StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের কারণ গুলি আলোচনা করো

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের কারণ গুলি আলোচনা করো। 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কি ।মহাবিদ্রোহের কারণ গুলি আলোচনা করো । মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কি ছিল ।‌

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও মধ্যভারত জুড়ে এক বিশাল গণবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, এই বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বেঙ্গল আর্মিতে এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, এজন্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা এর নাম দেন সিপাহি বিদ্রোহ। সৈন্যবাহিনীতে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও পরে বেসামরিক জনগণ কৃষক, শ্রমিক, কারিগর, মজুর সকলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এক বছরের অধিককাল ধরে এই বিদ্রোহ চলেছিল। বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহীরা ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছিল। এই বিদ্রোহের অনেক কারণ ছিল, এর মধ্যে অনেক স্তর ছিল।

সি. এ. বেইলি লিখেছেন এটি একটি বিদ্রোহ নয়, অনেক বিদ্রোহ (The Indian Rebellion 1857 was not one movement…It was many)। মহাবিদ্রোহের কারণ  হল কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষ। একশো বছর ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে এদেশ জয় করেছিল। বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জনমনে যে বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল তা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের আকারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই বিদ্রোহের পটভূমিকায় ছিল প্রথম আফগান যুদ্ধে কোম্পানির বিপর্যয় ও ব্যর্থতা, পাঞ্জাব ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ব্রিটিশ সামরিক শক্তির অপরাজের ভাবমূর্তির হানি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এদেশের মুসলমান, কোল ও সাঁওতালরা কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। কোম্পানির সৈন্যবাহিনীতে অনেকবার বিদ্রোহ হয়েছিল ।

লর্ড ওয়েলেসলির আগ্রাসী নীতি এবং লর্ড ডালহৌসির ছলে-বলে-কৌশলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার এদেশের শাসকদের মনে ভীতি ও ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। কোম্পানি দেশীয় রাজাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেগুলি রক্ষা করেনি। চুক্তি ভঙ্গ বা বিশ্বাসঘাতকতা করে একের পর এক দেশীয় রাজ্য গ্রাস করার ফলে বহু ভারতীয় শাসক কোম্পানির শত্রুতে পরিণত হন। ওয়েলেসলি বন্ধু রাজাদের অধীনস্থ শক্তিতে পরিণতি করেন। তাদের ওপর এমন সব শর্ত চাপিয়েছিলেন যে তারা স্বাধীনতা হারিয়েছিল। ডালহৌসি যুদ্ধ করে পাঞ্জাব অধিকার করেন। আর স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, ফাঁসি, নাগপুর, উদয়পুর, সম্বলপুর প্রভৃতি রাজ্যগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন। ব্রিটিশ শাসন এদেশের ঐতিহ্যনির্ভর আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করতে থাকে।

সরকার হিন্দুশাস্ত্র অনুমোদিত প্রাচীন দত্তক প্রথাকে বাতিল করে দিয়েছিল। সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও, নানাসাহেব এবং ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ ইংরেজদের ওপরে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কোম্পানি সরকার নানাসাহেবের পেনশন বন্ধ করে দেয়, অন্যান্য দেশীয় রাজাদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কর্ণাটকের নবাব এবং সুরাটের রাজার ক্ষেত্রে কোম্পানি একই নীতি অনুসরণ করেছিল। ঝাঁসির রানির দত্তক পুত্রকে কোম্পানির সরকার রাজা বলে স্বীকৃতি দেয়নি। এই দেশীয় রাজ্যটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেওয়া হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি ঘোষণা করেছিল যে বাহাদুর শাহের উত্তরাধিকারী লালকেল্লার প্রাসাদ এবং বাদশাহ উপাধি পাবেন না। এতে ভারতীয় মুসলমান সমাজে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল।

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ডালহৌসি কর্তৃক অযোধ্যা অধিগ্রহণ দেশীয় রাজাদের কোম্পানির মতিগতি সম্পর্কে সন্দিগ্ধ করে তুলেছিল। অযোধ্যার অনেক তালুকদার তাদের জমি ও অধিকার হারিয়েছিল, তাদের দুর্গগুলি ভেঙে দেওয়া হয়, অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়। অযোধ্যার অভিজাতরা দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়, তারা সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা দুইই হারিয়েছিল (In Awadh the taluqdars lost about half of their estates, they were disarmed and their forts demolished, resulting in a considerable loss of status and power in local society)। কোম্পানির বেঙ্গল আর্মিতে বহু অযোধ্যার লোক ছিল, গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে এদের যোগযোগ ছিল, নতুন ভূমি ব্যবস্থার ফলে এরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে অযোধ্যা অঞ্চলে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সকলেই ধরে নিয়েছিল রাজভক্তি বা আনুগত্য, লিখিত চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি দেশীয় রাজ্যগুলিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধা থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

