আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের তাৎপর্য বা গুরুত্ব আলোচনা কর
আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের ছিল তিনটি লক্ষ্য–বিদেশি আগ্রাসন প্রতিহত করা, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করা এবং নিজেদের ক্ষমতার কেন্দ্রকে সুরক্ষিত করা। প্রাদেশিক শাসকরা এই তিনটি সীমিত লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হন। চিনকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা তাঁদের লক্ষ্য ছিল না। প্রথাগত ব্যবস্থাকে তাঁরা শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, পুরোনো ব্যবস্থার পতন ঘটানে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না (They strove to strengthen the existing order x rather than to replace it)।
আত্মশক্তি আন্দোলনের নেতাদের চিন্তাভাবন ছিল সীমাবদ্ধ, দৃষ্টি সংকীর্ণ, আধুনিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন, শিল্পবিপ্লব ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এর ফল হল চিনের বিশাল সাম্রাজ্যে তার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি অগ্রসর আধুনিক অঞ্চল গড়ে তুলেছিল, আর সব পুরোনো ব্যবস্থার আধিপত্য বজায় ছিল। এই বিক্ষিপ্ত অঞ্চলগুলি হল বিশাল সমুদ্রে ভাসমান কয়েকটি দ্বীপের মতো। এই সংস্কার আন্দোলনের অন্য ত্রুটি হল এগুলি ওপর থেকে জনগণের ওপর চাপানো হয়েছিল, জনগণের কোনো উদ্যোগ ছিল না।
মেজি জাপানে সাধারণ মানুষকে পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। চিনের শাসকগোষ্ঠীর বেশিরভাগ ছিল রক্ষণশীল জেন্ট্রি। এরা আধুনিকতার পুঁজিবাদ বা বণিকশ্রেণীর ভূমিকা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। বণিকদের প্রতি এরা অবজ্ঞাসূচক মনোভাব পোষণ করত, শিল্প ও বাণিজ্যে বেসরকারি উদ্যোগকে এরা পছন্দ করেনি। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের উপযোগিতাও এরা বোঝেনি। যৌথ উদ্যোগ বা বেসরকারি উদ্যোগে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব দেখা দিয়েছিল, সরকারি উদ্যোগের মধ্যে ছিল আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা, স্বজনপোষা ও দুর্নীতি। উনিশ শতকের মধ্যভাগে চিন ছিল একটি দরিদ্র দেশ, পুঁজি গঠনের তেমন সুযোগ ছিল না।
সরকারি ও বেসরকারি স্তরে পুঁজির অভাবের জন্য শিল্পস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সরকার কর বসিয়ে বাড়তি সম্পদ সংগ্রহের উদ্যোগ নিলে দরিদ্র জনগণের হাতে বিনিয়োগযোগ্য মূলধন গড়ে ওঠেনি। চিনে যেকটি আধুনিক শিল্পসংস্থা গড়ে উঠেছিল তাদের প্রতিষ্ঠাতারা হলেন একই গোষ্ঠীর লোক। এসব শিল্পে লাভ হত বার্ষিক ৮-১০ শতাংশ, তা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টিত হত, পুনরায় বিনিয়োগযোগ্য মূলধন তৈরি হত না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আত্মশক্তি আন্দোলনের সময় চিনে সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ ছিল তীব্রতম। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে জাপান ফরমোজা দখল করেছিল, ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে লিউ চিউ দ্বীপপুঞ্জ ; ব্রিটেন ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে উনান উন্মুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছিল, রাশিয়া সিংকিয়াং অঞ্চলে ইলি দখল করেছিল। ফ্রান্স চিনের করদ রাজ্য আন্নাম অধিকার করে, কোরিয়া নিয়ে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে। এসব ঘটনার জন্য সামরিক ব্যয় ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় বেড়েছিল, আত্মশক্তি আন্দোলন ব্যাহত হয়।
পশ্চিমের যন্ত্র বিপ্লব ঘটানো বা আধুনিক শিল্প পরিচালনার জন্য যে মানসিকতার প্রয়োজন হয় চিনে তা ছিল না। চিনে প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞানের বিস্তার ঘটেনি, বিদেশি প্রযুক্তিবিদরা অনেকে দক্ষ ও যোগ্য ছিলেন না। চিনের অস্ত্র কারখানায় বা জাহাজ নির্মাণ কারখানায় যা তৈরি হয়েছিল সেগুলি ছিল নিম্নমানের, বিদেশ থেকে অস্ত্র ও জাহাজ আমদানি করতে হয়। চিনের প্রকৃত বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকেরা বিদেশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে দূরে ছিলেন, মধ্যম মানের লোকেরা আধুনিকীকরণের সঙ্গে যুক্ত হন, এজন্য দুর্নীতি ছিল ব্যাপক। লি হুং চাং নিজে খুব খাঁটি লোক ছিলেন না, অবৈধভাবে বহু অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর অনুগামীরা শিল্প কারখানাগুলি থেকে বহু অর্থ আত্মসাৎ করেন।
নৌবহরের জন্য বরাদ্দ ৩০ মিলিয়ন টায়েল অর্থ সম্রাজ্ঞীর গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ নির্মাণের জন্য ব্যয় করা হয়। চিনের পণ্ডিত রাজকর্মচারীরা (scholar-official) পশ্চিমি শিল্প বাণিজ্যকে অবজ্ঞার চোখে দেখত (dirty and vulgar), দরবারও এই মনোভাব থেকে মুক্ত ছিল না। লি হুং চাং তাঁর এক বন্ধুকে একখানি চিঠিতে চিনের রক্ষণশীল গোঁড়া মানসিকতার উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেন (It is really difficult to understand the minds of some Chinese)। সংস্কার প্রবর্তনের বিরোধী ছিল চিনের রক্ষণশীল জেন্ট্রি। সাংহাই রেলপথ নির্মাণ এবং চিনাদের বিদেশ ভ্রমণেরও বিরোধিতা ছিল।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞান গ্রহণের উপযুক্ত ছিল না। নানা দুর্বলতা ও অপূর্ণতা সত্ত্বেও বলা যায় আত্মশক্তি আন্দোলন চিনে আধুনিক শিল্পায়ন ও পুঁজিবাদের সূচনা করেছিল। নতুন শিল্প, কারখানা, স্কুল, জাহাজ শিল্প, ডাক ও তার ব্যবস্থা সব উপকূল বরাবর শহরগুলিতে বা নদী উপকূলের শহরে স্থাপিত হয়। এজন্য চিনের শহর সাংহাই, নানকিং, তিয়েনসিন, ফুচাও, ক্যান্টন ও হ্যাংকাও দ্রুত আধুনিক শহরে পরিণত হয়। এসব শহরে বিদেশিরা থাকত। পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের মানুষ জীবিকার জন্য শহরের কারখানায় কাজ নিয়েছিল। শহরের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে শিল্প-নির্ভর শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। নতুন শিল্প ও বাণিজ্যকে আশ্রয় করে চিনের সমাজে প্রযুক্তিবিদ, ম্যানেজার, উদ্যোগী প্রভৃতি পেশাদার মানুষের আবির্ভাব ঘটে। বিদেশে শিক্ষণপ্রাপ্ত চিনারা দেশে ফিরে সৈন্যবাহিনী, নৌবহর, স্কুল ও কূটনৈতিক বিভাগে কাজ পায়। এরা চিনের নতুন পরিচালক ও উদ্যোগী গোষ্ঠী গঠন করেছিল। আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের তাৎপর্য বা গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।