আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ গুলি আলোচনা কর

 

আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ গুলি আলোচনা কর । আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল।

আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম মৌলিক কারণ হল চীনাবাসীদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক জড়তা। বেশির ভাগ চীনা পন্ডিতেরা ছিলেন রক্ষণশীল, বৈদেশিক বিষয় এবং পাশ্চাত্যের ধাঁচে আধুনিকীকরণকে তারা নোংরা, অশালীন এবং মর্যাদাহানিকর মনে করতেন। রক্ষণশীল গোষ্ঠীর আধুনিকতার প্রতি এই বিরুদ্ধ মনোভাবের দরুন আত্মশক্তি বৃদ্ধির পরিসর সীমিত হয়ে যায়। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিরা বুঝতে পেরেছিল যে চীনের সম্পদ ও শক্তিবৃদ্ধির জন্য বণিকদের বিশ্বাস করতে হবে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। কিন্তু হৃদয়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের আচরণের কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকারী কর্মচারীরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল। ফলে অবস্থার অবনতি ঘটে।

শিল্প উদ্যোগ বা সংস্থা পরিচালনায় লি হাং চ্যাং যতটা উদার মনোভাব দেখান, চ্যাং চি তুং ততোধিক আমলাতান্ত্রিক মনোভাব দেখিয়ে সংস্থাগুলিকে সরকারী নিয়ন্ত্রণের নাগপাশে আবদ্ধ করেন। লি চীনের স্বাভাবিক গৃহীত বিধি মেনে সংস্থা পরিচালনার পূর্ণ কর্তৃত্ব ম্যানেজারের হাতে অর্পণ করেছিলেন। লি-র প্রকল্পগুলিতে সরকার অংশীদারদের পরিবর্তে অভিজ্ঞ বণিকদের পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন যেখানে সরকারী হস্তক্ষেপ ছিল নুন্যতম। কিন্তু চ্যাং চিং তুং-এর ক্ষেত্রে আমরা বিপরীত চিত্র পাই। ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আত্মশক্তি বৃদ্ধির আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়। 

ব্যক্তিগত উদ্যোগপতি এবং সরকারী আধিকারিকদের বিরোধের মধ্যস্থতা করতে গিয়ে একটি নতুন গোষ্ঠীর উদয় হয় যাদের পদমর্যাদা ছিল আধা সরকারী এবং আধাবণিক গোছের। পদ ও কার্যালয় ক্রয়ের সম্ভাবনা থেকে বণিকেরা সরকারী আধিকারিকদের ভূমিকা যেমন পালন করতে পারত তেমনি সরকারী কর্মচারীরা সম্মতি সাপেক্ষে উদ্যোগপতির ভূমিকা পালন করতে পারত। এসব সত্ত্বেও সরকারী হস্তক্ষেপের ফলে সংস্থা পরিচালনার কাজ বিঘ্নিত হত। গ্রে বলেন সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে সরকারী উদ্যোগপতি সরকারী অর্থের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে সংস্থার ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ বাড়ে। বাণিজ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অযোগ্য সরকারী কর্মচারীরা নেওয়ার ফলে সংস্থার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

Merchants’ Steamship Navigation Company -র মত লাভজনক সংস্থার অর্থ রুগ্ন শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হল সরকারী আধিকারিকরা সংস্থার বাণিজ্যিক লাভের বিষয়ে একেবারেই উদ্বিগ্ন ছিলেন না। সংস্থা গড়ে তোলার সময় তাঁর পরিকাঠামোগত দিক যেমন কাঁচামাল, পণ্যপরিবহন, বিপনণ এসব বিষয়কে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না উদ্যোগপতিরা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চ্যাং চিতুং উ-হানে (Wuhan) স্টীল কারখানা গড়ে তুলেছিলেন যাতে সেটাকে তাঁর চোখে চোখে রাখতে পারেন। কিন্তু তিনি কাঁচামালের উৎস থেকে কারখানার বিশাল দূরত্বের বিষয়টি গ্রাহ্য করেন নি। এর ফলে পরিবহনের খরচ যুক্ত হয়ে স্টীলের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং লাভের পরিমাণ কমে যায়।

অনেক সময় এই যুক্তি দেখান হয় যে “guandu Shangban” বা সরকারী তদারকি এবং বণিক ব্যবস্থাপনার শিল্প উদ্যোগগুলি বিদেশী প্রতিযোগিতার জন্য মার খায়। গ্রে মনে করেন এই যুক্তি ঠিক নয়। কারণ বিদেশীদের চীনের ভারী শিল্প গড়তে দেওয়া হয়নি। এছাড়া কয়লা, লৌহ, স্টীল, সিমেন্ট, কাঁচ ইত্যাদি আমদানি করে চীনা উদ্যোগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হত। তাছাড়া শিশু শিল্প গড়ে তোলার জন্য চীনা সরকার যে সব আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, তার কিছুই বিদেশীরা পেত না। 

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে Steamship Navigation Company – কে ইয়াংসি থেকে তিয়ানজিন (Tianjin) পর্যন্ত রাজ্য শস্য-কর (tribute grain) পরিবহনের একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়। Wuhan Iron and Steel Complex-কে রেলপথ নির্মাণের জন্য রেলের পাত সরবরাহের একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়। নতুন বস্ত্রের মিল খোলার ক্ষেত্রেও চীনারা এই ধরনের একচেটিয়া বাজারের সুযোগ পায়। তাই আত্মশক্তি বৃদ্ধির আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য বিদেশী প্রতিযোগিতাকে দায়ী করা চলে না। এর জন্য চীনের পরিকাঠামোগত অসম্পূর্ণতা যেমন দায়ী ছিল তেমনি চীনাদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিস্ক্রিয়তা, রক্ষণশীলতা, সীমিত দৃষ্টিভঙ্গী এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সমানভাবে দায়ী ছিল।