ভারতে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে নানা কারণে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক দুর্গতি বেড়েছিল। ব্রিটিশ প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার জন্য অযোধ্যা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের তালুকদার ও কৃষকরা অনেকে তাদের অধিকার হারিয়েছিল। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের ১,১০,০০০ একর জমি বিক্রি হয়ে যায়, যার বেশিরভাগ কিনেছিল বানিয়া ও মহাজনরা। এজন্য বিদ্রোহ শুরু হলে এদের সম্পত্তি আক্রমণের শিকার হয়েছিল (Thus the sale of land not merely uprooted the ordinary people from their small holdings but also destroyed the gentry of the country and both the orders being the victims of the operations of British Civil law were United in the revolutionary epoch of 1857-58 in common effort to recover what they had lost)।

অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরি অযোধ্যা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের তালুকদার ও কৃষকদের বিক্ষোভকে মহাবিদ্রোহের একটি প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। সর্বত্র কৃষকদের দেয় ভূমিকরের হার বেড়েছিল, কোম্পানি প্রবর্তিত রায়তওয়ারি ও মহালওয়ারি ব্যবস্থায় ভূমি করের হার ছিল বেশ উঁচু, বন্দোবস্ত ছিল অস্থায়ী। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অঞ্চলে ভূমিতে রায়তের কোনো অধিকার ছিল না। জমিদাররা খুশিমতো প্রজা উচ্ছেদ করে অন্য প্রজার সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্ত করতে পারত।

ব্রিটিশ সরকার আয় বৃদ্ধির জন্য বহু নিষ্কর জমি খাস করে নিয়েছিল। এতে বহু লোক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছিল। ডালহৌসির সময় বোম্বের ইনাম কমিশন দাক্ষিণাত্যে ২০,০০০ এস্টেট খাস করে নিয়েছিল। কোম্পানির শাসনব্যবস্থায় এদেশিরা উচ্চপদ পেত না, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর আমিন ছিল ভারতীয়দের প্রাপ্য সর্বোচ্চ পদ। ভারতীয় অভিজাতরা শাসন ও বিচারবিভাগ থেকে কার্যত অপসারিত হয়েছিল। দেশীয় রাজাদের অধীন সৈন্যবাহিনী ভেঙে দেবার ফলে হাজার হাজার পেশাদার সৈনিক জীবিকাচ্যুত হয়েছিল।

দেশীয় রাজা ও নবাবদের পতনের ফলে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত বহু সাধু, সন্ত, দরবেশ ও মৌলবি জীবিকা হারিয়েছিলেন। ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অবাধ বাণিজ্যনীতি ও শুল্কনীতি এদেশের শিল্প বাণিজ্যের ক্ষতি করেছিল। অবাধ নীতির ফলে এদেশের শিল্পের ক্ষতি হয়, মার্কস লিখেছেন যে ব্রিটিশ নীতির ফলে এদেশের তাঁতিরা ধ্বংস হয়ে যায়। অতিরিক্ত করভাবে পীড়িত ছিল সর্বশ্রেণির মানুষ। কোম্পানির নীতির ফলে এদেশের জাতীয় বয়নশিল্প নষ্ট হয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ তাঁতি, কারিগর, মঞ্জুর চাবি, রঙের কারিগর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারা দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ জীবিকচ্যুত মানুষের জীবনধারণের কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসন এ সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, ফলে সারা দেশে বেকারত্ব ও দুর্দশা দেখা দিয়েছিল। দিল্লি থেকে প্রচারিত বিদ্রোহীদের ঘোষণায় বলা হয়েছিল কোম্পানির শাসনে এদেশে করভার বৃদ্ধি পেয়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব দেখা দিয়েছে এবং বহুলোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, প্রশাসন ও আইনের কঠোরতা এদেশের জনগণকে এই শাসনের প্রতি বিরূপ করে তুলেছিল। ব্রিটিশ শাসন নানা কারণে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বিচার ও পুলিশ বিভাগ ছিল জনগণের কাছে রীতিমত ভয়ের বস্তু। দেশের ধনী ও মহাজনরা পুলিশ, নিম্ন আদালত ও নিম্নস্তরের রাজকর্মচারীদের সহায়তা নিয়ে গরিবদের শোষণ ও নির্যাতন করত। জনগণ এসব প্রতিষ্ঠানকে বুঝতে পারেনি, এদের জটিলতা তাদের কাছে বোধগম্য হয়নি। বিদেশি জাতি চিরকাল এদেশে বিদেশি রয়ে যায়, এদেশের মানুষের সঙ্গে তাদের সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ রাজপুরুষরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বিজয়ীর জাতি বলে মনে করত, এদের কাছে বিজিত ভারতীয়রা ছিল নিম্নস্তরের প্রাণী।

মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী স্যার সৈয়দ আহমদ খান লিখেছেন যে, একজন অভিজাত ভারতীয় ব্রিটিশ রাজপুরুষের সম্মুখীন হলে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। ব্রিটিশ রাজপুরুষরা এদেশীয়দের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ঘৃণ্য আচরণ করত। অফিস-আদালতে, হাটে-বাজারে, রেলস্টেশনে ভারতীয়রা অসম্মানের শিকার হত। ভারতে দ্রুত পশ্চিমি শিক্ষার অনুপ্রবেশ ও আধুনিকীকরণ এদেশের রক্ষণশীল সমাজের মনঃপুত হয়নি। ভারতীয় সমাজ সংস্কারকদের পরামর্শে সতীদাহ প্রথা নিবারণ, বিধবার পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা, শিশু হত্যা নিষিদ্ধকরণ, স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার, ধর্মান্তরিতের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার রক্ষা ইত্যাদি এদেশের ধর্ম ও সমাজের ওপর বিদেশির হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করা হয়। এমনকি আধুনিকীকরণকেও ভালো চোখে দেখা হয়নি। রেললাইন স্থাপন, স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল, ডাক ও তার বিভাগ ইত্যাদিকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বিদ্রোহের সময় ভারতীয়রা এসব প্রতিষ্ঠান আক্রমণ করেছিল। ধর্মান্তরিতের উত্তরাধিকার আইনকে (১৮৫০) এদেশীয়দের ধর্মান্তরকরণে উৎসাহদান বলে গণ্য করা হয়।

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের বিরাগের ধর্মীয় কারণ ছিল। সারা দেশে এমন ধারণা গড়ে উঠেছিল যে কোম্পানির শাসনাধীনে ভারতীয়দের ধর্ম নিরাপদ নয়। এমন ধারণাও সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার ও রাজপুরুষরা এদেশের সকলকে খ্রিস্টান করতে চান। ব্রিটিশ সরকারের এরকম কোনো রাষ্ট্রনীতি ছিল না, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় খ্রিস্টান মিশনারিদের এরকম কর্মসূচি ছিল। ভারতে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত রাজপুরুষরা মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। মিশনারিরা এদেশীয়দের খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার জন্য নানারকম প্রলোভন দেখাতেন, বিদ্যালয়, জেলখানা, হাসপাতাল, এমনকি হাটেবাজারেও এদের সক্রিয় দেখা যেত। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকরা এদেশের হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের নিন্দা করে বক্তৃতা দিত, প্রবন্ধ লিখত। এসব ধর্মের বিরুদ্ধে জঘন্য ও মিথ্যা প্রচার চালানো হত। জনগণের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে কোম্পানির সরকার এদেশের সকলকে খ্রিস্টান করতে চায়।

