবিচার করতে সাহসী হতো না।
বলবনের হাতে বদায়ুণের শাসক এবং জায়গীরদার মালিক বারবকের শাস্তি ও কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড বিচার ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেছিল। রাজ্য সুশাসন অব্যাহত রাখার জন্য বলবন ব্যাপকভাবে গুপ্তচর বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছিলেন। এর ফলে দেশের সমস্ত অঞ্চল থেকেই সঠিক সংবাদ দ্রুত পাওয়া সম্ভব হয়। গুপ্তচরদের বিশ্বস্ততার উপরেও ছিল সুলতানের সজাগ দৃষ্টি। রাজপুতদের সতী বিধির উপরেও খবরদারি করা হতো। গুপ্তচর বাহিনীর এই সক্রিয়তার ফলে দেশের অপরাধের সংখ্যা ও কমে যায়। শক্তি ভয় যে মানুষকে অপরাধ থেকে নিবিত্ত রাখে। বলবনের সাফল্যই তা দৃষ্টান্তরিত করেছিল।
ত্রয়োদশ শতকে সুলতানি সাম্রাজ্যের পক্ষে সবচেয়ে বিপদজনক হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ মোঙ্গল আক্রমণ। গজনী ও সমস্ত অক্ষুণদী (oxis) অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করে সর্বত্র সন্ত্রাস ছড়িয়ে মোঙ্গলরা সিন্ধু ও পাঞ্জাবের মধ্যে প্রবেশ করে। 1271 সালে লাহোরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করতে যান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। ভাতিন্দা,সামানা, প্রভৃতি অঞ্চল ছিল এতকাল শের খাঁর তত্ত্বাবধানে। কিন্তু কুখ্যাত ‘চল্লিশের‘ অন্যতম হাওয়ায় বলবন তার প্রতি সন্দীগ্ধ ছিলেন। ঠিক এই সময়ই শের খাঁর মৃত্যু ঘটে রহস্যজনকভাবে। বরানী সন্দেহ করেছেন যে, বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কে সন্দেহ সত্য হলে স্বীকার করতে হয় যে, সুলতানের এ কাজ ছিল অবিবেচনার প্রসূত। শের খাঁর যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গেই মঙ্গলা আক্রমণ প্রতিরোধ করে আসছিলেন। তার মৃত্যুর পরই সীমান্তবর্তী এলাকার মঙ্গলরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বলবন জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদ কে মুলতানে ও দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খাঁকে (বুগরা খান) সামানা ও সুনাসের দায়িত্ব দিয়ে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেন। 1279 তে মোহাম্মদ বুঘরা (বুগরা) এবং দিল্লি থেকে প্রেরিত মালিক মুবারকের সম্মিলিত আক্রমণে মোঙ্গলরা পরাজিত হয় কিন্তু মোঙ্গল আক্রমণ প্রশমিত হলেও বলবন স্বস্তি পাননি।
আরো পড়ুন – দিল্লি সালতানাত সুদৃঢ়করণে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
ঠিক এই সময় ই এক দূরবর্তী প্রদেশ বাংলায় তুঘ্রিল খাঁ বিদ্রোহ হয়ে ওঠেন। দক্ষ, কর্মব এই শাসন কর্তার এতদিন বলবনের শক্তির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিলেন। তার এই বিশ্বাসঘাতক তাই ক্রুদ্ধ সুলতান তুঘ্রিলের বিরুদ্ধে আমীর খাঁর নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী পাঠান। কিন্তু বিদ্রোহ দমনের ব্যর্থ হওয়ায় আমীর খাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। শেষ পর্যন্ত বুখরা খাঁকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ সুলতান স্বয়ং লক্ষ্যেধীতির উদ্দেশ্যে রওনা হন। অতি কষ্টে তুঘ্রিলের বিদ্রোহ দমিত হয়। বিদ্রোহের অন্যান্য নেতা ও তুঘ্রিলের আত্মীয়দের চরম শাস্তি দানের পর বলবন বুখরা খাঁর উপর বাংলার শাসনভার অর্পণ করেন।
মূল্যায়ন
বাংলার বিদ্রোহ দমনের কিছু পরেই বলবনের জীবনে এক প্রচন্ড বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিল। 1285 তে তামারের নেতৃত্বে যে মোঙ্গল বাহিনী পাঞ্জাব আক্রমণ করে তা প্রতিরোধের সময় মহম্মদ প্রাণ হারান। সুযোগ্য এবং প্রিয় পুত্রের অকাল মৃত্যুর বলবনের পক্ষে মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। মৃত্যু আসন্ন জেনে তিনি দ্বিতীয় পুত্র বুখরা খাঁকে ( নাসিরুদ্দিন বুগরা খান/Nasiruddin Bughra Khan) উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু বুখরা খাঁ অস্বীকৃত হাওয়ায় পৌত্র কাই খসরুকে সুলতান পদে অভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলবন। এর কিছু পরেই 1287 তে তার দেহাবসান হয়। সুলতানি সাম্রাজ্যের সু-শাসক এবং মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধে গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।
FAQ (Frequently Asked Questions)
গিয়াসউদ্দিন বলবনের আসল / প্রকৃত নাম কি ছিল?
উত্তর: গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রকৃত নাম ছিল “উলুঘ খাঁ”। তিনি তুর্কি ইলবারি বংশের ছিলেন।
গিয়াসউদ্দিন বলবনের উপাধি কি
উত্তর: বলবন এ বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে সুলতান পৃথিবীতে খোদার প্রতিনিধি। তিনি জিল-ই-ইলাহী (ঈশ্বরের ছায়া) উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি কত ছিল
উত্তর: দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল পূর্বে, গৌড় (বাংলা) থেকে পশ্চিমে গজনি (আফগানিস্তান) পর্যন্ত। এতে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ও (দ্রাবিড়) অন্তর্ভুক্ত ছিল।