রজতকান্ত রায় লিখেছেন যে হিন্দু ও মুসলমান তাদের ধর্ম রক্ষার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বিদেশি অধীনতা পাশ থেকে মুক্ত হবার জন্য হিন্দু ও মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তারা উপলব্ধি করেছিল দেশটি তাদের, বিদেশিদের নয়। ভারতে জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়নি, ধর্ম তাদের আদর্শ জুগিয়েছিল, ঐক্যবদ্ধ করেছিল (religion filled an ideological vacuum in the absence of a fully developed concept of the Indian nation) 1 ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে এদেশে খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হত। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে আর. ডি. ম্যাঙ্গলস (R. D. Mangles) কমন্সসভায় ভারতে খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে বক্তৃতা দেন। বলাবাহুল্য, এর ফলে ভারতে ধর্ম নিয়ে ভীতি ও আতঙ্ক আরও বেড়ে যেত।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ সৈন্যবাহিনীতে শুরু হয়েছিল। বেঙ্গল আর্মি বিদ্রোহ করেছিল, বোম্বে ও মাদ্রাজ আর্মি শান্ত ছিল। এই সৈন্যবাহিনী ব্রিটিশের ভারত জয় সম্ভব করেছিল, অথচ এই বাহিনীতে ক্ষোভের অন্ত ছিল না। অসামরিক ভারতীয় সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও হতাশা তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হত। বেঙ্গল আর্মির বেশিরভাগ সদস্য ছিল উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, রাজপুত ও ভূমিহার, এদের অনেক ধর্মীয় সংস্কার সৈন্যবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল। পরে কর্তৃপক্ষ এসব অধিকার কেড়ে নেয়, এতে এদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিটিশ অফিসাররা ভারতীয় সিপাহিদের ঘৃণার চোখে দেখত, গালিগালাজ চলত, অন্যান্য অভদ্র ব্যবহারও ছিল। একজন ভারতীয় সিপাহি ব্রিটিশ সিপাহি অপেক্ষা কম বেতন পেত, ভারতীয়দের পদোন্নতি ছিল না, খাওয়া দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা ছিল নিকৃষ্টমানের।

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল সার্ভিস এনলিস্টমেন্ট অ্যাক্ট (General Service Enlistment Act) পাশ করে বলা হয় ভারতীয় সৈনিকদের যে কোনো স্থানে গিয়ে যুদ্ধ করতে হবে, প্রয়োজনে সাগরপারেও যেতে হবে, কোনো আপত্তি করা চলবে না। জাতিচ্যুত হবার ভয়ে ভারতীয়রা সাগরপারে যেতে চাইত না। ভারতের বাইরে যুদ্ধ করার জন্য ভারতীয় সিপাহিদের বাড়তি ভাতা বা বাট্টা দেওয়া হত, এই ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জাতি নির্দেশক চিহ্ন যেমন পাগড়ি, দাড়ি, টিকি ইত্যাদি ধারণ নিষিদ্ধ হয়। খ্রিস্টান মিশনারিরা সৈন্যবাহিনীতে ধর্মপ্রচার করতে যেতেন। এতে সৈনিকদের ধারণা হয় ব্রিটিশ শাসনাধীনে তাদের ধর্ম নিরাপদে নয়। বেঙ্গল আর্মিতে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত বেশি, ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে অনুপাত ছিল ৫ : ১। এই অবস্থা বোম্বে ও মাদ্রাজ আর্মিতেও ছিল। কোম্পানির সৈন্যবাহিনীতে মাঝে মাঝে বিদ্রোহ হত, বেঙ্গল আর্মিতে বিদ্রোহের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিদ্রোহ হলে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দ্রুত তা দমন করত।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দেশের মধ্যে বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল। সৈন্যবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশবাহিনীর বিপর্যয় এবং ইউরোপ ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ব্রিটিশের অপরাজেয় সামগ্রিক ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিয়েছিল। ঠিক এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল নামক এক নতুন আগ্নেয়াস্ত্র চালু করেছিল। এই রাইফেলের কার্তুজ চর্বি লাগানো একটি মোড়কে থাকত, মোড়কটি দাঁতে কেটে কার্তুজ বার করতে হত। জনরব উঠেছিল ঐ মোড়কে গোরু ও শুয়োরের চর্বি আছে, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মনাশ করার জন্য এই ব্যবস্থা করেছে। এরপর বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। বিদ্রোহ বা বিপ্লবে গুজব একটি শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে, এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। সরকার এই কার্তুজ প্রত্যাহার করলেও সৈন্যবাহিনীর ভারতীয় সিপাহিরা সরকারকে বিশ্বাস করতে পারেনি।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরের সৈন্য শিবিরে মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বে মহাবিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। ঐ বছর ১০ মে মিরাট শহরে বিদ্রোহ বিরাট আকারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বিদ্রোহ ক্রমশ প্রবল আকার ধারণ করে উত্তর, মধ্য ও পূর্ব ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। দিল্লি, মিরাট, কানপুর, লখনউ, ঝাঁসি, অযোধ্যা ও বিহারের শাহাবাদ জেলা হল বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র। উত্তর ও মধ্য ভারতের সর্বত্র সিপাহিদের সঙ্গে চাষি, মজুর, কারিগর শ্রেণির বহু মানুষ যোগ দিয়েছিল। উত্তরে পাঞ্জাব থেকে দক্ষিণে নর্মদা, পূর্বে বিহার থেকে রাজস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *